অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করা নিয়ে সেনাপ্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের আপত্তি ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া।
জাতীয় নাগরিক পার্টির দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহর গত বৃহস্পতিবার রাতে দেওয়া একটি ফেসবুক পোস্টকে ঘিরে রাজনৈতিক অঙ্গনে চলছে নানা আলোচনা। এর মধ্যেই গতকাল শুক্রবার দুপুরে উপদেষ্টা আসিফ তার ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজে এ বিষয়ে একটি ভিডিও পোস্ট করেন। তাতে তুলে ধরেন ড. ইউনূসকে নিয়ে সেনাপ্রধানের আপত্তির বিষয়টি। ওই ভিডিওতে জুলাই অভ্যুত্থানের নানা বিষয় নিয়ে কথা বলেছেন জুলাই আন্দোলনের এই অগ্রসৈনিক।
ড. ইউনূসকে নিয়ে সেনাপ্রধানের আপত্তির বিষয়ে ভিডিওতে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, সেনাপ্রধানের দিক থেকে মূল ভেটোটা ছিল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে ড. মুহাম্মদ ইউনূস কেন? অন্য কেউ না কেন? ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নামে মামলা আছে। তিনি একজন দোষী ব্যক্তি। একটা কনভিকটেড পারসন আসলে কীভাবে দেশের উপদেষ্টা হতে পারে? আওয়ামী লীগ একটা লোককে একেবারে দেখতে পারছে না এবং বাংলাদেশে আলটিমেটলি ৩০-৪০ শতাংশ মানুষ আওয়ামী লীগকে সমর্থন করে। এই ৩০-৪০ শতাংশ লোকের মতামতের বিরুদ্ধে গিয়ে একটা লোককে প্রধান উপদেষ্টা করা উচিত? সেনাপ্রধান আমাদের লাস্ট বলেছিল আমি বুকে পাথরচাপা দিয়ে এই সিদ্ধান্তটা মেনে নিচ্ছি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা বলেন, যখন থেকে আমরা অটল ছিলাম যে, শেখ হাসিনাকে চলে যেতে হবে। তারপর কী হবে? শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর আমরা তো দেশটাকে ছেড়ে দিতে পারি না। এই চিন্তাটা আস্তে আস্তে আসতে থাকে। আমাদের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনাটা করতে হতো। কিন্তু ওই সময় এটা বিশ্বাস করা কঠিন ছিল যে, ৫ তারিখের (৫ আগস্ট) মধ্যে হয়ে যাবে। ৫ তারিখ যদি আমরা সফল না হতাম, হয়তো আমরা অস্ত্র তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিতাম। আমাদের সশস্ত্র অভ্যুত্থানের চিন্তাও ছিল। নাহিদ ভাই ভিডিওবার্তা রেডি রেখেছিল, আমিও কী ঘোষণা দিব সেটা রেডি ছিল। তবে এর আগে আমরা অনুভব করি যে, শেখ হাসিনা চলে যাওয়ার পর দেশটার কী হবে?
সাক্ষাৎকারে উপদেষ্টা আসিফ বলেন, এটা কোনো কালেকটিভ ডিসিশন ছিল না ড. ইউনূসকে আমরা প্রধান উপদেষ্টা বানাব। তখন মূলত অ্যামেরিকান অ্যাম্বাসির কয়েকজনের সঙ্গে আমার যোগাযোগ হচ্ছিল। এর পাশাপাশি ছাত্রদলের সাবেক এক বড় ভাই আছে শামীম ভাই (আশিক)। উনি মিরপুরে অর্গানাইজার হিসেবে খুব ভালো ভূমিকা পালন করেছিল। উনার যোগাযোগ ছিল মূলত মুশফিকুল ফজল আনসারীদের সঙ্গে। ১ তারিখ (আগস্ট) যখন আমাদের ডিবি থেকে ছেড়ে দেওয়া হয়, তখন উনার মাধ্যমে আমদের ড. আলী রীয়াজ, বদিউল আলম মজুমদার স্যারদের সঙ্গে প্রাথমিক কথা হয়। দুই তারিখ মূলত আসল কথাবার্তা শুরু হয়। তখন আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ড. মুহাম্মদ ইউনূস আসবেন কি না— যদি আমরা আহ্বান করি। তবে সবার একটি কথা ছিল, উনি আসবেন না। এর আগেও তাকে আহ্বান করা হয়েছে কিন্তু পলিটিক্যালি তিনি রিফিউজ করেছেন। কিন্তু আমি সরাসরি উনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। তখন শামিম ভাই (আশিক) উনার বর্তমান পিএস সাব্বির ভাইয়ের নাম্বার দেন। সাব্বির ভাই বলেন, আমি তো স্যারের সঙ্গে নেই। তখন মঈন চৌধুরী নামে একজন স্যারের প্রাইভেট সেক্রেটারি হিসেবে কাজ করছিলেন। সাব্বির ভাই আমাকে তার নাম্বার দেন। তখন আমি মঈন চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করি ২ কিংবা ৩ তারিখ। উনি বলেছিলেন স্যারের একটি ছোট সার্জারি আছে। স্যার তখন ফ্রান্সে ছিলেন। পরবর্তীতে আমি তাকে মেসেজগুলো ক্লিয়ার করার চেষ্টা করি, আমরা চাচ্ছি এমনটা। উনি স্যারের সঙ্গে কথা বলেন। স্যার আমাদের একটি মেসেজ পাঠান যে, তোমরা যেটা করতেছো আমি তোমাদের সঙ্গে আছি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা আরও বলেন, আমি বারবার ইনসিস্ট করছিলাম সরাসরি কথা বলতে (ড. ইউনূসের সঙ্গে সরাসরি কথা বলতে)। সবাই নিরুৎসাহিত করছিল আদারস অপশন দেখার জন্য। প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অনেক নাম আসতেছিল। কিন্তু আমার চিন্তাটা ছিল যে, আমাদের যে অর্থনৈতিক ভঙ্গুর পরিস্থিতি, তারপর একটা বিশেষ পরিস্থিতিতে সরকার গঠন করলে সেটার জাতীয়-আন্তর্জাতিক স্বীকৃতির ব্যাপার আছে। এগুলো ড. মুহাম্মদ ইউনূস ছাড়া আসলে পসিবল হবে না। সেই জায়গা থেকে আমি বারবার কথা বলার চেষ্টা করি। পরে মঈন চৌধুরী স্যারের সঙ্গে কথা বলিয়ে দেন। স্যারকে অ্যাপ্রোচ করার পর উনি বলেন, তোমরা অন্য কাউকে ভাবো। এটা সম্ভবত ৩ তারিখ। স্যার কয়েকজনের নামও বললেন যে, তোমরা উনাদের ভাবতে পারো। এরমধ্যে দুই-একজন আমাদের উপদেষ্টা পরিষদেও আছে এখন। স্যার বললেন, আমার লাইফটা তো ভিন্ন (ডিফারেন্ট), আমি ওই জায়গা থেকে আসব কি না। আমি যখন বললাম, স্যার আপনাকে ছাড়া হবে না, আপনাকে আসতেই হবে। তখন উনি বললেন, আমি ভেবে দেখি, তোমরাও ভাবো।
আসিফ মাহমুদ বলেন, ৩ তারিখ তো অনেক কিছু অনিশ্চিত ছিল। এক দফা শুধু ঘোষণা হয়েছে। কবে পতন হবে এটা আনসারটেইন ছিল। আমার মনে হয় এটাও ডিসিশন নেওয়ার ক্ষেত্রে সে সময় বাধা ছিল। কিন্তু আমার মনে হচ্ছিল উনি অস্বীকার করলেও কিছুটা পজিটিভ। আমি নাহিদ ভাই ও মাহফুজ ভাইকে জানিয়ে রাখি যে, উনার সঙ্গে যোগাযোগ হচ্ছে, দেখি এটা কোথায় যায়।
আসিফ মাহমুদ আরো বলেন, ৫ তারিখে স্যারের সঙ্গে আবার কথা হয় যখন শেখ হাসিনা পালিয়ে গেল, আমরা তখন চ্যানেল ২৪-এর অফিসে। আমি তখন বলতে চাই যে, এখন তো পতন হয়ে গেছে, একটা ডিসিশনে আসতে হবে। তখন মঈন ভাই স্যারের সঙ্গে আমাদের কলে যুক্ত করেন। নাহিদ ভাই এবং আমি আমার ফোন থেকেই লাউড স্পিকারে কথা বলি। স্যারকে আমরা বলি, স্যার এখন একটা ডিসিশনে আসতে হবে। স্যার তখন এক ধরনের মৌন সম্মতি দিলেন যে, আমি আসব। বিস্তারিত কথা বলার আগে উনি ঘোষণা না দেওয়ার আহ্বান জানান। সেদিন রাতে আবার নাহিদ ভাই ও আমি ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে দুই ঘণ্টা কথা বলি।
স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের এই উপদেষ্টা আরো বলেন, সেখানে আমরা বিস্তারিত আলোচনা করি। স্যারের কিছু কনসার্ন ছিল, সেগুলো আমরা আলোচনা করি– এইটা আবার এক-এগারোর মতো একটা সরকার হবে কি না। স্যারের কনসার্ন ছিল, আমরা ক্ষমতায় বসব আর পেছন থেকে আর্মি আমাদের চালাবে কি না। আসলে এই স্বাধীনতা দিতে হবে যে, পেছন থেকে কেউ রান করবে না। আমরা বলি যে, গভর্নমেন্ট যদি আমরা ফর্ম করি তাহলে স্বাধীনভাবে কাজ করতে হবে। সেনাবাহিনী বা অন্য কেউ যদি হস্তক্ষেপ করতে চায়, সেক্ষত্রে আমরা মাঠ থেকে চ্যালেঞ্জ করব; এ ধরনের একটা নিশ্চয়তা আমরা স্যারকে দিই।