সরকারপ্রধানসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রনায়করা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আপসহীন ও মানবতাবাদী নেতৃত্বের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানিয়ে তাকে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মহান স্বপ্নদ্রষ্টা রাষ্ট্রনায়ক হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন।
বিভিন্ন সময়ে রাজধানীর ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শনকালে বিশ্বনেতারা বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তারা ধানমন্ডি বঙ্গবন্ধু ভবনে রক্ষিত পরিদর্শক মন্তব্য বইয়ে এই মূল্যায়ন তুলে ধরেন।
“বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতা, সংগ্রাম ও আত্মত্যাগ একটি জাতিকে স্বাধীনতার জন্য অনুপ্রাণিত করেছিল এবং সোনার বাংলার স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিয়েছিল। বঙ্গবন্ধুর মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানের মতো ঘটনা মানব সভ্যতার ইতিহাসে খুবই বিরল। মহান একজন মানবতাবাদী হিসেবে তিনি সব মানুষের জন্য সমতা, সুযোগ ও মর্যাদার মহান প্রবক্তা।”
নগরীর ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধু ভবনের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন শেষে মন্তব্য লেখার জন্য রক্ষিত বইয়ে এ মন্তব্য করেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি।
এতে মোদি আরও বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করার সুযোগ পেয়ে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। ভারতের জনগণের পক্ষে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। আমি ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে স্থায়ী সম্পর্কের যে স্বপ্ন তিনি দেখেছিলেন তার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।”
মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি শ্রী রাম নাথ কোবিন্দ বলেন, “আমি বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের মহান আত্মত্যাগ দেখে গভীরভাবে অনুপ্রাণিত এবং তিনি তাঁর দেশের মানুষের সেবা করেছেন। আমি বঙ্গমাতাসহ পরিবারের সব সদস্য যারা অকালে নিহত হয়েছেন, তাদের প্রতিও শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বঙ্গবন্ধুর দেখানো আদর্শ ও মূল্যবোধ বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের পরবর্তী প্রজন্মকে পথ দেখাবে।”
শ্রী রাম নাথ কোবিন্দ আরও বলেন, “বাংলাদেশের প্রিয় জাতির পিতার জীবন ও কর্মের সাক্ষ্য দেওয়া ভবন পরিদর্শন করে নিজেকে সম্মানিত মনে করছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধের অনুপ্রেরণাদায়ী নেতা।”
ভারতের সাবেক এই রাষ্ট্রপতি ২০২১ সালের ১৫ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী বিনালি ইয়োলড্রিম ২০১৭ সালের ১৯ ডিসেম্বর জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। এ সময় মন্তব্য বইয়ে তিনি লেখেন, “বাংলাদেশের মহান স্থপতি এবং বাঙালির রাষ্ট্রনায়ক শেখ মুজিবুর রহমানের স্মৃতিধন্য বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন আমার জন্য খুবই সম্মানের বিষয়। বঙ্গবন্ধু কতিপয় ষড়যন্ত্রকারী সামরিক অফিসারদের হাতে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেছেন। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ৪০ বছর পার হয়ে যাওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমান এখনো ২০ শতকের একজন অন্যতম নেতা হিসেবে স্মরণীয় ও বরণীয়।”
বিনালি ইয়োলড্রিম বলেন, “তুরস্কের জনগণ এবং মোস্তফা কামাল আতাতুর্কের পক্ষ থেকে আমি একজন মহান নেতার প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি। বাংলাদেশ সফরকালে জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করে আমি ব্যক্তিগতভাবে যা প্রত্যক্ষ করেছি, তা আমার হৃদয়কে গভীরভাবে স্পর্শ করেছে। আমি বিশেষ করে উল্লেখ করতে চাই যে আমরা বাংলাদেশের স্থপতি প্রয়াত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নিয়ে একই উষ্ণ ভাবাবেগে ডুবে আছি এবং তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করছি।”
মালদ্বীপের রাষ্ট্রপতি ইব্রাহীম মোহামেদ সলিহ বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সারা জীবনের সংগ্রাম বাংলাদেশকে তাঁর চূড়ান্ত লক্ষ্য স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের পথকে তৈরি করেছে। তিনি গণতন্ত্র ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার লাভের ক্ষেত্রে আইকন হিসেবে সর্বদা স্মরণীয় হয়ে থাকবেন এবং তাঁর আদর্শ বাংলাদেশ ও বিশ্বে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মকে অনুপ্রাণিত করবে।” ইব্রাহীম মোহামেদ সলিহ তিনি ২০২১ সালের ১৭ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
ভারতের সাবেক রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাঙালি জাতির অধিকার ও মর্যাদা আদায়ে বিংশ শতাব্দীর অন্যতম গভীর তাৎপর্যপূর্ণ স্বাধীনতা সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধু ছিলেন জনগণের নেতা এবং তাদের সেবায় সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন। তাঁকে দেওয়া বঙ্গবন্ধু খেতাবে দেশের মানুষের প্রতি এই দেশপ্রেমিক নেতার গভীর ভালোবাসা প্রতিফলিত হয়।”
প্রণব মুখোপাধ্যায় আরও বলেন, “আমাদের দুই দেশের জনগণের মধ্যে বন্ধুত্ব প্রতিষ্ঠায় ব্রতী এই মহান স্বপ্নদ্রষ্টা ও বিশ্ব রাষ্ট্রনায়ককে আমি অভিবাদন জানাই।” তিনি ২০১৩ সালের ৪ মার্চ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
জার্মানির প্রেসিডেন্ট ক্রিস্টিয়ান উলফ বঙ্গবন্ধু সম্পর্কে বলেন, “এই স্মৃতি জাদুঘর আমাদের একজন মহান রাষ্ট্রনায়ককে স্মরণ করিয়ে দেয়, যিনি তার জনগণের অধিকার ও মর্যাদার জন্য লড়াই করেছেন এবং অতিদ্রুত স্বাধীনতা ও জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠায় প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলেন। আমি বাঙালি জাতির স্থপতি এবং জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমার অশেষ শ্রদ্ধা জানাই।”
ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং বলেন, “বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর সম্মোহনী এবং অসীম সাহসী নেতৃত্বে মাধ্যমে স্বাধীনতা যুদ্ধে তাঁর জনগণকে নেতৃত্ব দান করেছিলেন। আমি একজন মহান দূরদর্শী এবং রাষ্ট্রনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করছি যিনি স্বাধীন, উন্নত এবং গর্বিত বাংলাদেশের দৃঢ় ভিত্তি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।”
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী বলেন, “দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন নেতা এবং রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতি আমি শ্রদ্ধা জানাই। তিনি স্বাধীনতার জন্য প্রতিকূলতা ও বিরূপ পরিস্থিতি উপেক্ষা করে অটল সাহসিকতার সাথে লড়াই করেছেন। বঙ্গবন্ধু গণতান্ত্রিক এবং সমতার ভিত্তিতে মর্যাদা বৃদ্ধির মাধ্যমে তার জনগণকে ক্ষমতাবান করতে চেয়েছিলেন। স্বাধীনতার পরপরই বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশের জন্য সবচেয়ে বড় ট্রাজেডি। তাঁর আত্মত্যাগ সব সময় সম্মানিত হবে, পরবর্তী প্রজন্ম এ আত্মত্যাগকে সম্মান করবে এবং এ সম্মান অব্যাহত থাকবে। আমি তাঁর স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই।”
ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকারের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, “এই উপমহাদেশের প্রতিটি মুক্তিকামী, মাতৃভাষার প্রতি শ্রদ্ধাশীল মানুষের মনে বঙ্গবন্ধু এক জ্বলন্ত অনুপ্রেরণা। তিনি মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি, স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের স্থপতি এবং পিতা। বাংলা ভাষাকে বিশ্বের মঞ্চে অন্যতম শ্রেষ্ঠত্বে মর্যাদা এনে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু। তিনি সেই বিরল নেতা, যার প্রতি ধর্মমত নির্বিশেষে সকল মানুষ প্রণাম জানিয়ে ধন্য হয়। তার স্মৃতির প্রতি আমার বিনম্র শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করি।”
শান্তিতে নোবেলজয়ী কৈলাস সত্যার্থি বলেন, “আমার আবেগ ও অনুভূতি জানানোর ভাষা হারিয়ে ফেলেছি। এই স্থানটি সত্যিকারভাবেই একটি তীর্থভূমি, প্রার্থনার একটি পবিত্র স্থান, যারা মানুষের মর্যাদা, স্বাধীনতা, ন্যায় বিচার ও কল্যাণে বিশ্বাস করে।” ২০২৩ সালের ১৩ জানুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন শান্তিতে এই নোবেল বিজয়ী।
কৈলাস সত্যার্থি আরও বলেন, “এই স্থানটি ভৌগোলিক সীমা ও সময় অতিক্রম করেছে, কারণ বঙ্গবন্ধু নিজের সত্ত্বাকে সার্বজনীন ও অমর করে রেখে গেছেন। আমি প্রার্থনা করি, এখানে যে ধরণের সহিংসতা, নিষ্ঠুরতা এবং বর্বরতা হয়েছে, তার পরিসমাপ্তি ঘটবে এবং কোথাও যেন এ ধরণের ঘটনা না ঘটে। পৃথিবী যেন মানবিক ও সভ্য হয়, যেখানে একটি বন্দুকের গুলিও যেন তৈরি না হয় ও তার ব্যবহার যাতে না হয়।”
কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের বিশেষ দূত জ্যাং স্যাং মিন ২০২৩ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন। পরিদর্শন শেষে তিনি পরিদর্শক বইয়ে মন্তব্য করেন, “বঙ্গবন্ধু তাঁর মাতৃভূমি বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য সারাজীবন যে লড়াই সংগ্রাম করেছেন তার প্রতি তিনি গভীর শ্রদ্ধা জানান। তিনি শান্তির পায়রার মতো তাঁর দেশের মানুষের স্বাধীনতাকে ভালবাসতেন, যার মূল্য সার্বজনীন। তাঁর (বঙ্গবন্ধু) স্বাধীনতার সংগ্রাম ভবিষ্যতের জন্যও অব্যাহত থাকবে।”
কলকাতা হাইকোর্টের বিচারপতি সিদ্ধার্থ রায় চৌধুরী বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে প্রণাম। ভারতের মাটিতে থেকেও আমরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিতে উদ্বেলিত হয়েছি। ৭ মার্চের আপনার কবিতা বাঙালি হিসেবে আমাকে, আমাদের আজও দোলা দেয়। বাঙালি জাতিকে যেন কেউ দাবায়ে রাখতে না পারে—এই আশীর্বাদ প্রার্থনা করি।” তিনি ২০২৩ সালের ১০ মার্চ জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর পরিদর্শন করেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সপরিবার নিহত হওয়ার পর সামরিক সরকার বাড়িটিতে কাউকে প্রবেশ করতে দেয়নি। ১৯৮১ সালের ১৭ মে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা দেশে ফেরার পরেও তাঁকে বাড়িটিতে প্রবেশ করতে দে্রয়া হয়নি। পরে একই বছরের ১০ জুন তিনি বাড়িতে প্রবেশ করার অনুমতি পান।
১৯৯৪ সালের ১৪ আগস্ট এ বাড়িটিকে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান স্মৃতি জাদুঘর হিসেবে ঘোষণা করেন।
সূত্র : বাসস