দেশের ৭৪ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার ঋণ করে খাবার খাচ্ছে। কেবল তা-ই নয়, গত ছয় মাসে এসব পরিবারের আয় না বাড়লেও খরচ বেড়েছে ১৩ শতাংশের বেশি। ফলে তাদের ৯০ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে। এমনটিই জানিয়েছে বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিং (সানেম)।
বুধবার (২৯ মার্চ) রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টারে দেশের ৮ বিভাগের ১ হাজার ৬০০ পরিবারের ওপর করা এই জরিপের ফলাফল তুলে ধরে সানেম। জরিপের সময়কাল ছিল গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত (ছয় মাস)। যেখানে অংশ নেয় নিম্ন আয়ের সব মানুষ।
সানেমের মতে, মূল্যস্ফীতির যে চাপ তার পেছনে বিশ্ববাজারে পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি যতটা না দায়ী, তার চেয়ে বেশি নিয়ামক হিসেবে কাজ করেছে দেশে বৈদেশিক মুদ্রার অবমূল্যায়ন ও বাজার অব্যবস্থাপনা।
সংস্থাটির জরিপে দেখা যাচ্ছে, দেশের গ্রাম ও শহরের নিম্ন আয়ের ৯০ শতাংশ পরিবারই অর্থনৈতিক চাপে তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন হয়ে গেছে। মূল্যস্ফীতির চাপে খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বাড়তে থাকায় গত ছয় মাসে যে ৭৪ শতাংশ পরিবার ধার করে চলেছে, তাদের ধার করা বন্ধ হয়েছে বা বন্ধ হবে, এমন পরিস্থিতি এখনো আসেনি। বরং পরিস্থিতি যদি এভাবে চলতে থাকে, তাহলে ৮৫ শতাংশ পরিবার মনে করে যে আগামী ৬ মাসে তাদের আরও ধার করতে হবে। এ ছাড়া ৩৫ শতাংশ পরিবার তাদের সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে, আর সঞ্চয় বিমুখ হয়েছে ৫৫ শতাংশ পরিবার।
পরিস্থিতি সামাল দিতে গত ৬ মাসে ৪৫ শতাংশ পরিবার বেছে নিয়েছে ক্ষুদ্র ঋণের প্রতিষ্ঠান। এতে করে নিম্ন আয়ের মানুষ সুদের দুষ্টচক্রের ফাঁদে যা থেকে বেরিয়ে আসা মুশকিল। এর পাশাপাশি ৩৭ শতাংশ পরিবার আত্মীয়স্বজনের কাছ থেকে টাকা নিয়েছে। সমবায় সমিতি থেকে ধার করছে ২৩ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ব্যাংক ও মহাজনি ঋণ নিয়েছে যথাক্রমে ১৪ ও ৩ শতাংশ পরিবার।
বেসরকারি এ প্রতিষ্ঠানের মতে, লাগামহীন নিত্যপণ্যের খরচের কারণে খাবারের খরচ মেটাতে মানুষ খাদ্যতালিকা থেকে আমিষজাতীয় খাবারের পরিমাণ কমিয়েছে। এর মধ্যে ৯৬ শতাংশ পরিবার মাংস খাওয়া কমিয়েছে। যেমন ছয় মাস আগেও যেসব পরিবারে মাসে ৪ বার মুরগি খেত, এখন তারা ২ বার মুরগি খায়। মাছ খাওয়া কমিয়েছে ৮৮ শতাংশ পরিবার। এ ছাড়া ৭৭ শতাংশ পরিবার ডিম ও ৮১ শতাংশ পরিবার ভোজ্যতেল খাওয়া কমিয়েছে।
খাদ্যবহির্ভূত পণ্য এবং সেবায়ও নিম্ন আয়ের মানুষ ব্যাপকভাবে খরচ কমিয়েছে। বিশেষ করে পোশাক, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য।
জরিপের তথ্য বলছে, শহরের নিম্ন আয়ের পরিবার খাদ্য কিনতে বেশি কাটছাঁট করছে। গ্রামের পরিবারগুলো খাদ্যবহির্ভূত পণ্যে খরচ কমিয়েছে বেশি।
সানেমের জরিপে উঠে এসেছে, ঘরে খাবার আছে কি-না, তা নিয়ে নিম্ন আয়ের পরিবারে আগের তুলনায় উদ্বেগ বেড়েছে। ফলে খাবারে বৈচিত্র্য কমেছে। খাদ্যতালিকায় থাকছে মাত্র কয়েকটি পদ। ৩৭ শতাংশ পরিবার বলেছে, তাদের এখন মাঝেমধ্যে কোনো এক বেলা খাবার না খেয়ে থাকতে হচ্ছে। প্রয়োজনের তুলনায় খাবার কম খাচ্ছে বলে মনে করে ৭১ শতাংশ পরিবার।
জরিপকারীদের কাছে ১৮ শতাংশ পরিবারের লোকজন দাবি করেছেন যে এই ৬ মাসে এমন কিছুদিন গেছে, যেদিন তাদের পুরো দিনও না খেয়ে থাকতে হয়েছে। খাবারের গুণগত মানেও ছাড় দিতে হচ্ছে এসব মানুষের। যার কারণে আগের থেকে কম দামি মাছ-মাংস খেতে হচ্ছে। খাদ্য নিরাপত্তার ভয় বেশি শহরের নিম্ন আয়ের পরিবারে।
সানেম বলছে, জরিপে অংশ নেওয়া পরিবারের মধ্যে সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় আছে মাত্র ৪০ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার। এর মধ্যে বেশির ভাগ আছে টিসিবির পরিবার কার্ডধারী। সরকারের অন্য সহায়তা তারা পাচ্ছে না। টিসিবির এই কার্ড প্রাপ্তির হার গ্রামের তুলনায় শহরে বেশি।
জরিপে অংশ নেওয়া ৫৬ শতাংশ পরিবার মনে করে, আগামী ছয় মাসে তাদের অবস্থার কোনো পরিবর্তন হবে না। ৪১ শতাংশ পরিবার এটাও বলছে, ভবিষ্যতে তাদের ভিক্ষা বা সাহায্য নিয়ে চলতে হতে পারে। টিকে থাকার জন্য শহর থেকে গ্রামে যেতে চায় বেশির ভাগ মানুষ।
বর্তমানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সরকারি উদ্যোগ যথেষ্ট কি না, এমন প্রশ্নের উত্তরে জরিপে অংশ নেওয়া অধিকাংশ মানুষ বলেছেন, সরকারের উদ্যোগ যথেষ্ট নয়। খাবার জোগাড় করতে জমি বিক্রি করে চলতে হতে পারে বলে মনে করে ১৭ শতাংশ নিম্ন আয়ের পরিবার। অবস্থা সামাল দিতে ভবিষ্যতে ঘরের শিশুদের শ্রমে নিযুক্ত করতে হতে পারে বলে ১৯ শতাংশ পরিবার জানিয়েছে। খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে আসায় ২৪ শতাংশ পরিবার মনে করে ব্যয় কমাতে তাদের সন্তানদের পড়াশোনা বন্ধ করতে হতে পারে। মেয়ে সন্তানকে দ্রুত বিয়ে দেওয়ার কথাও বলছেন অনেকে। ২৫ শতাংশ পরিবার মনে করে বর্তমান পরিস্থিতি সামাল দিতে তাদের হাতে এখন আর কোনো সুযোগ অবশিষ্ট নেই। তারা এখন নিরুপায়।
এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য সানেম মনে করে, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর খাদ্য নিরাপত্তার বিষয়টিতে এখন সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া উচিত। দেশে উৎপাদন বাড়ানোর পাশাপাশি খাদ্য আমদানিতে আরও বেশি কৌশলি হওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন তারা। একই সঙ্গে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছে সংগঠনটি।