রাজধানী ঢাকায় গত এক মাসে বেশ কয়েকটি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এক ঘটনার রেশ না কাটতেই ভেসে আসছে আরেকটি ভয়াবহ বিস্ফোরণের খবর। চার দিনে ঢাকা-চট্টগ্রামসহ দেশের পাঁচ স্থানে বিস্ফোরণে অন্তত ৩৪ জন নিহত হয়েছেন। রাজধানী গুলশান বহুতল ভবনে আগুন, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডে অক্সিজেন প্লান্টে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, ঢাকার সাইন্সল্যাবে তিনতলা ভবনে গ্যাস বিস্ফোরণ ও সর্বশেষ গুলিস্তানের সিদ্দিকবাজারে ভয়াবহ বিস্ফোরণে ২২ জন নিহতের ঘটনায় পুরো রাজধানীজুড়ে সাধারণ মানুষের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রতিটি দুর্ঘটনার পর প্রশাসনিক তদন্ত হয়। কিন্তু কারিগরি অনুসন্ধান করা হয় না। ফলে কোনো ঘটনারই প্রকৃত কারণ জানা যায় না। এ কারণে ভবিষ্যতে এসব দুর্ঘটনা এড়াতে কী ধরনের সতর্কতামূলক পদক্ষেপ নেওয়া দরকার, তা নির্ধারণ করা হয় না। ফলে বারবার একই ধরনের দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নিরীহ মানুষ। প্রকৃতপক্ষে ঢাকাসহ বড় বড় শহরগুলো প্রতি মুহূর্তেই বড় বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকির মুখে রয়েছে। আর নাগরিকেরা বাস করছেন তীব্র নিরাপত্তাহীনতার ভেতর।
প্রতিটি অগ্নিকাণ্ডের পরে জানা গেছে, হয় এসি বিস্ফোরণ বা গ্যাস বিস্ফোরণে এসব দুর্ঘটনা ঘটছে। গত রোববার রাজধানীর সায়েন্স ল্যাবে একটি ভবনে বিস্ফোরণে তিনজন মারা যান। গত শনিবার সীতাকুণ্ডে কারখানায় বিস্ফোরণে নিহত হন সাতজন। এর কয়েক ঘণ্টা আগে ওইদিন ভোরে রাজধানীর গুলশানে এসি বিস্ফোরণে দগ্ধ হন দুইজন। তাদের মধ্যে গোপাল মল্লিক নামে একজনের মৃত্যু হয়। এ নিয়ে গত চার দিনে পাঁচটি বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটল। এসব ঘটনায় নিহতসহ আহত হয়েছেন অসংখ্য মানুষ। এর আগেও অনেক ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে।
২০২২ সালে চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ডের বিএম ডিপোতে বিস্ফোরণে ৫১ জনের মৃত্যুর ঘটনা ঘটে। ২০২১ সালের ২৭ জুন রাজধানীর মগবাজারে বিস্ফোরণে ১২ জনের মৃত্যু হয়। ওই বিস্ফোরণে আশপাশের অনেক ভবন কেঁপে ওঠে। গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে বিস্ফোরণ হয় বলে তদন্তসংশ্লিষ্টদের ভাষ্য। এর আগে গ্যাস লাইন লিকেজ থেকে ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটে নারায়ণগঞ্জে। ২০২০ সালের ৪ সেপ্টেম্বর রাতে নারায়ণগঞ্জের বাইতুস সালাত জামে মসজিদে বিস্ফোরণে ইমামসহ ৩১ জন প্রাণ হারান।
জমে থাকা গ্যাসে এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ হতে পারে কি না জানতে চাইলে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. আবুল কালাম মো. লুৎফর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বদ্ধঘরে বা কক্ষে গ্যাস জমতে পারে। জমে থাকা এই মিথেন গ্যাসের সঙ্গে অক্সিজেনের উপস্থিতি থাকলে দহনের কারণে বিস্ফোরণ হওয়া স্বাভাবিক।”
গ্যাসের প্রেশারটা কতটুকু ছিল, সে অনুযায়ী বিস্ফোরণের মাত্রা নির্ভর করে জানিয়ে রসায়নের এই অধ্যাপক আরও বলেন, “গুলিস্তানে ভয়াবহ বিস্ফোরণ, সায়েন্স ল্যাব এলাকায় যে বিস্ফোর হলো, জমে থাকা গ্যাসে এত ভয়াবহতা কীভাবে ছড়াল, তা বোধগম্য নয়। এটা সন্দেহজনক। বিস্তারিত পরীক্ষা-নিরীক্ষা দরকার।”
ফায়ার সেফটি বিশেষজ্ঞ প্রকৌশলী এমএ রশিদ টিপু সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “জরুরি হচ্ছে বাসাবাড়ি এবং বাণিজ্যিক ভবনগুলোর গ্যাসলাইন ও স্যুয়ারেজ লাইন নিয়মিত পরীক্ষা করা। কোনোভাবে যদি গ্যাসলাইন কিংবা স্যুয়ারেজ লাইন দিয়ে গ্যাস বের হয় সেটি দ্রুত সারানোর ব্যবস্থা নিতে হবে। যেসব বাসাবাড়িতে গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার হয়, সেগুলোতে অবশ্যই মেয়াদ উল্লেখ করতে হবে। একই সঙ্গে নিয়মিত পরীক্ষা করে এর নিরাপদ ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে।”
সায়েন্স ল্যাব এবং সিদ্দিকবাজারের বিস্ফোরণের ঘটনায় বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ইয়াসির আরাফাত খান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকায় পরপর যে দুটি বিস্ফোরণ ঘটল, তা জমে থাকা গ্যাস থেকে ঘটেছে বলা হচ্ছে। বিস্ফোরণের ধরন ও যেভাবে চারপাশের দেয়াল ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তা থেকে অনুমান করা যায়। ভবনের ভেতরে জমে থাকা গ্যাস থেকে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। এ ক্ষেত্রে গ্যাস বলতে জ্বালানি হিসেবে ব্যবহারযোগ্য মিথেন অথবা এলপিজিকেই বুঝায়।”
আরাফাত খান আরও বলেন, “এসব গ্যাসের উপস্থিতিই মূলত এ ধরনের দুর্ঘটনার কারণ হয়। এক্ষেত্রে ভবনের ভেতরে দুটি উপায়ে গ্যাস জমা হতে পারে। বাসাবাড়িতে গ্যাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অথবা প্রাকৃতিক গ্যাসের লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক সময় পয়োনিষ্কাশন লাইনে এই গ্যাস জমা হয়। এই গ্যাস অনেক সময় শৌচাগারের পাইপ দিয়ে ওপরে উঠে বদ্ধ কোনো স্থানে জমতে পারে, যা পরবর্তী সময়ে বৈদ্যুতিক স্পার্ক বা সামান্য শক্তি পেলেও এ থেকে বিস্ফোরণ ঘটা অস্বাভাবিক নয়।”
অপরিকল্পিত নগরায়ন আইন না মানার প্রবণতা স্থপতি ইকবাল হাবিব সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অপরিকল্পিত নগরায়নের জন্য দায়ী ভবন মালিক, সরকারি অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারি এমনকি কিছুসংখ্যক স্থপতিও। চুরিহাট্টা থেকে অভিজাত নগরী গুলশান, সাইন্স ল্যাব ও সিদ্দিক বাজার। আগুনে পুড়ে অঙ্গার হচ্ছেন মানুষ। একের পর এক অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা বারবার সর্তক হওয়ার চূড়ান্ত বার্তা দিলেও বাস্তবতা বলছে, যাদের টনক নড়ার কথা। পরিস্থিতি থাকছে আগের মতোই। তদন্ত হয়, নিরাপত্তার প্রশ্নে নথিপত্রে নেওয়া হয় কিছু উদ্যোগ। কিন্তু নথিবদ্ধ এসব উদ্যোগের বাস্তবায়ন দেখতে পান না সাধারণ মানুষ।”
ইকবাল হাবিব আরও বলেন, “বিস্ফোরণ কিংবা অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্তৃপক্ষ বারবার দায় এড়িয়ে যাচ্ছে। মগবাজার ও নারয়াণগঞ্জের বিস্ফোরণের সময় সরকারি সংস্থার তদন্তেই তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষের চরম গাফিলতি ও অনিয়মের কথা উঠে আসে। কিন্তু তিতাস গ্যাস কর্তৃপক্ষ সাময়িকভাবে দুই-একজনের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া ছাড়া কঠোর কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। ফলে সাধারণ মানুষের আতঙ্ক থাকবে এটা স্বাভাবিক।”
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব প্ল্যানার্সের (বিআইপি) সাধারণ সম্পাদক ড. আদিল মুহাম্মদ খান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “রাজধানীর ৯৫ ভাগ ভবনেই অগ্নি নির্বাপনের ব্যবস্থা নেই। এ নিয়ে বহুবার তাদের মতামত জানালেও রাজউকের টনক নড়েনি। অবৈধ অর্থের লেনদেন যতদিন বন্ধ না হবে ততদিন এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।”
ঢাকার মধ্য হঠাৎ বিস্ফোরণের বিষয়ে তিতাসের উপমহাব্যবস্থাপক সিদ্দিকুর রহমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “ঢাকার সাইন্স ল্যাব ও সিদ্দিকবাজারে বিস্ফোরণে তিতাসের সবকিছু অক্ষত রয়েছে। পাইপলাইনে কোনো ছিদ্র পাওয়া যায়নি। একই সঙ্গে মিটার এবং রাইজার অক্ষত রয়েছে। গ্যাস ডিটেকটর দিয়ে পরীক্ষা করে সেখানে মিথেনের কোনো অস্তিত্বও পাওয়া যায়নি। সিদ্দিকবাজারেও তিতাসের কোনো ত্রুটি খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
রাজউকের পরিচালক (জোন-৫) হামিদুল ইসলাম সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সিদ্দিকবাজারের ভবনটি ৪৫ বছর আগের। তখন রাজউক ছিল না। এ কারণে এ ভবন সম্পর্কে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।”
হামিদুল ইসলাম আরও বলেন, “ঢাকার ভবনগুলোতে স্যুয়ারেজ ও পয়োনিষ্কাশনের দায়িত্ব ঢাকা ওয়াসা এবং সিটি করপোরেশনের। এ দুটি প্রতিষ্ঠানের দায়িত্বশীল কোনো কর্মকর্তাকে ঘটনার দুই দিনেও দেখা যায়নি। ভবনটির নিচে সেফটি ট্যাংক ছিল এবং এই ট্যাংক থেকেও দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। আগামী ৭ দিনের মধ্যে ঢাকার সব আবাসিক ও বাণিজ্যিক ভবনে বেজমেন্টে তালিকা করে অভিযান পরিচালনা করা হবে। যেসব ভবন ঝুঁকিপূর্ণ দেখা যাবে, সেগুলোর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”