বিকাল ৫টা ২০ মিনিট। বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে আয়োজিত সন্ত্রাসবিরোধী সমাবেশে বক্তব্য দিচ্ছিলেন আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। ট্রাকের ওপর তৈরি করা সেই অস্থায়ী মঞ্চের মাত্র ২০ গজ দূরে দাঁড়িয়েছিলেন বিটু বিশ্বাস। সমাবেশ শেষে মিছিলের জন্য প্রস্তুত করছিলেন ব্যানার। হঠাৎই গ্রেনেডের বিকট শব্দে হতভম্ব হয়ে পড়েন তিনি। কী করবেন বুঝে ওঠার আগেই পায়ে এসে বিঁধে গ্রেনেডের কয়েকটি স্প্লিন্টার। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। পিষ্ট হতে থাকেন প্রাণ বাঁচাতে ছোটাছুটি করতে থাকা মানুষের পদতলে।
২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানীর গুলিস্থানস্থ বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে ঘটা ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার স্মৃতি এখনো চোখে ভাসে বিটু বিশ্বাসের। কানে বাজে হতাহতদের আর্তচিৎকার। সেদিন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কন্যা শেখ হাসিনাকে হত্যার উদ্দেশে একে একে ১৩টি গ্রেনেড ছোঁড়ে ঘাতকরা। ছোঁড়া হয় গুলিও। তবে নেতাকর্মীদের সাহসিকতায়, আত্মত্যাগে এবং অনেকটা ভাগ্যের জোরে বেঁচে যান শেখ হাসিনা।
ইতিহাসের কলঙ্কিত এই হত্যাচেষ্টায় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রাণে বাঁচলেও ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় তার কান ও চোখ। হারাতে হয় প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাবেক মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন ত্যাগী নেতাকর্মীকে। আহত হন কয়েক’শ নেতাকর্মী। যাদের অনেকেই এখন পঙ্গু।
মুহূর্তে মৃত্যুপুরীতে পরিণত হওয়া বঙ্গবন্ধু এভিনিউতে সেদিন অনেকের মতো আহত হন বিটু বিশ্বাসও। ভাগ্যের জোরে পঙ্গুত্ব বরণ না করলেও শরীরে বিঁধে থাকা গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের ব্যথায় এখনো মাঝে মাঝে কেঁপে ওঠেন তিনি। তখন চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই রক্তাক্ত বিকেলের কথা।
বর্তমানে বাংলাদেশ স্বেচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অফিস সহকারী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন বিটু বিশ্বাস। ২০০৪ সালে গ্রেনেড হামলার সময়ও তিনি একই কাজ করতেন।
বিটু বিশ্বাস বলেন, “২১ আগস্ট সকালে দলের একজন নেতা আমাকে জানায় সমাবেশের জন্য ট্রাক আসবে, সেখানে টেবিল দিতে। আমি স্বেচ্ছাসেবক লীগের অফিস থেকে একটি ছোট টেবিল ও কয়েকটি চেয়ার দিয়ে আসি মঞ্চ তৈরির জন্য। এরপর নেমে পড়ি নিজেদের কাজে। সমাবেশ শেষে আমাদের সংগঠন থেকে একটি মিছিল ধানমন্ডি ৩২ যাওয়ার কথা ছিল। সেজন্য ব্যানার প্রস্তুত করছিলাম।”
দুপুরের পর থেকে বঙ্গবন্ধু অ্যাভিনিউতে নেতাকর্মীদের ঢল নামে জানিয়ে বিটু বিশ্বাস আরো বলেন, “এত নেতাকর্মী সমাবেশে যোগ দিতে আসছে যে দাঁড়ানোর জায়গা পর্যন্ত ছিল না সেদিন। আমি অস্থায়ী মঞ্চ থেকে মাত্র বিশ গজ দূরে দাঁড়িয়েছিলাম। বিকেল সাড়ে ৪টার দিকে সমাবেশস্থলে উপস্থিত হন শেখ হাসিনা। পাঁচটার দিকে তিনি বক্তৃতা শুরু করেন। তখন আমাদের সংগঠনের এক নেতা আমাকে ব্যানারের দুই পাশে বাঁশ লাগাতে বলেন। আমি সমাবেশের মধ্যে বসেই সেই কাজ করছিলাম। সভানেত্রী যখন ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ বলে বক্তৃতা শেষ করলেন ঠিক তার কয়েক মিনিট পর বিকট শব্দে একটি গ্রেনেড বিস্ফোরিত হলো। সামনে তাকিয়ে দেখলাম আমাদের আপা ট্রাকের উপর বসে পড়লেন। চারদিকে মানুষের চিৎকার, ছোটাছুটি। এরপর আরো কয়েকটি গ্রেনেড মঞ্চের আশপাশে বিস্ফোরিত হয়। নেতাকর্মীরা চারপাশ থেকে ঘিরে ধরে আপাকে গাড়িতে তুলে দেন।”
স্বেচ্ছাসেবক লীগের এই অফিস সহকারী আরও বলেন, “প্রথম দুই দফায় গ্রেনেড বিস্ফোরণে আমি অক্ষতই ছিলাম। কিন্তু তৃতীয় দফায় যখন গ্রেনেড বিস্ফোরিত হয়, তখন কয়েকটি স্প্লিন্টার এসে আমার পায়ে লাগে। মুহূর্তেই আমি মাটিতে লুটিয়ে পড়ি। মানুষজন আমার বুকের উপর দিয়েই ছুটতে থাকে। কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। উঠে দাঁড়াবো সেই শক্তিও নেই। আশপাশে চেয়ে দেখি অনেক নেতাকর্মী ক্ষতবিক্ষত হয়ে পড়ে আছে। রক্তে ভেসে যাচ্ছে চারপাশ। অনেকে চিকিৎসার জন্য আকুতি জানাচ্ছে। কিছুক্ষণ পর একটি ভ্যানে করে আমাদের কয়েকজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও দেখি অনেক নেতাকর্মী রক্তাক্ত হয়ে পড়ে আছে। কোনো সিট খালি নেই। একটা সময় আমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। যখন আমার জ্ঞান ফেরে তখন আমি অন্য আরেকটি হাসপাতালে বিছানায় শোয়া। পায়ে ব্যান্ডেজ।”
তখন মাত্র একদিন চিকিৎসা শেষে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পেলেও পরবর্তীকালে প্রায় এক মাস ১০ দিন হাসপাতালে কাটাতে হয়েছিল তাকে। তবে সবগুলো স্প্লিন্টার শরীর থেকে বের করা যায়নি। তাই এখনো বেশ কয়েকটি স্প্লিন্টার নিয়েই চলাফেরা করেন বিটু বিশ্বাস। মাঝে মাঝে পা ঝিম ঝিম করে ওঠে। আর তখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে সেই ভয়াল বিকেলের কথা।
বিটু বিশ্বাসের মতোই সেদিন আহত হয়েছেন আরো অনেকে। তাদেরই একজন কাজী বেলাল। বর্তমানে আওয়ামী লীগের একজন কর্মী। তিনি বলেন, “আমার শরীরে এখনো ১২৫টি স্প্লিন্টার আছে। রাতে ব্যথার যন্ত্রণায় ঘুমাতে পারি না। শীতকাল এলে কয়েকগুণ বেড়ে যায় ব্যথা। ব্যথার ওষুধও এখন আর কাজ করে না।”
কাজী বেলাল আরো বলেন, “আমি আমাদের নেত্রী জন্য দুই হাত তুলে দোয়া করি। তিনি যদি সেদিন গ্রেনেড হামলায় মারা যেতেন তাহলে আমরা আহতরা চিকিৎসাও পেতাম না। আমাদের হয়তো হাসপাতাল থেকে বুড়িগঙ্গায় ফেলে দিতো। বঙ্গবন্ধু কন্যা বেঁচে থাকায় আমরা চিকিৎসা পেয়েছি। আর্থিক সহায়তা পেয়েছি। তা দিয়ে এখনো খেয়ে পড়ে বেঁচে আছি।”
২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হন লিটন মোল্লা। তিনি স্প্লিন্টারের আঘাতে ক্ষত-বিক্ষত হয়ে পড়েছিলেন বিটু বিশ্বাসের পাশেই। ঘটনাস্থলেই হারিয়েছিলেন চেতনা। তাকেও বিটু বিশ্বাসের সঙ্গে ভ্যানে করে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। জ্ঞান ফেরে একদিন পর। তখন দীর্ঘ সময় হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন তিনি। গত বছরও তার শরীর থেকে অস্ত্রোপচার করে বের করা হয় চারটি স্প্লিন্টার।
এদের মতোই ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছেন আরো অনেকে। তাদের কেউ হারিয়েছেন হাত, কেউবা পা, কেউবা চোখ। প্রত্যেকেই জননেত্রী শেখ হাসিনার কল্যাণে পেয়েছেন সঠিক চিকিৎসা। পেয়েছেন অনুদানও। তারপরও প্রতি বছর ২১ আগস্ট এলে শিউরে উঠে প্রত্যেকের গা। চোখের সামনে ভেসে ওঠে ভয়াল স্মৃতি।