• ঢাকা
  • রবিবার, ০৮ সেপ্টেম্বর, ২০২৪, ২৪ ভাদ্র ১৪৩১, ৩ রবিউল আউয়াল ১৪৪৫
ভয়াল ২১ আগস্ট

সেদিন যা ঘটেছিল


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: আগস্ট ২০, ২০২১, ০৯:৫৬ পিএম
সেদিন যা ঘটেছিল

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট। বাঙালির ইতিহাসের আরেকটি কলঙ্কিত দিন। এদিন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ও তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনাকে হত্যার চেষ্টা করে ঘাতকেরা। কিন্তু দলীয় নেতাকর্মীদের সাহসিকতা, আত্মত্যাগ ও অনেকটা ভাগ্যের জোরে প্রাণে বেঁচে যান বঙ্গবন্ধু কন্যা। নিজে প্রাণে বেঁচে গেলেও সেদিন হারাতে হয়েছিল ২৪ জন নেতাকর্মীকে। এমনকি ইতিহাসের বর্বরোচিত এই হামলায় পঙ্গুত্বও বরণ করেছেন অনেকে। আহত হয়েছেন শেখ হাসিনা নিজেও। তবে ভয়াবহ সেই ঘটনায় অনেকটা অলৌকিকভাবেই মৃত্যুর দুয়ার থেকে ফিরে এসেছিলেন তিনি।

সমাবেশ লোকে লোকারণ্য

২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্থানে ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশের আয়োজন করেছিল তৎকালীন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ। দলীয় কার্যালয়ের সামনে আয়োজিত সেই সমাবেশে বক্তব্য প্রদানের জন্য একটি ট্রাককে বানানো হয়েছিল অস্থায়ী মঞ্চ। দুপুরের পর থেকেই রাজধানীর বিভিন্ন স্থান থেকে মিছিল নিয়ে সমাবেশস্থলে আসতে শুরু করে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা। বিকাল ৩টা থেকে ৪টার মধ্যে পেশাগত দায়িত্ব পালনের জন্য পৌঁছে যান সংবাদকর্মীরাও। শুরু হয় সমাবেশ, বক্তব্য দিতে থাকেন কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরা।

শেখ হাসিনা এলেন সমাবেশে

বিকাল সাড়ে ৪টার দিকে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন শেখ হাসিনা। নিজের বুলেট প্রুফ মার্সিডিজ বেঞ্জ গাড়ি থেকে নেমে পা রাখেন সমাবেশের অস্থায়ী মঞ্চে। তখন দলের জ্যেষ্ঠ নেতারা বক্তব্য রাখছিলেন। সামনে দাঁড়ানো হাজার হাজার নেতাকর্মী। বিকাল ৫টা ২ মিনিটে বক্তব্য দেওয়ার জন্য দাঁড়ান শেখ হাসিনা। প্রায় ২০ মিনিট তিনি বক্তব্য দেন। বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে ‘জয় বাংলা’ ‘জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তব্য শেষ করে হাতে থাকা কাগজ ভাজ করতে থাকেন এবং নিজের আসন গ্রহণের জন্য ঘুরে দাঁড়ান। এ সময় মঞ্চের সামনে থাকা জ্যেষ্ঠ্য আলোকচিত্রী এস এম গোর্কি শেখ হাসিনাকে আরেকটু থাকার জন্য অনুরোধ করেন। কারণ তারা কেউ ভালো ছবি পাননি। গোর্কির অনুরোধে শেখ হাসিনা ঘুরে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে দক্ষিণ দিক থেকে ছুটে আসে একটি গ্রেনেড, যা বঙ্গবন্ধু কন্যাকেই লক্ষ্য করে ছোঁড়া হয়েছিল। কিন্তু সেটি ট্রাকের কোনায় লেগে পাশে পড়ে যায়, আর সঙ্গে সঙ্গে বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়।

যেন যুদ্ধক্ষেত্র

প্রথম গ্রেনেডটি বিস্ফোরিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ট্রাকের উপর বসে পড়েন। এ সময় তার আশপাশে থাকা নেতাকর্মী ও নিরাপত্তার্মীরা তাকে ঘিরে ধরেন। এর কয়েক মুহূর্ত পরেই একই দিক থেকে আরো দুটি তরতাজা গ্রেনেড ছুটে আসে। সেগুলোও বিকট শব্দে বিস্ফোরিত হয়। তবে ভাগ্যক্রমে একটিও ট্রাকের ওপর পড়েনি। এরপর দুই মিনিটের মধ্যে সভাস্থলের আশপাশে আরো কয়েকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে ঘাতকরা। তখন দলীয় নেতাকর্মীরা ঘটনা বুঝতে পেরে শেখ হাসিনাকে রক্ষায় মানবঢাল তৈরি করেন। এভাবেই তাকে ট্রাক থেকে নামিয়ে তুলে দেন গাড়িতে। কিন্তু ভয়াবহতার সেখানেই শেষ নয়। গাড়িতে ওঠার পর শেখ হাসিনাকে বহনকারী বুলেটপ্রুফ গাড়ি লক্ষ্য করে শুরু হয় মুর্হুমুহু গুলি। কিন্তু সেটি গাড়ির কাঁচ ভেদ করে ভেতরে প্রবেশ করেতে পারেনি। তখন ঘাতকরা ফের গ্রেনেড ছুঁড়ে মারে। এতে শেখ হাসিনাকে বহনকারী গাড়িটির সামনে ও পেছনের তিনটি চাকা পাংচার হয়ে যায়। কিন্তু চালক গাড়ি থামাননি। অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গে শেখ হাসিনাকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউ থেকে পৌঁছে দেন ধানমন্ডির সুধা সদনে।

বঙ্গবন্ধু এভিনিউ পরিণত হয় মৃত্যুপুরীতে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সেদিন প্রাণে বেঁচে গেলেও মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয় বঙ্গবন্ধু এভিনিউ। সভাস্থল ও এর আশপাশ রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে ছিলেন আহত ও নিহতরা। কারো হাত নেই, কারো পা নেই, কারো আবার পেটের নাড়িভুরি বের হয়ে গেছে। কেউ ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারিয়েছেন, কেউবা পড়ে ছিলেন অচেতন। চারদিকে আগুন, রক্ত, হতাহতদের শরীরের অংশ, জুতা-স্যান্ডেল ছড়িয়ে আছে। আহতদের চিৎকারে ভারী হয়ে উঠেছিল পুরো এলাকা। কেউ ছুটছে প্রাণ বাঁচাতে, কেউবা যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে আকুতি জানাচ্ছেন একটু হাসপাতালে নিয়ে যেতে। বিস্ফোরণে ওই এলাকায় যান চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় হতাহতদের হাসপাতালে নিতে বিড়ম্বনায় পড়তে হয় উদ্ধারকর্মীদের। হাত দিয়ে ধরেই নিয়ে যেতে হয় যানবাহনের কাছে।

ঝরে গেল ২৪টি তাজা প্রাণ

সেদিন ভয়বহ এই হামলায় ঘটনাস্থলেই নিহত হন ১৬ জন। পরে হাসপাতালে মারা যান আরো আট জন। আহত হন দুই শতাধিক নেতাকর্মী। নিহতদের মধ্যে ছিলেন প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের তৎকালীন মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমান, প্রধানমন্ত্রীর ব্যক্তিগত নিরাপত্তারক্ষী ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, আবুল কালাম আজাদ, রেজিনা বেগম, নাসির উদ্দিন সরদার, আতিক সরকার, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারি, আমিনুল ইসলাম মোয়াজ্জেম, বেলাল হোসেন, মামুন মৃধা, রতন শিকদার, লিটন মুনশী, হাসিনা মমতাজ রিনা, সুফিয়া বেগম, রফিকুল ইসলাম (আদা চাচা), মোশতাক আহমেদ সেন্টু, মোহাম্মদ হানিফ, আবুল কাশেম, জাহেদ আলী, মোমেন আলী, এম শামসুদ্দিন, ইসাহাক মিয়া প্রমুখ।

পুলিশের ভূমিকা

প্রত্যক্ষদর্শীদের ভাষ্যমতে, সেদিন বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরাপত্তা তেমন জোরদার ছিল না। এমনকি হামলার পর এর প্রতিবাদে নেতাকর্মীরা বিক্ষোভ শুরু করলে উল্টো তাদের লাঠিপেটা ও টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে পুলিশ।
 

Link copied!