পৃথিবীতে প্রতিবছর সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যান কোন প্রাণীর আক্রমণে? এমন প্রশ্নের জবাবে অনেকেই হয়তো বাঘ, সিংহ, কুমির কিংবা সাপের নাম বলবেন।
এই প্রাণীগুলো যে ভয়ঙ্কর এবং প্রাণঘাতী, তাতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু এগুলোর কোনোটিই এককভাবে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যুর জন্য দায়ী নয়।
তাহলে সেই প্রাণী কোনটি? দেখতেই বা কেমন? এসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে মানুষের জন্য ‘বিপজ্জনক’ দশটি প্রাণীর তালিকা তৈরি করেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিষয়ক খ্যাতনামা সাময়িকী ‘বিবিসি সায়েন্স ফোকাস’।
যুক্তরাজ্যভিত্তিক সাময়িকীটির তালিকায় একেবারে শীর্ষে এমন একটি প্রাণীর নাম দেখা যাচ্ছে, যেটির বসবাস বাংলাদেশের মানুষের ঘরে ঘরে।
আরও কৌতুহল উদ্দীপক এবং নির্মম বাস্তবতা হচ্ছে, ‘বিপজ্জনক’ প্রাণী ওই তালিকায় মানুষের নিজের নামও উঠে এসেছে।
এটাও দেখা যাচ্ছে যে, শীর্ষ প্রাণঘাতী প্রাণীগুলোর বেশিরভাগই আকার-আকৃতিতেও খুব একটা বড় নয়।
চলুন এবার জেনে নেওয়া যাক ওই তালিকায় ঠিক কোন কোন প্রাণীর নাম রয়েছে এবং সেগুলোর আক্রমণে প্রতিবছর কত মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন?
১০. সিংহ
বনে বসবাস না করেও ‘বনের রাজা’ নামে পরিচিত সিংহের গর্জন যারা নিজ কানে শুনেছেন, তারাই কেবল জানেন সেটি কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে। কিন্তু আকৃতিতে বড় এবং শক্তিশালী এই প্রাণীর অবস্থান দেখা যাচ্ছে প্রাণঘাতী দশ প্রাণির তালিকার একেবারে তলানিতে। কারণ এর কারণে খুব বেশি মানুষের প্রাণ দিতে হয় না।
গবেষকদের বরাত দিয়ে বিবিসি সায়েন্স ফোকাস বলছে, সিংহের আক্রমণে বছরে গড়ে ২০০ জনের মতো মানুষ মারা যান, যাদের বেশিরভাগই আফ্রিকা মহাদেশের। কারণ সিংহের বসবাস সেখানেই সবচেয়ে বেশি। তবে তালিকায় একবারে নিচে রয়েছে বলে হিংস্র এই প্রাণীটিকে মোটেও খাটো করে দেখার সুযোগ নেই।
এদের সামনে পড়লে মুহূর্তেই প্রাণ যেতে পারে যে কারো। মানুষ নিজেও সেটি জানে বলেই এদের কাছ থেকে দূরে থাকে। মূলত সেই কারণেই সিংহের আক্রমণে তুলনামূলক কম মানুষের মৃত্যু হয় বলে জানাচ্ছেন গবেষকরা।
৯. জলহস্তী
মানুষের জন্য বিপজ্জনক প্রাণির তালিকায় সিংহের পরেই নাম রয়েছে জলহস্তীর। তৃণভোজী এই প্রাণীটির নাম তালিকায় দেখে অনেকেই হয়তো অবাক হবেন। কারণ এ ধরনের প্রাণীরা সাধারণত নিরীহ ও শান্ত স্বভাবের হয়ে থাকে। কিন্তু জলহস্তী এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম।
গবেষকরা বলছেন, এদের আক্রমণে আফ্রিকায় প্রতিবছর গড়ে প্রায় ৫০০ জন মানুষ অকালে প্রাণ হারান। জল ও স্থলপথে চলাচলের সময় সাধারণত এরা মানুষের ওপর আক্রমণ করে থাকে।
বিবিসি সায়েন্স ফোকাস সাময়িকী বলছে, ধারাল দাঁত দিয়ে এরা সিংহের চেয়ে তিনগুণ বেশি গতিতে কামড় বসাতে পারে, যা একজন মানুষের শরীরকে দুখণ্ড করার জন্য যথেষ্ট।
মূলত সেই কারণেই জলহস্তীকে মানুষের জন্য অন্যতম বিপজ্জনক স্তন্যপায়ী প্রাণী হিসেবে চিহ্নিত করেছেন গবেষকরা।
৮. হাতি
স্থলভাগের সবচেয়ে বড় এবং ওজনদার স্তন্যপায়ী প্রাণী হচ্ছে হাতি। এর বিশাল দেহ এবং অসাধারণ শক্তি অনেক সময় মানুষের মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়। পূর্ণবয়স্ক একটি হাতির ওজন পাঁচ থেকে আট টন পর্যন্ত হয়ে থাকে, যা একজন মানুষকে পায়ের নিচে ফেলে পিষে মারার জন্য যথেষ্ট। এ ছাড়া রেগে গেলে এরা শুঁড় দিয়ে আছড়েও মানুষ মেরে থাকে।
বিবিসি সায়েন্স ফোকাসের মতে, মানুষের জন্য বিপজ্জনক প্রাণীগুলোর মধ্যে হাতির অবস্থান অষ্টম। এর আক্রমণে বছরে গড়ে প্রায় ৬০০ জন মানুষ নিহত হয়। বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম এলাকায় মাঝে মধ্যে বন্য হাতির আক্রমণে মানুষ মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটতে দেখা যায়।
৭. কুমির
হাতির মতো বিশাল দেহের অধিকারী না হয়েও মানুষ হত্যার দিক থেকে এগিয়ে রয়েছে জলভাগের অন্যতম হিংস্র মাংসাশী প্রাণী কুমির। এদের আক্রমণে বছরে গড়ে এক হাজার মানুষ মারা যায় বলে জানিয়েছেন গবেষকরা।
এছাড়া আরও কয়েক শ মানুষ কুমিরের আক্রমণে গুরুতর আহত, এমনকি পঙ্গুত্বও বরণ করে থাকেন। এর অর্থ এই নয় যে এরা মানুষকে মারার জন্য ওঁৎ পেতে থাকে। তবে সুযোগ পেলে ছাড়েও না। মূলত সেকারণেই বিজ্ঞানীদের অনেকে কুমিরকে ‘সুযোগ সন্ধানী শিকারী’ বলে অভিহিত করে থাকেন।
বাংলাদেশের সুন্দরবনসহ নদী তীরবর্তী এবং উপকূলীয় এলাকায় প্রায়ই কুমিরের আক্রমণের খবর পাওয়া যায়। চলতি বছরের শুরুতে সুন্দরবনে কুমিরের আক্রমণে একজন মারাও গেছেন।
৬. কাঁকড়াবিছা
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন এই বিষাক্ত প্রাণিটির কারণে সারা বিশ্বে প্রতিবছর গড়ে তিন হাজারের বেশি মানুষ প্রাণ হারান। ক্ষুদ্রাকার এই প্রাণীটির দৈহিক গঠন এবং হাঁটা-চলায় কাঁকড়ার সঙ্গে কিছুটা মিল রয়েছে বলে বাংলাদেশে এরা ‘কাঁকড়াবিছা’ নামেও বেশ পরিচিত।
মধ্যপ্রাচ্য ও উত্তর আফ্রিকার মরুভূমি অঞ্চলেই এদেরকে বেশি দেখা যায়। বৃশ্চিকের সাধারণত লেজের অংশে বিষ ধাকে। আক্রমণকালে এরা লেজ দিয়ে হুল ফোটায় এবং শিকারের শরীরে বিষ ঢেলে দেয়।
৫. অ্যাসাসিন বাগ
এটি এক ধরনের পতঙ্গ, যেটি মধ্য ও দক্ষিণ আমেরিকায় বেশি দেখা যায়। দেখতে অনেকটা মশা-মাছির মতো এই প্রাণীকে কেউ কেউ ‘কিসিং বাগ’ নামেও ডেকে থাকেন। আকারে ছোট হলেও রক্তচোষা এই প্রাণীটি চাগাস রোগের জীবাণু ছড়ায়।
চাগাস এমন একটি সংক্রামক রোগ, যাতে আক্রান্ত হয়ে প্রতিবছর ১০ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা যান। অ্যাসাসিন বাগ সাধারণত ঘুমন্ত মানুষকে কামড়ায়। তখন মানুষের শরীরে ‘প্রোটোজোয়ান ট্রাইপানোসোমা ক্রুজি’ নামক একপ্রকার জীবাণু ঢুকে পড়ে। তবে এই রোগাক্রান্ত হলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই মানুষ বুঝতে পারে না। ফলে ধীরে ধীরে জীবাণু শরীরে ছড়াতে থাকে এবং এক পর্যায়ে আক্রান্ত মানুষটি মারা যায়। কামড়ানোর বাইরে অ্যাসাসিন বাগের মাধ্যমে সংক্রমিত খাবার খেলেও চাগাস রোগ হতে পারে।
৪. কুকুর
কুকুরকে মানুষের বিশ্বস্ত সঙ্গী ভাবা হয়ে থাকে। অথচ এই প্রাণীটির কামড়ে প্রতিবছর সারা বিশ্বে গড়ে ৫৯ হাজার জনের মতো মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এক্ষেত্রে বেওয়ারিশ পাগলা কুকুরের পাশাপাশি বুনো কুকুর, এমনকি পোষা কুকুরও কামড় দিয়ে বসতে পারে।
তেমনটি ঘটলে দ্রুত চিকিৎসা নেওয়া উচিৎ। আর এক্ষেত্রে ব্যত্যয় ঘটলেই ব্যক্তির জলাতঙ্ক রোগ হয় এবং এক পর্যায়ে তিনি মারা যান।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, কুকুরের মাধ্যমেই মানুষের শরীরে প্রধানত জলাতঙ্কের ভাইরাস সংক্রিত হয়ে থাকে। তবে কামড়ানো ছাড়াও আক্রান্ত কুকুরের শরীরের ক্ষতস্থান, লালা এবং নখের আঁচড়ের মাধ্যমেও মানুষের শরীরে জলাতঙ্কের জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।
৩. সাপ
অনেকেই হয়তো এতদিন ভেবে এসেছেন যে, সাপের কামড়েই পৃথিবীতে সবচেয়ে বেশি মানুষের মৃত্যু হয়ে থাকে। কিন্তু বিবিসি সায়েন্স ফোকাসের তালিকা বলছে, ধারণাটি সঠিক নয়। ম্যাগাজিনটির হিসেবে, বিপজ্জনক প্রাণীর তালিকায় সাপের অবস্থান তিন নম্বরে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, পৃথিবীতে প্রতিবছর প্রায় ৫৪ লাখ মানুষকে সাপে কামড়ায় বা দংশন করে, যার মধ্যে প্রায় ৮১ হাজার থেকে এক লাখ ৩৮ হাজার মানুষ মারা যান।
এ ছাড়া যারা প্রাণে বেঁচে যান, তাদের মধ্যে কয়েক লাখ মানুষ অঙ্গহানি, পঙ্গুত্ববরণসহ শারীরিক ও মানসিক নানা ক্ষতির মুখে পড়েন।
২. মানুষ
বিবিসি সায়েন্স ফোকাস ম্যাগাজিন বলছে, পৃথিবীতে মানুষ নিজেই নিজের জন্য ‘বিপজ্জনক’ একটি প্রাণী। কেননা, মানুষের হাতেই প্রতিবছর তার নিজ প্রজাতির প্রায় চার লাখ সদস্য খুন হচ্ছে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসেবে, শুধুমাত্র ২০১৯ সালে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চার লাখ ৭৫ হাজারেরও বেশি মানুষ হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে খুনের হার সবচেয়ে বেশি দেখা গেছে মধ্য আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলে।
ওই এলাকার দেশগুলোতে যত হত্যাকাণ্ড হয়েছে, সেগুলোর অর্ধেকেরও ঘটনায় আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে বলেও জানাচ্ছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা।
প্রতিষ্ঠানটি এটাও বলছে যে আত্মহত্যা এবং গাড়ি দুর্ঘটনায় নিহতদের সংখ্যা বিবেচনা করলে মানুষের হাতে মানুষের মৃত্যুর এই সংখ্যা বছরে ১২ লাখেরও বেশি।
১. মশা
দেখতে ক্ষুদ্র মনে হলেও প্রাণনাশের সংখ্যা বিবেচনায় মশা হিংস্র প্রাণীদেরও হার মানিয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্যমতে, ক্ষুদ্র এই প্রাণীটির কারণে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত হয়ে সারা বিশ্বে প্রতিবছর সাত লাখ ২৫ হাজারেরও বেশি মানুষ অকালে প্রাণ হারাচ্ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মানুষ মারা যায় ম্যালেরিয়া এবং ডেঙ্গুতে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বলছে, শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বের প্রায় ২৫ কোটি মানুষ মশাবাহিত ম্যালেরিয়া রোগে আক্রান্ত হন, যাদের বড় অংশই আফ্রিকা অঞ্চলের। এদের মধ্যে প্রাণ হারান ছয় লাখেরও বেশি মানুষ।
অন্যদিকে, ২০২৩ সালে বিভিন্ন দেশে ৫০ লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে পাঁচ হাজারেরও বেশি মানুষ মারা গেছেন।
গত কয়েক দশকে বাংলাদেশেও বেশ কয়েকবার ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা গেছে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে দেশটির ইতিহাসে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছে এবং মারা গেছে।
সরকারি হিসেবে, গত বছর সারা দেশে তিন লাখেরও বেশি মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হন, যাদের মধ্যে মৃত্যুবরণকারীর সংখ্যা দেড় হাজারেরও বেশি।
সূত্র: বিবিসি