• ঢাকা
  • সোমবার, ১৬ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ


সফিকুল ইসলাম
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২, ২০২৩, ০৯:৫৩ পিএম
পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করল বাংলাদেশ

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নগুলো একে একে ডানা মেলতে শুরু করেছে বাংলার আকাশে। ১/১১ পরবর্তী সময়ে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকার টানা ১৪ বছর ক্ষমতায় থাকায় বাংলাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহিঃবিশ্বকে ‘উন্নয়নে’ তাক লাগিয়ে দিয়েছেন। দেশের প্রতিটি নাগরিকের একে একে স্বপ্নরা ডানা মেলছে বাংলার আকাশে। উড়াল মেট্রোরেলের আবেশ ফুরানোর আগেই উন্নয়নের মহাসোপান বেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোরেলের (এমআরটি লাইন-১) নির্মাণকাজ উদ্বোধনের মধ্যদিয়ে এবার পাতাল রেলের যুগে প্রবেশ করছে বাংলাদেশ।

মূলত আওয়ামী লীগ সরকারের টানা তিন মেয়াদে বদলে গেছে যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়ন। যোগাযোগ অবকাঠামোর উন্নয়নের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে স্মার্ট পরিবহন যুগেও প্রবেশ করেছে বাংলাদেশ। ইতোমধ্যে গত বছর বিজয়ের মাসে মেট্রোরেল উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে যার দ্বার সূচনা করেছে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন সরকার। মেগাসিটিতে পরিবহন সেবায় মেট্রোরেলের পর এবার স্মার্ট পরিবহন হিসাবে দেশের প্রথম পাতাল মেট্রোলাইন নির্মাণকাজের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জানা গেছে, দেশের প্রথম পাতাল রেলপথের নির্মাণকাজের উদ্বোধন করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৃহস্পতিবার (২ ফেব্রুয়ারি) বেলা ১১টা ৫ মিনিটে নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার দীর্ঘ ম্যাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (এমআরটি) লাইন-১ এর নির্মাণকাজের উদ্বোধন করেন শেখ হাসিনা। 
এ সময় উপস্থিত ছিলেন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী, নারায়ণগঞ্জের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান ও মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভী।

মানুষের জীবন-জীবিকার পরিবর্তন

স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, পাতাল মেট্রোরেলের উদ্বোধন অনুষ্ঠান ঘিরে এলাকার মানুষের মধ্যে ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা দেখা দিয়েছে। তারা এর মধ্য দিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। অনেকেই মনে করছেন সরকারের এই পদক্ষেপের ফলে এই এলাকার গুরুত্ব আরও বাড়বে।

এলাকার অনেকেই বলেছেন, এর মধ্য দিয়ে এখানকার মানুষের জীবনে পরিবর্তন ঘটতে যাচ্ছে। মূলত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উন্নয়ন দর্শনের মূলে রয়েছে মানুষ। উন্নয়ন কার্যক্রমগুলোর দিকে পর্যালোচনায় দেখা যায়, সকল মেগা প্রকল্প দেশ ও মানুষের উন্নয়রে করা হয়েছে।

২০৪১ সালে উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তোলার অংশ হিসেবে এ খাতে মেগা প্রকল্পসহ অসংখ্য উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। এই উদ্বোধনের তালিকায় সর্বশেষ যোগ হলো মেট্রোরেল। কাঙ্খিত এই মেট্রোরেল ঢাকা মহানগর ও তৎসংলগ্ন এলাকার যানজট নিরসন ও পরিবেশ উন্নয়নে বিরাট ভূমিকা পালন করবে।

ঢাকা মাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেডের (ডিএমটিসিএল) ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন সিদ্দিক বলেন, “রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ মৌজায় ৮৮ দশমিক ৭১ একর জমিতে হবে মেট্রোরেলের ডিপো। এতে ব্যয় হবে ৬০৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা। বিমানবন্দর রুট ও পূর্বাচল রুটে চলাচলকারী সব মেট্রো এই ডিপোর সুবিধা পাবে। পিতলগঞ্জে মেট্রোরেলের ডিপো নির্মাণ করা হবে। আর এর মধ্য দিয়ে পাতাল রেলের নির্মাণকাজ শুরু হবে। এমআরটি লাইন-১ দুই ভাগে বাস্তবায়ন করা হবে। একটি অংশ হবে পাতাল, অন্যটি উড়ালপথের। দুটি অংশের মূল ডিপো নির্মাণকাজের ঠিকাদার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গেই চুক্তি স্বাক্ষর হয়েছে। এমআরটি লাইন-১ বাস্তবায়নে খরচ ধরা হয়েছে ৫২ হাজার ৫৬১ কোটি টাকা। এর মধ্যে ৩৯ হাজার ৪৫০ কোটি টাকা অর্থসহায়তা দেবে জাপান ইন্টারন্যাশনাল কো-অপারেশন অ্যাসোসিয়েশন (জাইকা)। বাকি খরচ মেটানো হবে সরকারি তহবিল থেকে।”

ডিএমটিসিএলের ওয়েবসাইট থেকে পাওয়া তথ্যানুযায়ী, এমআরটি লাইন-১-এর আওতায় নির্মাণ হবে মোট ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটার রেলপথ। এই পথে থাকবে দুটি রুট বিমানবন্দর (বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর) আর দ্বিতীয় পূর্বাচল রুট (নতুনবাজার থেকে পিতলগঞ্জ ডিপো)। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর পর্যন্ত রুটের দৈর্ঘ্য হবে ২০ কিলোমিটার। এই রুটে মোট পাতাল স্টেশন থাকবে ১২টি। 

বিমানবন্দর-কমলাপুর রুটই হবে দেশের প্রথম পাতাল রেলপথ। আর দ্বিতীয় অংশ পূর্বাচল রুটের যে ১১ কিলোমিটার তার পুরোটাই যাবে উড়ালপথে। এ পথে স্টেশনের সংখ্যা মোট ৯টি। উড়াল-পাতাল মিলিয়ে প্রতিটি স্টেশনে ট্রেন থামবে আড়াই থেকে সাড়ে তিন মিনিট পর পর। এই ৩১ কিলোমিটার পথে চলবে ২৫টি ট্রেন। এটি চালু হলে প্রতি ১০০ সেকেন্ড পর পর চলাচল করবে। যার প্রতিটিতে একবারে তিন হাজারের বেশি যাত্রী পরিবহনের সক্ষমতা থাকবে। মেট্রোরেলের মতো এটিও হবে বিদ্যুৎ-চালিত এবং দূরনিয়ন্ত্রিত ট্রেন।

জানা গেছে, পাতালপথে কমলাপুর, রাজারবাগ, মালিবাগ, হাতিরঝিল, রামপুরা, পূর্ব হাতিরঝিল, বাড্ডা, উত্তর বাড্ডা, নতুনবাজার, নদ্দা, খিলক্ষেত, বিমানবন্দর টার্মিনাল-৩ ও বিমানবন্দরে স্টেশন থাকবে। প্লাটফর্মে ওঠানামার জন্য উভয় পথের স্টেশনে থাকবে লিফট, সিঁড়ি ও এস্কেলেটর। এ ছাড়া নতুন বাজার স্টেশনে এমআরটি লাইন-৫ নর্দান রুটের সঙ্গে আন্তঃলাইন সংযোগ থাকবে। নদ্দা ও নতুন বাজার স্টেশন আন্তঃসংযোগ রুট ব্যবহার করে বিমানবন্দর থেকে পূর্বাচলে যাওয়া যাবে।

রাজধানীর যানজট নিরসনে ২৫৮ কিলোমিটার পাতাল রেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর আওতায় ২০৫০ সালের মধ্যে ঢাকায় ১১টি রুটে পাতাল রেল নির্মাণ করা হবে। তবে এই প্রকল্পকে ‘উচ্চ ব্যয়নির্ভর’ এবং ‘উচ্চাভিলাষী’ আখ্যা দিয়েছেন নগর পরিকল্পনাবিদরা। তারা বলছেন, এই প্রকল্প রাজধানীর যানজট পরিস্থিতির কোনো ইতিবাচক পরিবর্তন আনবে না।

জানা গেছে, সরকার প্রথমবারের মতো বিমানবন্দর-কমলাপুর এবং পূর্বাচল-নতুন বাজার-রূপগঞ্জের পিতলগঞ্জ রুটের মধ্যে ৩১ দশমিক ২৪১ কিলোমিটারের পাতাল ও উড়াল এমআরটি লাইন-১ নির্মাণ করবে। 
ডিএমটিসিএল এই মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে। প্রকল্পের বিস্তারিত বিবরণে বলা হয়, এমআরটি লাইন-১ ঢাকা বিমানবন্দর থেকে কমলাপুর যেতে ২৪ মিনিট সময় নেবে। ১২টি পাতাল স্টেশনে বিরতি ও সাতটি উড়াল স্টেশনে বিরতিসহ নতুন বাজার থেকে পূর্বাচল যেতে ২০ মিনিট সময় লাগবে। এছাড়াও এমআরটি লাইন-১ চালু হওয়ার পর এই রুটে ৮ লাখ যাত্রী যাতায়াত করতে পারবে। এমআরটি লাইন-১ পাতাল স্টেশন চার তলাবিশিষ্ট হবে। টিকিট কাউন্টার এবং অন্যান্য সুবিধাদি প্রথম বেসমেন্ট লেভেলে থাকবে। প্ল্যাটফর্মটি হবে দ্বিতীয় তালায়।

উড়াল স্টেশনের টিকিট কাউন্টার ও প্ল্যাটফর্ম হবে চতুর্থ তলায়। উড়াল ও পাতাল উভয় স্টেশনেই লিফট, সিঁড়ি এবং এসকেলেটর থাকবে। প্রকল্পটির জন্য জাপানের টোকিও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড ও বাংলাদেশের ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেছে ডিএমটিসিএল। প্রকল্পটি ১২টি প্যাকেজের আওতায় বাস্তবায়িত হবে।

২০১২ সালে নির্মাণের উদ্যোগে নেয় সরকার

রাজধানীর যানজট কমিয়ে মানুষের যাতায়াত সহজ ও দ্রুত করার লক্ষ্যে বিশ্বের উন্নত দেশের মতো রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল নির্মাণের উদ্যোগে ২০১২ সালে সায় দেয় সরকার। সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী মোট ৬ ধাপে মেট্রোরেল নির্মাণের পরিকল্পনা করা হয়। সে পরিকল্পনার প্রথম ধাপে গঠন করা হয় ঢাকা ম্যাস ট্রানজিট কোম্পানি লিমিটেড। উড়াল ও পাতাল রেলপথ মিলিয়ে ৬ ধাপে রয়েছে, এমআরটি লাইন-৬, এমআরটি লাইন-১, এমআরটি লাইন-৫ এ দুই রুট রয়েছে নর্দান ও সাউদার্ন, এমআরটি লাইন-২, এমআরটি লাইন-৪। এরমধ্যে এমআরটি লাইন-৬ দিয়ে প্রকল্পের কাজ শুরু করা হয়।

ডিএমটিসিএল সূত্রে জানা গেছে, এমআরটি লাইন-৬, ১ ও ৫ এই তিন লাইন যথাক্রমে ২০২৫ সালের জুন, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর এবং ২০২৮ সালের ডিসেম্বরের মধ্যে শেষ করার পরিকল্পনা রয়েছে।

তবে প্রকল্প কর্মকর্তারা বলছেন, বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় বিলম্বের কারণে এমআরটি লাইন-১ ও ৫ এর কাজ শেষ হতে ২০৩০ সাল লেগে যেতে পারে। ২০২৮ সালের মধ্যে রাজধানীর সাভারের হেমায়েতপুর থেকে ভাটারা পর্যন্ত উড়াল-পাতাল মিলিয়ে মোট ২০ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথ নির্মাণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। এরমধ্যে ১৩ দশমিক ৫০ কিলোমিটার হবে উড়াল এবং ৭ কিলোমিটার রেলপথ নির্মাণ হবে পাতাল। মোট ১৪টি স্টেশনের ৯টি উড়াল পথে আর ৫টি স্টেশন থাকবে পাতাল পথে। এমআরটি লাইন ৫ নর্দান রুট নামে পরিচিত এই অংশের সার্ভে কাজ চলছে এখন। লাইনটি ২০২৮ সালে নির্মাণকাজ শেষ করার কথা থাকলেও ডিএমটিসিএল এর কর্মকর্তারা বলছেন, এই লাইন ২০৩০ সালের আগে শেষ হচ্ছে না।

এ বিষয়ে ডিএমটিসিএল‍‍`র ব্যবস্থাপনা পরিচালক এমএএন ছিদ্দিক জানিয়েছেন, নানা কারণে প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় দেরি হওয়ায় কাজ শুরু করতে বিলম্ব হচ্ছে। তাই নির্ধারিত সময়ের চেয়ে একটু বেশি সময় লাগতে পারে। ২০৩০ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৬,১ ও ৫ যদি নির্মাণ শেষ করা যায় তাহলেও রাজধানীর যানজট অনেকাংশে কমে আসবে বলে মনে করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা।

রাজধানী ঢাকায় মেট্রোরেল পথ নির্মাণের উদ্যোগের সূচনা হয় এমআরটি লাইন-৬ এর হাত ধরে। উত্তরা থেকে কমলাপুর পর্যন্ত ২১ দশমিক ২৬ কিলোমিটার মেট্রোরেল পথের ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের কাজ শেষ করা হয় প্রথম ধাপে। উত্তরা থেকে আগাঁরগাও পর্যন্ত ১১ দশমিক ৭৩ কিলোমিটারের উদ্বোধন করা হয় গত ২৮ ডিসেম্বর। আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। উদ্বোধনের পর ২৯ ডিসেম্বর থেকে বাণিজ্যিকভাবে যাত্রী পরিবহন করে যাচ্ছে মেট্রোরেল।

সূত্র বলছে, আগামী বছরের শেষ দিকে চালু করা হবে আগারগাঁও থেকে মতিঝিল পর্যন্ত। এরপরের ধাপে নির্মাণ হবে মতিঝিল থেকে কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশন পর্যন্ত। আর এতে সময় লেগে যাবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত।

Link copied!