সময়টা শ্রাবণের মাঝামাঝি। সকাল থেকেই ঝিরি ঝিরি বৃষ্টি। যানজট পেরিয়ে ধানমন্ডি ৩২-এর সেই বাড়িটির সামনে যখন দাঁড়ালাম, তখন মনে হলো গোটা ইতিহাস দাঁড়িয়ে রয়েছে সামনে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এক ইতিহাসের নাম। তাঁর বুকেই বাংলাদেশের মানচিত্র আঁকা। জাতির পিতা তিনি। বাঙালিকে এনে দিয়েছেন মুক্তির স্বাদ।
বঙ্গবন্ধু স্মৃতি জাদুঘরে প্রবেশের আগে টিকিট কাউন্টার থেকে টিকিট কাটতে হয়। জনপ্রতি ৫ টাকা। কাউন্টারেই দর্শনার্থীর ব্যাগ ও মোবাইল ফোন রাখতে হয়।
কাউন্টারে সব রেখে হাঁটতে শুরু করলাম মূল গেটের দিকে। প্রবেশ করলাম ঐতিহাসিক সেই বাড়ির আঙিনায়। সামনেই দাঁড়িয়ে আছে তিন তলাবিশিষ্ট বঙ্গবন্ধুর বাড়ি। তবে আমরা যাব নতুন সম্প্রসারিত ভবনে। মূল বাড়ির রান্নাঘর পেরিয়ে একটি ছয়তলা ভবনের সামনে এসে দাঁড়ালাম। বাড়ির গাঠনিক শৈলীতে আধুনিক স্থাপত্যের ছোঁয়া স্পষ্ট।
শুরুতেই বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল চোখে পড়ল। এই ভবনটির নাম দেওয়া হয়েছে ‘শেখ লুৎফর রহমান ও শেখ সায়েরা খাতুন প্রদর্শনী গ্যালারি’। ভেতরে প্রবেশ করলে চোখে পড়বে হাতের ডানে লিফট ও বাঁয়ে সিঁড়ি। নির্দেশনা অনুযায়ী লিফটের ৩ অর্থাৎ চতুর্থ তলা থেকে ধারাবাহিকভাবে তৃতীয় ও দ্বিতীয় তলায় যেতে হবে। লিফটে চড়ে চতুর্থ তলায় পৌঁছালাম। সেখানে লেখা ‘প্রদর্শনী গ্যালারি-১’। ভেতরে প্রবেশের শুরুতেই দেখলাম বঙ্গবন্ধুর কিছু উক্তি স্বচ্ছ কাচের ফলকে লেখা। এর মধ্যে একটি লেখায় চোখ আটকে গেল, যেখানে লেখা, “আমার জীবনের একমাত্র কামনা বাংলাদেশের মানুষ যেন তাদের খাদ্য পায়, আশ্রয় পায় এবং উন্নত জীবনের অধিকারী হয়”। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের এমন উক্তিই প্রকাশ করে বাংলার মানুষের জীবন মান নিয়ে কতটা সচেতন ছিলেন তিনি।
এর একটু সামনে এগোলেই দেখা যাবে মুজিব পরিবারের বংশপরিচয়ের একটি বংশতালিকা। সেখানে শেখ লুৎফুর রহমান থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সবার নাম রয়েছে। তার পরেই আছে বঙ্গবন্ধুর বাল্যকালের ছবি। তাঁর ছাত্রজীবনের ছবিসহ বর্ণনা রয়েছে সেখানে। ফলকে লেখা আছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি।
বঙ্গবন্ধুর পরিচিতি
জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯২০ সালের ১৭ মার্চে, তৎকালীন ফরিদপুর জেলার গোপালগঞ্জ মহকুমার টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। শেখ লুৎফর রহমান ও সাহারা খাতুনের চার কন্যা ও দুই পুত্রের মধ্যে তৃতীয় সন্তান শেখ মুজিবুর রহমান। বাবা-মা আদর করে খোকা বলে ডাকতেন। ১৪ বছর বয়সে চক্ষুরোগের কারণে তাঁর লেখাপড়ার সাময়িক বিরতি ঘটে। এরপর ১৮ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধু ও বেগম ফজিলাতুন্নেছা আনুষ্ঠানিক বিয়ে করেন। তাঁদের দুই কন্যা শেখ হাসিনা, শেখ রেহানা ও তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল ও শেখ রাসেল।
কৈশোর বয়স থেকেই বিপ্লবী ছিলেন শেখ মুজিব। ছাত্র বয়সেই তিনি সক্রিয় রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন এবং মুসলিম লীগের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। এরপর একে একে ইতিহাস গড়ে তোলেন শেখ মুজিব।
এই ফ্লোরে আরও আছে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস, আছে শহীদদের কথা। এখানে ১৯৫৪ সালের যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বর্ণনার উল্লেখ রয়েছে। ১৯৫৮-১৯৬২ সালের সেই পাকিস্তানিদের বর্বরতা, নির্মমতার ইতিহাসও লেখা আছে ফলকগুলোতে। বিশেষ করে সে সময়ের ছবিগুলো যেন ফিরিয়ে নিয়ে যায় ৭১-এর যুদ্ধের সময়ে।
যুদ্ধের ইতিহাস
পূর্ব আর পশ্চিম পাকিস্তানিদের মধ্যে ছিল বিশাল দূরত্ব। তাদের চেহারা, ভাষা, খাবার, পোশাক, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য সবকিছু ছিল ভিন্ন, শুধু একটি বিষয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষগুলোর মাঝে মিল ছিল, সেটি হচ্ছে ধর্ম। শিক্ষা-দীক্ষা, ব্যবসা-বাণিজ্য, পুলিশ-মিলিটারি, সরকারি কর্মচারী-কর্মকর্তা সবকিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তানের লোকসংখ্যা ছিল বেশি। সবচেয়ে আতঙ্কের বিষয় ছিল সেনাবাহিনীর সংখ্যা, পূর্ব পাকিস্তানের তুলনায় পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যের সংখ্যা ছিল ২৫ গুণ বেশি।
এরপর ভাষা, সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের ওপর নিপীড়ন শুরু করে পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী। উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করা হবে, এমন ঘোষণার পরে ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি সারা পূর্ব পাকিস্তানের মানুষ বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। পুলিশের গুলিতে প্রাণ দিয়েছিল রফিক, সালাম, বরকত, জব্বার এবং আরও অনেকে। তারপরেও সেই আন্দোলনকে থামানো যায়নি, পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীকে শেষ পর্যন্ত ১৯৫৬ সালে বাংলা ভাষাকে স্বীকৃতি দিতে হয়েছিল।
পরে নানা রকম টালবাহানা করে রাজনৈতিক অস্থিরতার সুযোগে ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের সেনাপতি আইয়ুব খান পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করে। দেশে সামরিক শাসন, তার ওপর পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর নানান বঞ্চনা। বাঙালিরা এসব বঞ্চনা সহজে মেনে নিতে চায়নি। বাঙালিদের সবচেয়ে বড় রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের তেজস্বী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য স্বায়ত্তশাসন দাবি করে ১৯৬৬ সালে ৬ দফা ঘোষণা করেন। ছয় দফা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের বাঙালিদের সব রকম অর্থনৈতিক শোষণ, বঞ্চনা আর নিপীড়ন থেকে মুক্তির এক অসাধারণ দলিল।
দুঃসহ সেই স্মৃতির পাতা থেকে আবার ফিরলাম আজকের জাদুঘরে। চোখের সামনে ইতিহাস দেখছি। রেসকোর্স ময়দানে লাখো মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে বঙ্গবন্ধুর সেই ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, ৭০-এর নির্বাচন, ৬ দফা দাবি, ১৯৭০-এর নির্বাচনে মোহাম্মদপুরে বিহারিদের উদ্দেশে শেখ মুজিবের দেওয়া ভাষণ সবকিছুর যেন এক প্রামাণ্যচিত্র দেখছি চোখের সামনে। সাদা-কালো ছবিতেও জাগ্রত মনে হচ্ছে সে সময়ের ভোট, পশ্চিম পাকিস্তানের সদ্য জাগ্রত জনগণ, যুদ্ধে জয়লাভ, বঙ্গবন্ধুর শপথ গ্রহণ আর বাংলাদেশের মানচিত্র।
এরপর সিঁড়ি দিয়ে নিচতলায় যাই। সেখানে লেখা ‘প্রদর্শনী গ্যালারি-২’। প্রথমেই চোখে পড়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বঙ্গবন্ধুর বিভিন্ন মুহূর্তের ছবি। জাতির পিতার জাপান, মিসর, যুক্তরাজ্যসহ বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের স্থিরচিত্রের বর্ণনা আছে এই ফ্লোরে। এখানে আছে রানি এলিজাবেথের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর হাত মেলানোর ছবি, বিশ্বের বিভিন্ন নেতার সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর মতবিনিময়ের স্থিরচিত্র।
নজর কেড়েছে এক কোনায় থাকা স্বচ্ছ এক কাচের বাক্সে কালো রঙে লেখা ‘গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান’। স্বাধীন দেশের প্রথম সংবিধান, এটি সংরক্ষিত আছে এই গ্যালারিতে।
একটু সামনে গেলেই দেখা মেলে যুদ্ধকালে বাঙালিদের ওপর নির্মম অত্যাচারের চিত্র। সে কী নির্মমতা, বর্বরতা, নৃশংসতার চিত্র! দেখলেই গা শিওরে ওঠে। রোগা-দুর্বল শরীর নিয়েও কত মানুষ হাঁটছে মাইলের পর মাইল। পাকিস্তানি সৈন্যের গুলিতে মাটিতে পড়ে থাকা এক শহীদের ছবি যেমন ছিল এক কোণে তেমনি ছিল দুই শিশুর মরদেহের চিত্রও। যুদ্ধকালীন সময়ের গণমৃত্যুর ছবিও ছিল। ছিল যুদ্ধের সময়ে মানুষের খাদ্য সংকটের চিত্র আর মানুষের হাহাকার। শিশু মৃত্যুসহ নানা অমানবিক চিত্রের বর্ণনা তুলে ধরা হয়েছে এখানে রক্ষিত ইতিহাসের গল্পগুলোতে।
তৃতীয় তলার এক পাশে দেখা যায়, কাচের ফলকে সে সময়ের নানান বিষয় নিয়ে প্রকাশিত সংবাদের পেপার কাটিং সংগ্রহে রাখা আছে। সংবাদমাধ্যমগুলোতে লিড নিউজে জায়গা পেয়েছে মুজিব সেনাদের সফলতার গল্প। সেখানে আছে পাকিস্তানিদের জুলুমের কথাও। এক ফলকে দেওয়া আছে বাঙালির কাছে পাকিস্তানের আত্মসমর্পণের সেই স্বাধীনতা অর্জনের বিরল মুহূর্তের চিত্র।
এরপর যাই সর্বশেষ গ্যালারিতে। সেখানে লেখা ‘প্রদর্শনী গ্যালারি-৩’। কাচের এক বাক্সে আছে বঙ্গবন্ধুর স্বাক্ষরসংবলিত দেশ স্বাধীনের শুরুর দিকের পতাকা। এই গ্যালারিতে স্থান পেয়েছে বিভিন্ন পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক অবস্থান, রাজনৈতিক কার্যকলাপের ছবি। একটি সাদা হার্ডবোর্ডে আছে জেলখানায় থাকা অবস্থায় বঙ্গমাতা শেখ ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের জন্য বঙ্গবন্ধুর হাতে লেখা চিঠি।
চিঠির শুরুতে লেখা, “রেণু...অতঃপর, ইতি তোমার মুজিব।” নিজের সহধর্মিণীকে জেলে থেকেও সাহস জুগিয়েছিলেন মুজিব। এখানে কাচের বক্সে আরও ছিল, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত পাইপ, গুলিবিদ্ধ হওয়া ‘শ্রদ্ধাঞ্জলি’ বইটি, বঙ্গবন্ধুর ব্যবহৃত চশমা, একটি বুলেট, বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ব্যবহৃত সাদা ও আকাশি রঙের শাড়ি, বঙ্গবন্ধুর পাকিস্তানি পাসপোর্ট, শেখ রাসেলের ব্যবহৃত জুতা, শেখ জামালের ভ্যাকসিনেশন সার্টিফিকেসহ অনেক স্মৃতি তাড়নার জিনিসপত্র।
তামাক পাইপ ও বক্স উপহার পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সেটিও স্থান পেয়েছে এখানে। বক্সে লেখা, “To MUJIB BHAI From SNTUC”।
বঙ্গবন্ধুর পাইপ
এ পাইপ ছিল তাঁর নিত্য সঙ্গী। তিনি যেখানেই থাকুন না কেন, এটি তাঁর সঙ্গে থাকত। প্রিয় ওই পাইপটিতে এরিনমোর তামাক ভরতেন তিনি। নিজস্ব স্টাইলে সে পাইপ দিয়ে ধোঁয়া ছাড়তেন বঙ্গবন্ধু, যাতে ফুটে উঠত তাঁর ব্যক্তিত্বের বিশালতা। তাঁর বিশাল ব্যক্তিত্বের সঙ্গে পাইপ এক ভিন্ন মাত্রা যোগ করত। পাইপটি ছিল একজন রাষ্ট্রনায়কের সঙ্গে মানানসই আভিজাত্যের একঝলক। এটি এমন এক অভ্যাস যা শুধু মুজিব ব্যক্তিত্বের সঙ্গেই খুব ভালোভাবে যেত।
এ ছাড়া এই ফ্লোরে আছে মুজিবের পারিবারিক বিভিন্ন ছবি, শেখ রাসেল ও শেখ রেহানার বাল্যকালের ছবি ও তাদের বিভিন্ন দেশ ভ্রমণের ছবি। এখানে জায়গা করে নিয়েছে বঙ্গবন্ধু প্রদত্ত ভাষণের বই, ‘দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাতে হবে’।
দুই ঘণ্টার ভেতর যেন গোটা ইতিহাস চোখের সামনে ভেসে উঠল। ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশের ইতিহাস। সাদা-কালো ছবিতে দেখলাম জাতির পিতাকে নির্মমভাবে হত্যার দৃশ্য। সাক্ষী হলাম এক অনন্য ইতিহাসের।