দেশের অর্থনীতির আকার এক ট্রিলিয়ন বা এক হাজার বিলিয়ন ডলারে উন্নীত হতে যাচ্ছে। আর এ উন্নীত হওয়ার পথে প্রভাব বিস্তারকারী কোম্পানিগুলোর মধ্যে জায়গা করে নিয়েছে মোবাইল ফোনে আর্থিক সেবা (এমএফএস) দানকারী দেশের বৃহত্তম প্রতিষ্ঠান বিকাশ। প্রতিষ্ঠানটির উদ্ভাবন, ডিজিটাল সংযোগ, বৈশ্বিক অংশীদারিত্ব, আন্তর্জাতিক পুঁজি সংগ্রহ, চমত্কার কাঠামো ও কৌশলগত কর্মসূচির মাধ্যমে বাংলাদেশকে ট্রিলিয়ন ডলারের অর্থনীতির পথে এগিয়ে নিতে বিশেষ প্রভাব বিস্তার করছে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যবস্থাপনা পরামর্শক প্রতিষ্ঠান বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ (বিসিজি) ‘দ্য ট্রিলিয়ন ডলার প্রাইজ: লোকাল চ্যাম্পিয়নস লিডিং দ্য ওয়ে’ শিরোনামে বাংলাদেশকে নিয়ে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে এসব তথ্য উঠে এসেছে।
বিসিজির সমীক্ষায় বাংলাদেশের সেই সমস্ত উদীয়মান কোম্পানির নাম উঠে এসেছে যারা এদেশের অর্থনীতির রূপান্তরে অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, বাংলাদেশী স্টার্টআপ বিকাশ এখন বিশ্বের অন্যতম মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (এমএফএস) প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটি আর্থিক সেবার ভেতরে, বাইরে এবং ঘাটতিতে থাকা ৬ কোটির বেশি মানুষকে মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে আর্থিক অন্তর্ভুক্তিতে আনতে সক্ষম হয়েছে। ফরচুন ম্যাগাজিন ২০১৭ সালে বিশ্বকে বদলে দেয়ার যেসব কোম্পানির তালিকা প্রকাশ করে, তার মধ্যে বিকাশের নাম ছিল। যেসব কোম্পানি গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক ইস্যুতে প্রভাবশালী ভূমিকা রাখে, তারা এ তালিকায় স্থান পায়।
বিসিজির মূল্যায়নে বলা হয়েছে, বিকাশের ব্যবসায়িক মডেলের মূল জায়গায় রয়েছে ‘সামাজিক প্রভাব’ এবং প্রতিষ্ঠানটি এ বিষয়ে বৈশ্বিক স্বীকৃতি পেয়েছে। এ প্রতিষ্ঠানে বিল অ্যান্ড মেলিন্ডা গেটস ফাউন্ডেশনের মতো প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে ইক্যুয়িটি বিনিয়োগ সামাজিক প্রভাবের অন্যতম স্বীকৃতি। বিকাশ আন্তর্জাতিক পুঁজি সংগ্রহের ক্ষেত্রে আলিবাবা অ্যাফিলিয়েট অ্যান্ট গ্রুপ এবং সফটব্যাংক ভিশন ফান্ডের মতো বড় বিনিয়োগকারীদের বিনিয়োগ পেয়েছে। বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রতিষ্ঠান ইন্টারন্যাশনাল ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইএফসি) বিনিয়োগ, বিকাশের পরিচালনা প্রক্রিয়ার (কর্পোরেট গভর্নেন্স) মান উন্নত করেছে।
প্রসঙ্গত, বিকাশ ছাড়া বিসিজির প্রতিবেদনে চ্যাম্পিয়নদের তালিকায় বেসরকারি খাতের ব্র্যাক ব্যাংক এবং বিশ্বের সর্ববৃহৎ এনজিও ব্র্যাকের নাম রয়েছে। বিকাশ ব্র্যাক ব্যাংকের সাবসিডিয়ারি কোম্পানি। সাবসিডিয়ারি হিসেবে আলাদা কোম্পানি গঠনের মাধ্যমে বাংলাদেশে প্রথম এমএফএস প্রতিষ্ঠান বিকাশ।
এর আগেও বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানের সমীক্ষা এবং পর্যালোচনায় বাংলাদেশের অর্থনীতিতে বিকাশের অবদানের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছে। ২০২০ সালে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ‘ইমপ্যাক্ট অফ মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস ইন বাংলাদেশ - দ্য কেস অব বিকাশ’ শিরোনামের একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করে। এতে বলা হয়, দেশের বৃহত্তম এ এমএফএস প্রতিষ্ঠান থানা বা পরিবার পর্যায়ে মাথাপিছু আয় বাড়াতে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগের মতো অভিঘাত বা সংকটের সময় মানুষের আয় ও ব্যয়ের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলছে। শিক্ষা, স্বাস্থ্য এবং নারীর ক্ষমতায়নেও অত্যন্ত শক্তিশালী ভূমিকা রাখছে বিকাশ। বিকাশ তার নানা উদ্ভাবনী সেবার মাধ্যমে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নৈপূণ্য বাড়িয়েছে।
বিআইডিএসের গবেষণায় বাংলাদেশের অর্থনীতির আকার অর্থাৎ জিডিপির ওপর বিকাশের প্রভাব প্রাক্কলন করা হয়। এতে বলা হয় অর্থ স্থানান্তর অথবা বিল নিষ্পত্তি অথবা পরিশোধের ক্ষেত্রে মোবাইল প্রযুক্তিকে ব্যবহার করে লেনদেনের ব্যয় কমানোর মাধ্যমে বিকাশ অর্থনীতিতে নৈপূণ্য বাড়িয়েছে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, গত দুই বছরে অর্থনীতিতে বিকাশের অবদান আরও বেড়েছে।
বাংলাদেশের অর্থনীতির (মোট দেশজ উত্পাদন বা জিডিপি) আকার এখন ৪৬০ বিলিয়ন ডলারের মতো। বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ। বোস্টন কনসাল্টিং গ্রুপ বর্তমানের অর্থনৈতিক সংকটকে আমলে নিয়ে বলেছে, ব্যাংকিং খাতে তারল্য ও বৈদেশিক মুদ্রার ওপর চাপ এবং মূল্যস্ফীতির মতো স্বল্পমেয়াদী কিছু সমস্যা রয়েছে। তবে এসব সমস্যা ট্রিলিয়ন ডলার অর্থনীতির পথে যাত্রার ক্ষেত্রে বাধার সৃষ্টি করবে না।
বিসিজির প্রতিবেদনে বৈশ্বিক ব্যাংক এইচএসবিসির এক প্রাক্কলনের উল্লেখ করে বলা হয়েছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিশ্বের নবম ভোক্তাবাজার হবে বাংলাদেশ। ভোক্তাবাজার হিসেবে জার্মানি ও যুক্তরাজ্য এবং এশিয়ার ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডকেও ছাড়িয়ে যাবে বাংলাদেশ। বাংলাদেশের বিশাল ভোক্তা শ্রেণী এবং ডিজিটাল অর্থনীতির গতিশীলতা বিকাশের মতো প্রতিষ্ঠানের সেবার পরিধিকে আরও বাড়াবে।
ডিজিটাল অর্থনীতির এগিয়ে যাওয়ার কিছু উদহারণ প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, ২০১২ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে ১০ বছরে মোবাইল ফোন গ্রাহক দ্বিগুণ হয়েছে। ইন্টারনেট গ্রাহক গত ১০ বছরে বেড়েছে ৭০ শতাংশ। ডিজিটাল লেনদেনের সংখ্যা ২০১৯ সালে ছিল ১৭০ কোটি, যা ২০২২ সালে ৩৫০ কোটিতে পৌঁছেছে। বিভিন্ন প্রযুক্তিগত উন্নয়ন ও উদ্ভাবনের ফলে ডিজিটাল লেনদেন আরো বাড়বে।