• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

২০২১-এ হারালাম যাঁদের


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ৩১, ২০২১, ১১:৫৪ এএম
২০২১-এ হারালাম যাঁদের

স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী বছরে অদৃশ্য করোনা মহমারি কেড়ে নিয়েছে দেশবরেণ্য অনেককে। তাঁরা রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব, সাহিত্যিক, সাংবাদিক, সংগীতশিল্পীসহ নানা ক্ষেত্রের বিশিষ্টজন। আবার অনেকেই হয়েছে স্বাভাবিক মৃত্যু। ২১-এ হারানো এ বরেণ্যজনদের নিয়েই বছরান্তের এ প্রতিবেদন।

খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ

চলতি বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি ব্যাংকিং জগতের পরিচিতমুখ খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ মারা যান। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার পর বেশ কিছুদিন চিকিৎসাধীন থাকাবস্থায় তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। তার বয়স হয়েছিল ৮০ বছর।

ইব্রাহিম খালেদ বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর। ২০১১ সালে বাংলা একাডেমি তাকে সম্মানসূচক ফেলোশিপ প্রদান করে। ১৯৬৩ সাল থেকে ব্যাংকিং ব্যবস্থার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ইব্রাহিম খালেদ। ১৯৯৪ থেকে ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক, ১৯৯৬ সালে অগ্রণী ব্যাংক এবং ১৯৯৭ সালে সোনালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৯৮-২০০০ মেয়াদে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নরের দায়িত্ব পালন করেন। ২০০০ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত তিনি পূবালী ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ছিলেন। ২০২০ সালের ৯ ডিসেম্বর থেকে আমৃত্যু পূবালী ব্যাংক লিমিটেডের পরিচালনা পর্ষদে স্বতন্ত্র পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেন।

এইচ টি ইমাম

২০২১ সালের ৪ মার্চ মারা মারা যান প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হোসেন তৌফিক ইমাম (এইচ টি ইমাম)। দীর্ঘদিন ধরে কিডনি জটিলতায় ভুগে রাজধানীর সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে (সিএমএইচ) চিকিৎসাধীন অবস্থায় শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮২ বছর।

এইচ টি ইমাম স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম মন্ত্রিপরিষদ সচিবের দায়িত্ব পালন করেন। পূর্ব পাকিস্তানের উচ্চ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা হয়েও ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেন এবং প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার পরিচালনায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করার পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে মন্ত্রীর পদমর্যাদায় জনপ্রশাসন বিষয়ক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ দেন। পরে ২০১৪ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা হিসেবে নিয়োগ পান। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনা বিষয়ে তিনি একাধিক বই লিখেছেন।

ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ

২০২১ সালের ১৬ মার্চ মারা যান বাংলাদেশের সাবেক উপ-রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী মওদুদ আহমদ। দীর্ঘদিন ধরে ফুসফুস ও কিডনি জটিলতায় ভুগে সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

মওদুদ আহমদ বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) ও জাতীয় পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাদের একজন। পেশায় একজন আইনজীবী ও রাজনীতিবিদ। সাবেক এ সংসদ সদস্য অষ্টম জাতীয় সংসদে আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।

১৯৭৭-৭৯ সালে রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের সরকারের মন্ত্রী ও উপদেষ্টা ছিলেন মওদুদ আহমদ। ১৯৭৯ সালে তিনি প্রথম সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮১ সালের ৩০ মে জিয়াউর রহমান নিহত হলে এক বছরের মধ্যে রাষ্ট্রক্ষমতা নেন হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ। ১৯৮৫ সালের নির্বাচনে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন এবং সরকারের তথ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব পান। এর পরের বছরই তাকে উপ-প্রধানমন্ত্রী করা হয়। ১৯৮৮ সালে তিনি প্রধানমন্ত্রী হন। ১৯৮৯ সালে তাকে শিল্প মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়া হয় এবং জেনারেল এরশাদ তাকে উপ-রাষ্ট্রপতি করেন। ১৯৯০ সালের ৬ ডিসেম্বর এরশাদ সরকার জনরোষের মুখে ক্ষমতা ছাড়তে বাধ্য হন।

১৯৯১ সালে জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে মওদুদ আহমদ আবার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। ২০০১ সালে ধানের শীষ প্রতীক নিয়ে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কোম্পানীগঞ্জ উপজেলা থেকে মোট পাঁচবার এমপি নির্বাচিত হন তুখোড় এ রাজনীতিক। বিএনপির প্রতিষ্ঠালগ্নে জিয়াউর রহমানকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন তিনি। পরে দলটির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ নেতা হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করেন। মওদুদ আহমদ ছিলেন পল্লীকবি জসীম উদদীনের জামাতা।

ফজল-এ-খোদা

গত ৪ জুলাই ভোরে মারা যান ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানের গীতিকার ফজল-এ-খোদা। করোনায় আক্রান্ত হয়ে রাজধানীর শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন তিনি। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি তার। ফজল-এ-খোদার বয়স হয়েছিল ৮১ বছর।

ছড়াকার হিসেবে লেখালেখি শুরু করেছিলেন ফজল-এ-খোদা। তিনি বেতারে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন ১৯৬৩ সালে। ১৯৬৪ সালে টেলিভিশনে গীতিকার হিসেবে তালিকাভুক্ত হন। দেশাত্মবোধক, আধুনিক, লোক সংগীত এবং ইসলামিক গান লিখে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছেন।

বিবিসির জরিপে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় ১২তম স্থানে রয়েছে ফজল-এ-খোদার লেখা ‘সালাম সালাম হাজার সালাম’ গানটি। এছাড়া তার লেখা উল্লেখযোগ্য গান হলো- ‘যে দেশেতে শাপলা শালুক ঝিলের জলে ভাসে’, ‘ভালোবাসার মূল্য কতো, আমি কিছু জানি না’, ‘কলসি কাঁধে ঘাটে যায় কোন রূপসী, ‘বাসন্তী রং শাড়ি পরে কোন রমণী চলে যায়’ প্রভৃতি।

মুশতারী শফী

একাত্তরের রণাঙ্গনে বিশেষ অবদান রাখা শহীদজায়া বেগম মুশতারী শফী গত ২০ ডিসেম্বর মারা গেছেন। কিডনি ও রক্তে সংক্রমণসহ নানা জটিলতায় ভুগে শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। তার বয়স হয়েছিল ৮৪ বছর।

একাত্তরের এপ্রিলে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তার স্বামী মোহাম্মদ শফী ও ছোট ভাই এহসানকে পাকসেনারা নির্মমভাবে হত্যা করে। মুক্তিযুদ্ধকালে তিনি চট্টগ্রামে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দসৈনিক হিসেবে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন।

ষাটের দশকে নারী আন্দোলনে সক্রিয় থাকা মুশতারী শফী নব্বইয়ের দশকে শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে একাত্তরের ঘাতক যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের আন্দোলন জোরদার হলে সেখানেও তিনি অগ্রণী ভূমিকা রাখেন। একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠনে ভূমিকার পাশাপাশি এতে নেতৃত্বও দেন। জাহানারা ইমামের মৃত্যুর পর যুদ্ধাপরাধীদের বিচার আন্দোলনের মূল নেতৃত্বে এই শহীদজায়া। স্বাধীনতাযুদ্ধে অনন্য ভূমিকায় ২০১৬ সালে বাংলা একাডেমি তাকে ‘ফেলোশিপ’ প্রদান করে। ২০২০ সালে রাষ্ট্রীয় পুরস্কার ‘রোকেয়া পদক’ পান তিনি।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ
 

একুশে পদকপ্রাপ্ত জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক ও জাতীয় প্রেস ক্লাবের সাবেক সভাপতি রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ মারা গেছেন ২৫ ডিসেম্বর। সম্প্রতি তিনি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হন। প্রথমে বাসায় চিকিৎসা নেন। পরে শারীরিক অবস্থার অবনতি হলে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখান থেকে আর ফেরা হয়নি এই নন্দিত সাংবাদিকের।

সাংবাদিকতায় গৌরবময় অবদানের জন্য রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ১৯৯৩ সালে একুশে পদক লাভ করেন। গত ২১ ডিসেম্বর তিনি বাংলাদেশ প্রেস কাউন্সিলের সদস্য মনোনীত হন।

রিয়াজ উদ্দিন আহমেদ ‘দ্য ফিন্যান্সিয়াল এক্সপ্রেস’ এবং ‘দ্য নিউজ টুডে’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক ছিলেন। এছাড়া তিনি চারবার জাতীয় প্রেস ক্লাবের সভাপতি নির্বাচিত হন।

Link copied!