• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া

৫৭ বছর আগের সেই দাবির বাস্তবায়ন কবে?


একে সালমান
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৭, ২০২১, ০৮:৫৩ এএম
৫৭ বছর আগের সেই দাবির বাস্তবায়ন কবে?

দীর্ঘ ৫৭ বছর আগে শিক্ষার্থীদের তোলা দাবি এখনো বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। তৎকালীন পাকিস্তান সরকারের আমলে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের তোলা ১১ দফা দাবির অন্যতম একটি দাবি ছিল, ‘শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া আদায়’। এই দাবি ১৯৬৯ থেকে ২০১৮ সালে আরও জোরালো হলেও তার কোনো বাস্তবায়ন না হওয়ায় ইতিমধ্যে শিক্ষার্থীরা আবারও এই দাবি নিয়ে আন্দোলনে নেমেছে। এর বাস্তবায়ন এত বছরেও না হওয়ায় অনেকে হতাশা প্রকাশ করেছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ১১ দফা দাবির একটি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য ‘হাফ ভাড়া’ নির্ধারণ। এই ১১ দফা দাবির ১ (ঢ) দফা অনুসারে, ‘‘ট্রেনে, স্টিমারে ও লঞ্চে ছাত্রদের ‘আইডেন্টিটি কার্ড’ দেখাইয়া শতকরা পঞ্চাশ ভাগ ‘কন্সেসনে’ (ছাড়ে) টিকিট দেওয়ার ব্যবস্থা করিতে হইবে। মাসিক টিকিটেও ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।’’

যেভাবে আদায় হতে পারে হাফ ভাড়া

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, “সম্ভবত ১৯৬৪ সালে বিআরটিসি ৪টি বাস দিয়ে সরকারিভাবে গণপরিবহন সেবা দেওয়া শুরু করে। তখন থেকে সরকারের নির্দেশে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া নেওয়া হতো। এটা ছিল সম্পূর্ণ সরকারি সেবা। তখন থেকে সারা দেশে অনেকেই শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া আদায় শুরু করেন। কিন্তু গত ৬-৭ বছর ধরে বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে বাসমালিকরা শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়া বাতিল করার পাঁয়তারা করছেন।”

মো. হাদিউজ্জামানের মতে, এটি সুন্দর একটি সমাধান হতে পারত। আসলে বেসরকারি বাসের মালিকরা সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছে। তারা তাদের নিজস্ব অর্থায়নেই পরিবহনে সব ভর্তুকি দিচ্ছে। এখানে তাদের যে ব্যয় হচ্ছে, তা কিন্তু নিজেদেরই দেখতে হচ্ছে। এখানে বিষয়টি এমন হতে পারে যে, শিক্ষার্থীরা যে দাবিটি করছে হাফ ভাড়ার বিষয়ে, সেই বিষয়টি নিয়ে মনিটরিং করা জরুরি। কেননা, আমরা জানি না সারা দেশে কতজন শিক্ষার্থী আছে? এর জন্য সরকারের পক্ষ থেকে একটি গবেষণা জরুরি।

বুয়েটের এই গবেষক আরো বলেন, “রাজধানীতে আমরা দেখেছি ১২ বছর আগেও শহরে মোটরগাড়ির গড় গতি ছিল প্রায় ২১ কিলোমিটার। তখন একটি পরিবহন দৈনিক প্রায় ৮টির মতো ট্রিপ দিতে পারত। কিন্তু এখন তার সংখ্যা প্রায় ৪টির মধ্যে চলে এসেছে। বাসমালিকরা যেসব যুক্তি উপস্থাপন করছেন তা-ও যৌক্তিক দাবি। আবার এদিক দিয়ে শিক্ষার্থীরা যেসব দাবি তুলছে, তারও যুক্তিকতা আছে। আসলে এমন একটি প্রেক্ষাপটে বাসমালিক এবং সরকার একত্রে বসে সিদ্ধান্ত নেওয়া জরুরি।

বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, “ডিজেলের দাম বেড়ে যাওয়ায় সরকার পরিবহন মালিকদের জন্য বাস ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু এরপরও আমরা দেখি, বাসে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় হচ্ছে। এ নিয়ে বাসের শ্রমিকদের সঙ্গে যাত্রীদের বাগ্‌বিতণ্ডাসহ হাতাহাতির মতো ঘটনা ঘটছে। এ বিষয়টি নিরসনের উপায় হচ্ছে, প্রতিটি গণপরিবহনকে টিকিট সিস্টেমের আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তখন দেখা যাবে সবাই সিরিয়াল ধরে দলে দলে শৃঙ্খলভাবে যাত্রীরা গাড়িতে উঠছে। পাশাপাশি সরকার যে ভাড়া নির্ধারণ করে দিয়েছে, তা সঠিকভাবে মনিটরিং করা যাবে।”

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, “ছাত্রদের হাফ পাসের বিষয়টি চাইলে সরকার সমাধান করতে পারে। কারণ, বাসমালিকদের সঙ্গে বৈঠক করেই বাস ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে ছাত্রদের জন্য হাফ পাস রেখেই সেটি নির্ধারণ করা উচিত ছিল। এছাড়া শিক্ষার্থীরা এই দাবিটি নিয়ে আজকে নেমেছে, বিষয়টি এমন নয়। এই দাবিটি ১৯৬৯ সালে সেই পাকিস্তানি আমল থেকে তারা করে আসছে।  বারবার ছাত্রদের এমন দাবি উঠলেও সরকারের পক্ষ থেকে কোনো কর্ণপাত নেই।”

মোজাম্মেল হক চৌধুরী আরো বলেন, “২০১৮ সালে ছাত্ররা নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলন করে। তখন তাদের ওই আন্দোলনে দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য গণপরিবহনে হাফ ভাড়া। এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই ২০১৮ সালে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়ন করা হয়। সেখানে কিন্তু শিক্ষার্থীদের এই দাবিকে মূল্যায়ন করা হয়নি। তখন একটি আইনের মাধ্যমে এই আন্দোলনে সুন্দর একটি সমাধান হতে পারত। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে সে বিষয়টি সমাধান না করেই পাশ কাটিয়ে যাওয়া হয়। যার জন্য শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন অব্যাহত রয়েছে।”

যাত্রীকল্যাণ সমিতির মহাসচিব বলেন, “আমরা দেখছি, বর্তমানে গণপরিবহনে যে বিদ্যমান ভাড়া আছে। তার মাধ্যমেই কিন্তু শিক্ষার্থীদের থেকে হাফ ভাড়া কার্যকরের সুযোগ আছে। কারণ, বাসে ৭০ শতাংশ যাত্রী হিসাবে ভাড়া নির্ধারণ করা হয়েছে। সেখানে বাকি ৩০ শতাংশ আসনে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার ব্যবস্থা করার মতো সুযোগ রয়েছে।”

হাফ ভাড়ার জন্য আন্দোলনের সূত্রপাত কবে থেকে

ইতিহাস বলছে, ১৯৬৯ সালের জানুয়ারিতে সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আন্দোলনের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীদের হাফ ভাড়ার বিষয়টি সামনে আসে। সেখানে শিক্ষার্থীরা তাদের আন্দোলনে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। তার মধ্যে একটি দাবি ছিল শিক্ষার্থীদের জন্য সব পরিবহনে অর্ধেক  ভাড়া রাখা। তৎকালীন ছাত্রসংগঠনটি পশ্চিম পাকিস্তানি স্বৈরাচারী শাসকদের বিরুদ্ধে ১১ দফা দাবি উত্থাপন করে। পরে তৎকালীন সামরিক জান্তা ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে বাসভাড়া সম্পর্কে নির্দেশনায় বলা হয়, ‘‘পশ্চিম পাকিস্তানের মতো বাসে ১০ পয়সা ভাড়ায় শহরের যে কোনো স্থানে যাতায়াতের ব্যবস্থা করিতে হইবে। দূরবর্তী অঞ্চলে বাস যাতায়াতেও শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ (ছাড়) দিতে হইবে। ছাত্রীদের স্কুল-কলেজে যাতায়াতের জন্য পর্যাপ্ত বাসের ব্যবস্থা করিতে হইবে। সরকারি ও আধা সরকারি উদ্যোগে আয়োজিত  খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে ছাত্রদের শতকরা ৫০ ভাগ ‘কন্সেসন’ দিতে হইবে।’’

তখনকার সর্বদলীয় ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের নেতা ও বর্তমানে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, “আমাদের আন্দোলনে ইয়াহিয়া খানের সামরিক আদেশে শিক্ষার্থীদের অর্ধেক ভাড়া প্রদানের বিষয়টি বাস্তবায়িত হয়। তখন এটা আইন দ্বারা কার্যকর হয়নি। হাফ ভাড়া নেওয়ার এই ধারা স্বাধীনতার পরও বহু বছর ধরে চালু ছিল। সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, শিক্ষার্থীদের থেকে অর্ধেক ভাড়া নেওয়ার বিষয়টি বাসমালিকরা মেনে নিতে পারছেন না। এজন্য শিক্ষার্থীরা সেই ১৯৬৯-এর মতো আবারও আন্দোলন শুরু করেছে।”

রাশেদ খান মেনন আরো বলেন, “স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা ও বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীরা অনেকটা রীতি হিসেবে এত দিন গণপরিবহনে অর্ধেক ভাড়া দিয়ে এলেও কোনো কোনো পরিবহন কর্তৃপক্ষ শিক্ষার্থীদের এই অধিকারের প্রতি অবজ্ঞা করে আসছিল।”

Link copied!