• ঢাকা
  • রবিবার, ২৪ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সমিতির আড়ালে অবৈধ ব্যাংকিং চালাতো ওরা


সংবাদ প্রকাশ প্রতিবেদক
প্রকাশিত: অক্টোবর ২৬, ২০২১, ০৩:৩০ পিএম
সমিতির আড়ালে অবৈধ ব্যাংকিং চালাতো ওরা

সমবায় সমিতির আড়ালে অবৈধ ব্যাংকিং কার্যক্রম ও এমএলএম ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে গ্রাহকদের সঙ্গে প্রতারণার অভিযোগে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র প্রকল্প পরিচালকসহ ১০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাব-৪।

মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে এই তথ্য জানান র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক।

এর আগে সোমবার (২৫ অক্টোবর) দুপুর দেড়টা থেকে মঙ্গলবার (২৬ অক্টোবর) সকাল সাড়ে ৮টা পর্যন্ত রাজধানীর মিরপুরের নান্নু সুপার মার্কেটে অবস্থিত ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র অফিসে অভিযান চালিয়ে সমিতির প্রকল্প পরিচালক মো. শাকিল আহম্মেদসহ (৩৩) ১০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

গ্রেপ্তারকৃত বাকিরা হলেন— মো. চান মিয়া (৩৮), এ কে আজাদ (৩৫), মো. রেজাউল (২২), মো. তাজুল ইসলাম (৩১), মো. শাহাবুদ্দিন খাঁন (২৮), আব্দুস ছাত্তার (৩৭), মো. মাসুদ বিল্লা (২৯), মো. টিটু মিয়া (২৮) ও মো. আতিকুর রহমান (২৮)।

এ সময় ওই অফিস থেকে প্রতারণার কাজে ব্যবহৃত ১৭টি মুদারাবা সঞ্চয়ী হিসাব বই, ২৬টি চেক বই, ২টি ডিপোজিট বই, ৩টি সিল, ১২০টি ডিপিএস বই, ১টি রেজিস্টার বই, ১টি নোটবুক, ১টি সেলারি শিট, ৩০টি জীবন-বৃত্তান্ত, ৫টি ক্যালেন্ডার, ৮ পাতা ডিপিএসের মাসিক হিসাব বিবরণী, ৩টি পাসপোর্ট, ১টি ডিভিআর মেশিন, ২৮ পাতা ভুক্তভোগীদের অভিযোগ কপি, ১টি ব্যানার ও নগদ ৪ লাখ ২২ হাজার ৮০ টাকা জব্দ করা হয়।

র‌্যাব জানায়, এই সমবায় সমিতির প্রতারণার শিকার কয়েকজন ভুক্তোভোগীর সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে প্রতিষ্ঠানটির অফিসে অভিযান চালানো হয়। অভিযানে প্রতারণার সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা সম্ভব হলেও মূল হোতা সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিন ও কার্যকরী কমিটির অন্যদের পাওয়া যায়নি। তবে তাদেরও গ্রেপ্তার করতে র‌্যাবের অভিযান অব্যহত রয়েছে।

সংবাদ সম্মেলনে র‌্যাব-৪-এর অধিনায়ক মোজাম্মেল হক জানান, “এই প্রতারক চক্রের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা রাজধানীর মিরপুরের বিভিন্ন বস্তি এলাকায় গিয়ে গার্মেন্টসকর্মী, রিকশাচালক, ভ্যানচালক, অটোচালক, সবজি বিক্রেতা, ফল ব্যবসায়ী, গৃহকর্মীসহ নিম্ন আয়ের মানুষদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে তাদের সমিতিতে ডিপিএস/এফডিআর করতে উদ্বুদ্ধ করতেন। কেউ সেই প্রলোভনে পা দিলে তাকে সমিতির মিরপুরের কার্যালয়ে নিয়ে আসতেন। এজন্য তারা গ্রাহক প্রতি এবং ডিপিএস ও এফডিআরের টাকার অংক অনুযায়ী এমএলএমে’র মতো কমিশন পেতেন।

মোজাম্মেল হক আরো জানান, গ্রেপ্তারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, প্রতারণার শিকার গ্রাহকদের কাছ থেকে তারা ডিপিএস ও এফডিআরের নামে মাসিক ১০০ থেকে এক হাজার টাকা পর্যন্ত জমা নিতেন। শর্ত অনুযায়ী তিন বছর মেয়াদি ডিপিএসসে ৩০ শতাংশ ও পাঁচ বছর মেয়াদি ডিপিএসএ ৫০ শতাংশ মুনাফা দেওয়ার কথা থাকলেও গ্রাহকদের নিয়মিত লভ্যাংশ দেওয়া হতো না। এমনকি মেয়াদ পূর্ণের পর তাদের পাওনা টাকাও পরিশোধ করা হতো না। উল্টো লভ্যাংশ বা পাওনা টাকা চাইলে গ্রাহকদের হুমকি-ধামকি ও মারধর করা হতো।

পলাতক প্রতরণার মূল হোতা জসিম উদ্দিন :

র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী, এই সমবায় সমিতির সভাপতি জসিম উদ্দিনের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক সম্পন্ন করে একটি ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে রিপ্রেজেন্টেটিভ হিসেবে কাজ করেছেন। তার দুই স্ত্রী এবং দুই সন্তান রয়েছে।

২০০৩ সালে জসিম স্বল্প সময়ে প্রতারণার মাধ্যমে অধিক মুনাফা লাভের আশায় ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ প্রতিষ্ঠা করেন। এটি ২০০৬ সালে সমবায় অধিদপ্তর থেকে নিবন্ধনও লাভ করে এবং ২০১৩ সালে পুনঃনিবন্ধিত হয়। সমবায় অধিদপ্তরে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র সদস্য সংখ্যা মাত্র ৫৩৭ জন দেখানো হলেও প্রকৃতপক্ষে এই সমিতির গ্রাহক ছিল ২৫ থেকে ৩০ হাজার। এদের প্রত্যেকে জসিমের প্রতারণায় পা দিয়ে তার সমিতিতে ডিপিএস ও এফডিআর করেছেন। আর এর মাধ্যমে জসিম শতকোটি টাকার উপর হাতিয়ে নিয়েছেন বলে র‌্যাবের অনুসন্ধানে জানা গেছে।

জসিম প্রতারণার মাধ্যমে হাতিয়ে নেওয়া অর্থ দিয়ে নিজের নামে আরো সাতটি প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেন। সেগুলো হলো— জসিম মডার্ন ডায়াগনস্টিক সেন্টার, কর্ণফুলী রিয়েল এস্টেট লিমিটেড, জসিম ইন্টারন্যাশনাল ওভারসিস লিমিটেড, জসিম স্টুডেন্ট কনসাল্টেন্সি ফার্ম লিমিটেড, জসিম ট্যুরস এন্ড ট্র্যাভেলস, জসিম ওয়েলফার ফাউন্ডেশন ও জসিম নীট কম্পোজিট লিমিটেড। তবে ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেড’ ছাড়া অন্য কোনো কোম্পানির অস্তিত্ব র‌্যাব পায়নি।

র‌্যাব জানায়, জসিম নিয়মিত ‘কর্ণফুলী মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ সোসাইটি লিমিটেডে’র অফিসে আসতেন না। বরং ভুক্তভোগীর কাছ থেকে হাতিয়ে নেওয়া টাকা সমিতির ব্যাংক হিসাবে জমা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তা উত্তলন করে অন্য ব্যাংকে স্থানান্তর, জমি বা ফ্ল্যাট কিনতেন। এমনকি তার সমিতির সহ-সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক, কোষাধক্ষ ও যুগ্ম সম্পাদক ছিলেন তার পরিবারের লোকজন। প্রতারণার মাধ্যমে অর্জিত টাকায় জসিম জমি, ফ্ল্যাট, গাড়ি, বাড়ি, ডায়াগনেস্টিক সেন্টারসহ বিপুল পরিমাণে অবৈধ অর্থ গড়ে তুলেছেন।

Link copied!