রাজধানী ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ সংসদীয় আসন বলা হয় ঢাকা-১৮কে। ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের বিমানবন্দর ও খিলক্ষেত এলাকার ১, ১৭, ৪৩, ৪৪, ৪৫, ৪৬, ৪৭, ৪৮, ৪৯, ৫০, ৫১, ৫২, ৫৩ ও ৫৪ নম্বর ওয়ার্ড নিয়ে গঠিত এই আসনটি। ১৪টি ওয়ার্ডের ২১৭টি কেন্দ্রে মোট ৫ লাখ ৮৮ হাজার ৬০৮জন ভোটার রয়েছেন এই আসনে। এ হিসাব চলতি মাসের ১ তারিখ পর্যন্ত। এর মধ্যে পুরুষ ভোটার ৩ লাখ ১ হাজার ৯০৯ এবং নারী ভোটার রয়েছেন ২ লাখ ৮৬ হাজার ৬৯৩ জন। তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছেন আরও ৬জন।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে গুরুত্বপূর্ণ এ আসন থেকে নির্বাচন করছেন ১০ জন প্রার্থী। তারা হলেন- শেরীফা কাদের, জাতীয় পার্টি (লাঙ্গল), মো. খসরু চৌধুরী স্বতন্ত্র (কেটলি), এস এম তোফাজ্জল হোসেন স্বতন্ত্র (ট্রাক), দয়াল কুমার বড়ুয়া বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি (হাত ঘড়ি), এস এম আবুল কালাম আজাদ বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি (বিএনএফ)(টেলিভিশন), ফাহমিদা হক সুকন্যা বাংলাদেশ সাংস্কৃতিক মুক্তি জোট (ছড়ি), মোহাম্মদ মফিজুর রহমান, তৃণমুল বিএনপি (সোনালী আঁশ), মো. জাকির হোসেন ভূইঁয়া ন্যাশনাল পিপলস পার্টি (এনপিপি) (আম), মো. নাজিম উদ্দিন স্বতন্ত্র (মোড়া) ও মো. বশির উদ্দিন স্বতন্ত্র (ঈগল)।
এবারের নির্বাচনে আসনটি কার দখলে যাচ্ছে, তা নিয়ে জোর আলোচনা চলছে ভোটারসহ রাজনীতি সচেতন বিভিন্ন মানুষের মাঝে। আসনটিতে নৌকার কোনো প্রার্থী নেই। এ কারণে ভোটের আলোচনায় প্রতিদিন যুক্ত হচ্ছে নতুন নতুন গল্প। চলছে নানা জল্পনা-কল্পনা। ‘ভোটে নাকি জোটে’ এই হিসেবই নাকি এই আসনের এবারের মেরুকরণ। তবু সব জটিলতা নিয়েই মাঠে নিজেদের অবস্থান শক্ত করতে মরিয়া হয়ে চেষ্টা চালাচ্ছে প্রার্থীরা।
সাধারণ ভোটারদের ভাষ্য, ঢাকার এ আসন অনেক গুরুত্বপূর্ণ। ঠিক যতটাই গুরুত্বপূর্ণ আবার ততোটাই অবহেলিত এ আসনের মানুষ। বছরের পর বছর পার হলেও পরিবর্তন হয়নি এখানকার রাস্তাঘাট। হয়নি জীবনমানের উন্নয়ন। নেই কোনো সরকারি হাসপাতাল কিংবা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। নতুন প্রার্থীরা ভোটারদের কাছে গিয়ে এসব সমস্যার সমাধান ও এলাকার মানুষের জীবনমান উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিলেও বাস্তবে তা কতটুকু ফলপ্রসু হবে তাই দেখার বিষয়।
জানা গেছে, এই আসনের কাণ্ডারি ছিলেন প্রয়াত সাবেক স্বরাষ্ট্র, ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী সাহারা খাতুন। একাধারে তিনি ছিলেন, ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের নীতি নির্ধারকও। ২০২০ সালের ৯ জুলাই সাহারা খাতুনের মৃত্যু হলে আসনটি শূন্য ঘোষণা করা হয়। এরপর ১২ নভেম্বর উপ-নির্বাচনে নৌকা প্রতীক নিয়ে ৭৫ হাজার ৮২০ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের প্রার্থী মোহাম্মদ হাবিব হাসান। এরপর থেকে দায়িত্ব পালন করছেন তিনি।
স্থানীয় নেতাকর্মীরা জানান, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে প্রথমে এ আসনে নৌকার টিকিট পেয়েছিলেন বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান। কিন্তু জোটের মারপ্যাচে ও দলের বৃহত্তর স্বার্থে ভোটের মাঠ থেকে সরে আসতে হয় তাকে। এরপর নৌকা প্রতীক শূন্য হয় আসনটি। এতে যুক্ত হন মহাজোটের প্রার্থী জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান গোলাম মোহাম্মদ (জিএম) কাদেরের সহধর্মিণী শেরীফা কাদের। তিনি লড়ছেন লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মীরা নৌকা হারিয়ে যখন হতাশায়, তখনই ক্ষমতাসীন দলের সমর্থকদের সরব করে তুলেছেন স্বতন্ত্র প্রার্থীরা। নৌকা প্রতীকে প্রার্থী না থাকায় তারা মাঠে নেমেছে পছন্দের স্বতন্ত্র প্রার্থীর জন্য। তবে এ প্রচার-প্রচারণা একতরফা চলতে শুরু করলে ঠিক তখনই বর্তমান এমপি হাবিব হাসানের সমর্থকরা দুই ভাগে বিভক্ত হয় স্বতন্ত্র দুই প্রার্থীকে সমর্থন দেয়। দুই পক্ষের প্রচার-প্রচারণায় হাড্ডাহাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিচ্ছে স্থানীয় ভোটাররা।
স্থানীয় ভোটারদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, এখন পর্যন্ত ভোটের মাঠে এগিয়ে আছেন কেটলি মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী মো. খসরু চৌধুরি ও ট্রাক মার্কার স্বতন্ত্র প্রার্থী এস এম তোফাজ্জল হোসেন। ভোটারদের মতে, এই দুই প্রার্থীর মধ্যেই মূলত হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে। দুজনের একজন সামান্য ভোটের ব্যবধানেই জয়ী হবেন।
এদিকে, মহাজোটের কাউকে পাশে না পেয়ে নিজ দলের নেতাকর্মীদের নিয়ে নীরবে প্রচার চালিয়ে যাচ্ছেন জাতীয় পার্টির লাঙ্গল মার্কার প্রার্থী শেরীফা কাদের। আবার পিছিয়ে নেই বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি হাতঘড়ি মার্কার প্রার্থী দয়াল কুমার বড়ুয়াও। তিনিও বিভিন্ন এলাকায় চালিয়ে যাচ্ছেন প্রচার-প্রচারণা। দিচ্ছেন উন্নয়নের নানা প্রতিশ্রুতি। তিনি টার্গেট করেছেন হিন্দু, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও সাধারণ ভোটারদের। সঙ্গে রয়েছেন এলিট শ্রেণির ভোটারও। এছাড়া, অন্য প্রার্থীদের এখনো তেমন চোখে পড়েনি ভোটারদের।
জানতে চাইলে কেটলি প্রতীক প্রার্থীর নির্বাচনী এজেন্ট ৫২ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের সভাপতি পদ প্রত্যাশী সোহেল মিয়া সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সবার আগে ভোটের মাঠ নিজেদের দখলে নিয়েছেন খসরু চৌধুরী। কোনো দিক থেকে পিছিয়ে নেই তারা। দক্ষিণখান ও উত্তরখান এলাকায় তার রয়েছে ব্যবসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ফসলি জমি ও বাসাবাড়ি। পাশে দাঁড়িয়েছেন উত্তরার হেভিওয়েট নেতাও জনপ্রতিনিধিরা সেই দিক থেকে তিনিও এগিয়ে।” এরই মধ্যে ঢাকা-১৮ আসনে জনপ্রিয়তার শীর্ষে রয়েছেন বলে দাবি করছেন তার নেতাকর্মীরা। ৭ তারিখেই ভোটের মধ্য দিয়ে জবাব দিতে চান তারা।
ট্রাক মার্কার প্রার্থীর নিবেদিত কর্মী মো. ইকবাল হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “তোফাজ্জল হোসেন এ আসনের স্থানীয় প্রার্থী ও সাবেক ইউপি চেয়ারম্যার ছিলেন। সেই দিক থেকে স্থানীয় ভোটগুলো প্রত্যাশা করছেন।”
দক্ষিণখান, উত্তরখান, তুরাগ ও খিলক্ষেতের স্থানীয় ভোটারদের টার্গেট করে এগুচ্ছেন এই প্রার্থীর কর্মী সমর্থকরা। তাকে সমর্থন দিয়েছেন বর্তমান সংসদ সদস্য মোহাম্মদ হাবিব হাসান। এতে, তারা জয় প্রত্যাশা করছেন।
একটি সূত্র বলছে, ঢাকা- ১৮ আসনের প্রতিনিধিত্ব করতে মাঠে নিজেদের অবস্থান জানান দিতে দিন রাত প্রচার-প্রচারণা চালালেও এর মধ্যে একটি শঙ্কা কাজ করছে নেতাকর্মীদের মাঝে। তা হলো- ঘোষণায় প্রতিনিধিত্ব বাছাইয়ের। কারণ, নৌকা প্রার্থী সরিয়ে নিয়ে মহাজোটের প্রার্থীর সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে। ঢাকার সব আসনের মধ্যে এ আসনেই মহাজোটের প্রার্থী দেওয়ায় এ শঙ্কা তৈরি হয়েছে নেতাকর্মীদের মাঝে।
জাতীয় পার্টির নেতাকর্মীদের ভাষ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এ আসন মহাজোটের প্রার্থী শেরীফা কাদেরকে উপহার দিয়েছেন। সেজন্যই নৌকার প্রার্থী দেওয়া হয়নি। এটা সহজ হিসাব। ভোটের মাঠ অংশগ্রহণমূলক ও সরগরম রাখতেই রাখা হয়েছে স্বতন্ত্র বা ডামী প্রার্থী।
সরেজমিনে দেখা যায়, প্রচার-প্রচারণায় আচরণবিধি নিয়ে নির্বাচন কমিশন (ইসি) থেকে নির্দেশনা দেওয়া হলেও তা মানছেন না প্রার্থীরা। ভোটার প্রতি ১০ টাকা খরচ করার কথা থাকলেও প্রার্থীরা সেটা মানছে না। আবার দুপুর ২টার পর থেকে রাত ১০টা পর্যন্ত প্রচার-প্রচারণার কথা থাকলেও প্রার্থীরা সকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন তাদের প্রচার কাজ। এছাড়াও যেখানে সেখানে পোস্টারও লাগানো হয়েছে।
তবে এ আসনের নির্বাচনী গণসংযোগ নজর কাড়ছে সবার। কারণ, প্রার্থীদের প্রচার-প্রচারণায় যেসব লোকবল চোখে পড়ছে এগুলোর মধ্যে ভোটার হয়নি এমন মানুষের সংখ্যাই বেশি। উঠতি বয়সের কিশোরদের নিয়ে দলভাড়ি করে নেতাকর্মীরা প্রচার চালাচ্ছে।