• ঢাকা
  • মঙ্গলবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১, ১৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৬

এক মাসে যেসব অর্জন, সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ অন্তর্বর্তী সরকারের


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৮, ২০২৪, ১১:১৬ এএম
এক মাসে যেসব অর্জন, সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ অন্তর্বর্তী সরকারের

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের মুখে ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন হয়। তিন দিন পর ৮ আগস্ট নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে প্রধান উপদেষ্টা করে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়। প্রধান উপদেষ্টাসহ এ সরকারের সদস্যসংখ্যা ২১। এ ছাড়া প্রধান উপদেষ্টার দুজন বিশেষ সহকারী, একজন আন্তর্জাতিকবিষয়ক বিশেষ দূত আছেন। মানবাধিকার, অর্থনীতি, প্রশাসন, পুলিশ ও আইনশৃঙ্খলাসহ নানা ক্ষেত্রে বেশ কিছু সিদ্ধান্ত, পদক্ষেপসহ বিভিন্ন ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। 

এক মাসে উল্লেখযোগ্য বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে :

মানবাধিকার
১ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমন করতে যেসব ফৌজদারি মামলা হয়েছে, সেগুলো প্রত্যাহারের সিদ্ধান্ত হয়েছে। সন্ত্রাস দমন আইন এবং সাইবার নিরাপত্তা আইনে করা মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলাগুলো দ্রুত প্রত্যাহারের ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহতের ঘটনা জাতিসংঘের মাধ্যমে তদন্তের সিদ্ধান্ত হয়। আর গুমের ঘটনা তদন্তে কমিশন গঠিত হয়। গুমবিরোধী আন্তর্জাতিক সনদে স্বাক্ষর করে বাংলাদেশ।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে অংশ নিয়ে যাঁরা হতাহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের সদস্যদের দেখভালের জন্য সরকার একটি ফাউন্ডেশন গঠনের সিদ্ধান্ত নেয়। সংযুক্ত আরব আমিরাতে বিক্ষোভের ঘটনায় সাজাপ্রাপ্ত ৫৭ বাংলাদেশির সবাইকে আমিরাতের প্রেসিডেন্ট ক্ষমা করে দেন। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের অনুরোধে এই ক্ষমা করার কথা জানায় সরকার।

সংসদ, আদালত-ইসি
৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন। ২ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী পদত্যাগ করেন। ১০ আগস্ট প্রধান বিচারপতি ওবায়দুল হাসান এবং আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতি পদত্যাগ করেন। একই দিনে প্রধান বিচারপতি হিসেবে নিয়োগ পান হাইকোর্ট বিভাগের বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ। তার আগে ৮ আগস্ট সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী মো. আসাদুজ্জামানকে অ্যাটর্নি জেনারেল হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। ৫ সেপ্টেম্বর প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন পদত্যাগ করেন।

রাজনীতি
৬ আগস্ট বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে নির্বাহী আদেশে মুক্তি দেওয়া হয়। ২৮ আগস্ট জামায়াতে ইসলামী ও এর অঙ্গসংগঠনকে নিষিদ্ধ করে জারি করা প্রজ্ঞাপন বাতিল করা হয়। ৫ সেপ্টেম্বর সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, বিচার শেষ না হওয়া পর্যন্ত ফ্যাসিবাদী দল ও জোট পুনর্বাসনের সুযোগ পাবে না।

আর্থিক খাত ও দুর্নীতি দমন
১০ ব্যাংক ও এক আর্থিক প্রতিষ্ঠানের পরিচালনা পর্ষদ পুনর্গঠন করা হয়েছে। এর মধ্যে নয়টির মালিকানা এস আলম গ্রুপের। সাবেক মন্ত্রী, সংসদ সদস্য ও আওয়ামীপন্থী ব্যবসায়ী, পুলিশ ও সেনা কর্মকর্তাদের অনেকের ব্যাংক হিসাব স্থগিত করা হয়েছে। ডলারের দাম আরও বাজারভিত্তিক করা হয়েছে। মোবাইলে আর্থিক সেবা নগদের পরিচালনা ও ব্যবস্থাপনা পর্ষদ বাতিল করে প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। শেয়ারবাজারে বেক্সিমকো, লা মেরিডিয়ান হোটেলসহ ১২ প্রতিষ্ঠানের অনিয়ম-দুর্নীতি তদন্তে কমিটি গঠন করা হয়েছে। বেক্সিমকো গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ ও চৌধুরী নাফিজ সরাফাতের বিরুদ্ধে অর্থ পাচারে অভিযোগ অনুসন্ধান করছে সিআইডি। আওয়ামী সরকারের প্রভাবশালীদের বিষয়ে অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবস্থার ওপর শ্বেতপত্র প্রণয়ন কমিটি গঠন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকে নতুন গভর্নর নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।

প্রশাসন ও স্থানীয় সরকার
১৯ আগস্ট সব উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, সিটি করপোরেশন ও পৌরসভার মেয়রদের অপসারণ ও প্রশাসক নিয়োগ করা হয়। ১২ আগস্ট বিভিন্ন পদে থাকা চুক্তিভিত্তিক সব নিয়োগ বাতিলের সিদ্ধান্ত হয়। পরে তা কার্যকর করা হয়। আবার প্রশাসনে নতুন করে চুক্তিভিত্তিতে নিয়োগও দেওয়া হয়।

সব সরকারি কর্মচারীকে সম্পদের হিসাব দেওয়ার সিদ্ধান্ত হয় ১ সেপ্টেম্বর। জনপ্রশাসন ও পুলিশের শীর্ষ পদগুলোতে পরিবর্তন এসেছে। উপসচিব, যুগ্ম সচিব ও অতিরিক্ত সচিব পদে পদোন্নতি। ২৫ ডিসিকে প্রত্যাহার।

আইনশৃঙ্খলা
গণ–আন্দোলনে হতাহতের ঘটনায় সাবেক মন্ত্রী–উপদেষ্টা, সংসদ সদস্য, পুলিশ কর্মকর্তাসহ ২৪ জন গ্রেপ্তার হয়েছেন। অস্ত্র উদ্ধারে ৪ সেপ্টেম্বর থেকে বিশেষ অভিযান শুরু হয়েছে।

বিদ্যুৎ ও জ্বালানি
বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য নির্ধারণ হবে গণশুনানির মাধ্যমে, নির্বাহী আদেশে নয়। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের চুক্তি পর্যালোচনায় কমিটি গঠন হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি (বিশেষ বিধান) আইন, ২০১০–এর আওতায় নতুন কোনো চুক্তি হবে না।

স্বাস্থ্য খাত
আন্দোলনে আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পরিবারকে সহায়তা দিতে কমিটি করা হয়েছে। স্বাস্থ্যব্যবস্থার বিষয়ভিত্তিক সংস্কার, চিকিৎসাসেবার গুণগত মানোন্নয়ন, স্বাস্থ্যব্যবস্থার কাঠামো শক্তিশালীকরণে ১২ সদস্যের বিশেষজ্ঞ কমিটি গঠন করে ৩ সেপ্টেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি।

শিক্ষা খাত
বিদ্যালয়গুলোতে শিক্ষা কার্যক্রম শুরু হয়েছে। ১ সেপ্টেম্বর শিক্ষাক্রম নিয়ে নির্দেশনা দিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এতে মাধ্যমিকে আবারও ফিরছে বিজ্ঞান, মানবিক ও ব্যবসায় শিক্ষা। তবে উচ্চশিক্ষায় স্থবিরতা কাটেনি। ইউজিসি চেয়ারম্যান এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সাত বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিয়োগ। শিক্ষকদের জোর করে পদত্যাগ ও হেনস্তা বন্ধের আহ্বান জানান শিক্ষা উপদেষ্টা। ২০ আগস্ট বাংলাদেশ সচিবালয়ের ভেতরে শিক্ষার্থীদের বিক্ষোভের মুখে এইচএসসি ও সমমানের স্থগিত পরীক্ষাগুলো বাতিল করে সরকার।

পরিবেশ
রামুর সংরক্ষিত বনে বাফুফের টেকনিক্যাল সেন্টার নির্মাণের উদ্যোগ বাতিল করা হয়েছে। দুই মাসের মধ্যে নদীর পূর্ণাঙ্গ তালিকা করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এ ছাড়া ৬৪ জেলায় অন্তত ৬৪টি নদী চিহ্নিত করে নদীর অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করতে করার সিদ্ধান্ত হয়েছে।

ক্রীড়াঙ্গন
২১ আগস্ট বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের (বিসিবি) সভাপতি পদে পরিবর্তন এসেছে। এদিন বিসিবি সভাপতির পদ ছাড়েন সাবেক মন্ত্রী নাজমুল হাসান। একই দিনে বিসিবির সভাপতি হন জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক অধিনায়ক ফারুক আহমেদ। এ ছাড়া আরও কয়েকটি ক্রীড়া ফেডারেশনের সভাপতিকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে।

নির্বাহী আদেশ ও সিদ্ধান্ত
৫ সেপ্টেম্বর গণভবনকে ‘জুলাই গণ-অভ্যুত্থান স্মৃতি জাদুঘর’ করার সিদ্ধান্ত হয়েছে। ২৯ আগস্ট ‘জাতির পিতার পরিবার-সদস্যগণের নিরাপত্তা (রহিতকরণ) অধ্যাদেশ, ২০২৪’ -এর খসড়া অনুমোদন দেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা পরিষদ। এর ফলে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ বঙ্গবন্ধু পরিবারের সদস্যরা বিশেষ নিরাপত্তাসুবিধা পাবেন না।

১৩ আগস্ট উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে ১৫ আগস্ট জাতীয় শোক দিবসের সাধারণ ছুটি বাতিল করা হয়। ৪ সেপ্টেম্বর সরকারি অর্থে প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান বা স্থাপনার নামকরণের বিষয়ে আইনি কাঠামো ঠিক করতে উপদেষ্টা কমিটি গঠন করা হয়েছে। একই দিনে সরকারের সব পর্যায়ে সংস্কার কর্মসূচি গ্রহণ করতে সচিবদের নির্দেশ দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস।

সামনে যেসব চ্যালেঞ্জ

অর্থনীতিকে স্থিতিশীল রাখা নতুন সরকারের অন্যতম বড় চ্যালেঞ্জ। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনবিআর চেয়ারম্যান থেকে শুরু করে বেশিরভাগ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানের কর্তাব্যক্তিদের সরিয়ে নতুন নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এছাড়া ভোক্তাদের কষ্ট কমাতে নিত্যপণ্যের আমদানি শুল্ক কমিয়েছে সরকার।

অর্থ ও বাণিজ্য উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, খেলাপি ঋণের ব্যাপারে অ্যাকশন নেয়া হচ্ছে। যেসব ব্যাংকে সমস্যা আছে, সেগুলো পুনর্গঠন করা হচ্ছে। তারল্য সংকট সমাধান করা হচ্ছে। আমরা ইতোমধ্যেই বলে দিয়েছি, অর্থ আনার জন্য একটা টাস্কফোর্স হবে। তারপরে সংস্কারের ব্যাপারে কথা বলছি।

সারা দেশের স্থানীয় জনপ্রতিধিদের সরিয়ে বসানো হয়েছে নতুন প্রশাসক। সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, দীর্ঘদিনের অচলায়তন কাটাতে কিছুটা সময় লাগবে।

শ্রম ও কর্মসংস্থান উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ বলেন, জনগণ আমাদেরকে দিয়ে কোন কোন সংস্কার করাতে চায়, সেই জায়গা থেকেই সময়টা নির্ধারণ হবে। এর জন্য যতটুকু সময় প্রয়োজন, ততটুকু সময় আমরা নেব।

আন্দোলনের ফলস্বরূপ গঠিত নতুন সরকার নিজেরা গত মাসে অনেকগুলো আন্দোলনের মুখোমুখি হয়েছে। সংখ্যালঘু নিরাপত্তা আন্দোলন, এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল, পোশাক শ্রমিক আন্দোলন, রিকশাওয়ালা ও ডাক্তাররা নানা দাবিতে নেমেছিল আন্দোলনে। সরকারের সঙ্গে আলোচনায় সেগুলো সুরাহা হয়। তবে বেগতিক দিকে মোড় নেয় আনসার আন্দোলন। শিক্ষার্থীরা মুখোমুখি হয়ে সে আন্দোলন প্রতিহত করে। 

তবে আন্দোলনের মাঠ থেকে উপদেষ্টা হওয়া আসিফ মাহমুদ বলছেন, আলোচনার মাধ্যমে সুরাহা করাই সরকারের প্রধান লক্ষ্য।

তিনি বলেন, ১৬ বছর ধরে দেশের মানুষ শ্বাসরুদ্ধকর অবস্থার মধ্যে ছিল। কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। এখন একটা গণতান্ত্রিক পরিবেশ তৈরি হয়েছে; জনগণের সরকার গঠন হয়েছে। তাই মানুষ তাদের আকাঙ্ক্ষা এবং বঞ্চনার জায়গা থেকে কথা বলছেন। সেটাকে আমরা অবশ্যই সাধুবাদ জানাই। সরকারের সব সময় প্রথম অগ্রাধিকার হবে আলোচনা করা। সংবিধান থেকে শুরু করে প্রতিটি সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের সংস্কারের কাজ করা হবে।

সামনের দিনে সংবিধান সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে এই সরকারের কাছে। অচিরেই রাষ্ট্র সংস্কারের রূপরেখা দেওয়া হবে অন্তর্বর্তী সরকারের পক্ষ থেকে।

জাতীয় বিভাগের আরো খবর

Link copied!