• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১১, ২০২২, ০৬:৩২ পিএম
বাড়ছে শীতজনিত রোগের প্রকোপ

প্রতি বছর শীতকাল এলেই শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেড়ে যায়। বিশেষ করে রাজধানী শহরে বায়ুদূষণের কারণে এই সমস্যা যেন আরো প্রকট হয়ে ওঠে। তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে গেলেই।

মঙ্গলবার (১১ জানুয়ারি) বিএসএমএমইউ হাসাপাতালের বর্হিবিভাগের মেডিসিন বিভাগের সামনে এই প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয় আজগর আলীর। তিনি বলেন, ‍“বেশ কয়েক বছর ধরে অ্যাজমার সমস্যায় ভুগছি। বছরের অন্যান্য সময় তেমন সমস্যা না হলেও শীতকালে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। তখন চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। এবারও ডিসেম্বরের মাঝামাঝি থেকে শ্বাসকষ্টের সমস্যা দেখা দিয়েছে। দিন দিন এটি বাড়তে থাকায় এখন ডাক্তারের কাছে এলাম।”

আজগর আলীর মতোই আরো অনেকে শীতজনিত রোগে বিএসএমএমইউ হাসপাতালের বর্হিবিভাগে ডাক্তার দেখাতে এসেছে। দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে চিকিৎসকের পরার্মশ নিয়ে ফিরে যাচ্ছেন তারা। যাদের সমস্যা বেশি তারা ভর্তি হচ্ছেন হাসপাতালে। এই চিত্র শুধু ঢাকার একটি হাসপাতালের নয়। দেশের বিভিন্ন হাসপাতালেই এই ধরনের রোগীর সংখ্যা বাড়ছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, শীতে তাপমাত্রা কমে যাওয়া ঠাণ্ডা, সর্দি, কাশি, গলাব্যাথা, জ্বর, অ্যালার্জি, চর্মরোগ, পেটের সমস্যাসহ বিভিন্ন শীতজনিত রোগ বৃদ্ধি পায়। যাতে হাসপাতালগুলোতেও বাড়ে রোগীদের ভিড়। বিশেষ করে দেশের উত্তরাঞ্চলে শীতের প্রকোপ বেশি হওয়ায় সেখানে শীতজনিত রোগীর সংখ্যাও বেশি। এছাড়া বড়দের তুলনায় শিশুরা ঠাণ্ডাজনিত রোগে বেশি আক্রান্ত হয়।

প্রায় এক সপ্তাহ ধরে পেটের সমস্যায় ভুগছেন ব্যবসায়ী মো. সাইফুল ইসলাম মামুন। নানা ওষুধ খেয়ে কোনো প্রতিকার না পাওয়ায় বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে এসেছেন বিএসএমএমইউ হাসাপাতালে। তিনি বলেন, “গত এক সপ্তাহ ধরে পেটের সমস্যায় ভুগছি। যেকোনো কিছু খেলেই পেটে গ্যাস হচ্ছে। সাধারণ গ্যাসের ওষুধ ও স্যালাইন খেলে কিছুটা কমে, আবার দেখা দেয়। তাই ডাক্তার দেখাতে এসেছি।”

রাজধানীর পুরান ঢাকা থেকে চর্মজনিত সমস্যা নিয়ে এসেছেন শিক্ষার্থী রিফাত আহমেদ প্রিন্স (২১)। তিনি বলেন, “জিহ্বার নিচে ঘা হয়েছে। গত চার-পাঁচ দিন ধরে এই ধরনের সমস্যায় ভুগছি। ধারণা করছি, ঠান্ডা বা সংক্রমণের কারণে এমনটা হয়েছে।” শীতকালে এই ধরনের সমস্যা বৃদ্ধি পায় বলে শুনেছেন তিনি।

বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মতো ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালের বির্হিবিভাগেও গিয়ে দেখা যায় একই চিত্র। মেডিসিন বিভাগে ডাক্তার দেখার অপেক্ষায় বসে আছেন দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা রোগীরা।

তেমনি একজন মো. সোহল। বয়স বিশ বছর। এসেছেন ময়মনসিংহ থেকে। তিনি জানান, প্রায় এক মাস ধরে তার বুকে কফ জমে রয়েছে। স্থানীয় চিকিৎসকের নানা ওষুধ খেয়েও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই ঢামেকে এসেছেন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার দেখাতে।

জ্বর, ঠান্ডা আর কাশির সমস্যা নিয়ে এসেছেন নারায়ণগঞ্জের গৃহিনী শাহনাজ (৩৫)। তিনি বলেন, “কয়দিন ধরে জ্বর, ঠান্ডা, কাশি। বিভিন্ন ওষুধ খেয়ে না কমায় ডাক্তারের কাছে এসেছি। দেখি ডাক্তার কী বলেন।”

হাঁটুর ব্যাথা নিয়ে এসেছেন মো. সোলাইমান (৫৫)। তিনি বলেন, “শীতকাল এলেই হাঁটুর ব্যথা বেড়ে যায়। ব্যথা যখন তীব্র হয় তখন চিকিৎসকের কাছে আসতে হয়।”

শীতজনিত এসব রোগের বিষয়ে জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিএসএমএমইউ হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের এক চিকিৎসক বলেন, “শীতকালে সাধারণত অ্যাজমা রোগীদের সমস্যাটা বৃদ্ধি পায়। যাদের শ্বাসকষ্ট বা অ্যাজমা রয়েছে শীতকাল এলেই ঠাণ্ডা বাতাস বা বিভিন্ন ধরনের ধুলাবালি থেকে তাদের অ্যাজমার সৃষ্টি হয়। তখন তাদের ঘন ঘন ডাক্তারের কাছে আসতে হয়। এমনকি অনেককে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে অক্সিজেন, ইনজেকশন, নেবুলাইজার নিতে হয়। শীতকালে অ্যাজমা রোগীদের চিকিৎসা দেওয়া আমাদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ।”

এই চিকিৎসক আরো বলেন, “হাঁপানি রোগীদেরও শীতকালে শ্বাসকষ্ট দেখা দেয়। যারা ধূমপান করেন বা অতীতে করতেন, তাদের বয়সকালে  ফুসফুসে এই সমস্যা দেখা দেয়। এটাকে আমরা চিকিৎসা বিজ্ঞানের ভাষায় সিওপিডি বলি। অ্যাজমার সঙ্গে এই রোগের অনেকটা মিল আছে। শুধু অ্যাজমা কম বয়সে বেশি হয়, হাপানিটা বৃদ্ধ বয়সে গিয়ে বেশি দেখা দেয়। দুই ধরনের মানুষেরই শীতকালে এলে ব্যাকটেরিয়া ও ভাইরাসের কারণে ফুসফুসে ইনফেকশন দেখা দেয়। যার কারণে তাদের শ্বাসকষ্টের সমস্যা বেড়ে যায়।”

“এছাড়া সাধারণ ঠাণ্ডাজনিত সমস্যা, যেমন- জ্বর, সর্দি, কাশি, গলা ব্যাথা, টনসিল শীতকাল এলে বেড়ে যায়। যার জন্য ঠাণ্ডাজনিত সমস্যাগুলো শীতকালে আমাদের মূল সমস্যা। এর বাইরে এলার্জির কারণে চর্ম রোগ অনেকটা বৃদ্ধি পায়। রোটা ভাইরাসের কারণে শিশুদের ডায়রিয়ার সমস্যা বেড়ে যায়। অনেক সময় দেখা যায়, ডায়রিয়ার কারণে শিশুরা এত বেশি দুর্বল হয়ে পড়ে যে, তাদের হাসপাতালে ভর্তি করতে হয়। ছোটদের পাশাপাশি বড়দেরও এই ধরনের সমস্যা দেখা দেয়।” যোগ করেন তিনি।

এই ধরনের সমস্যা কীভাবে নিয়ন্ত্রণ করা যায় জানতে চাইলে তিনি বলেন, “প্রাচীনকালে অ্যালোপ্যাথি মেডিসিন বা বিজ্ঞানের এত প্রসার ছিল না। তখন বেশিরভাগ ক্ষেত্রে ঘরোয়া পদ্ধতিতে মানুষ চিকিৎসা নিত বা থাকত। ঘরোয়া পদ্ধতিতে এসব সমস্যা থেকে দূরে থাকতে আমরা রোগীদের ঠাণ্ডা এড়িয়ে চলতে বলি, একটু গরম পানি খেতে বলি, মধু, কালিজিরা বা তুলসি পাতা দিয়ে চা বা পানি খেতে বলি। এমন কিছু গাছ আছে যেগুলো শীতকালে ঠাণ্ডা কমাতে সাহায্য করে। তবে যাদের অবস্থা বেশি খারাপ হয়ে যায়, তাদের ওষুধ দিতে হয় বা হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়।”

এই চিকিৎসক আরো বলেন, “করোনা সংক্রমণের লক্ষণ এবং শীতকালীন ঠাণ্ডাজনিত রোগের লক্ষণ একই। তাই এই ধরনের সমস্যা দেখা দিলে করোনা ডেডিকেটেড হাসপাতালে গিয়ে বা বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে চিকিৎসা করানো উচিত। যেহেতু ওমিক্রণ বাড়ছে, তাই আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি এই ধরনের লক্ষণ দেখা দিলে, করোনা পরীক্ষা করিয়ে নেওয়া উচিত। তাহলে রোগী নিজেও নিশ্চিন্ত থাকতে পারবে এবং পরিবারের অন্যরাও সুরক্ষিত থাকতে পারবে।”

একই কথা বললেন ঢামেক হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসক ডা. মো. শাইখ আবদুল্লাহ। তিনি বলেন, “যাদের অ্যাজমা বা শ্বাসনালীর রোগ আছে সেগুলো শীতকালে একটু বাড়ে। যেহেতু ঠাণ্ডার পাশাপাশি ধুলাবালি বেড়ে যায় এ সময় হয়। প্রতিবছরের মতো এবারও এই ধরনের রোগীরা সংখ্যা বেড়েছে। এছাড়া কিছু রোগী আছে কোমর ব্যথা বা হাড়জাতীয় সমস্যায় ভোগেন। সেগুলোও শীতকালে বেড়ে যায়। তাই শীতকালে এই ধরনের রোগীর সংখ্যাও বাড়ে।”

এসব সমস্যা নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে ডা. মো. শাইখ আবদুল্লাহ বলেন, “সরাসরি ঠাণ্ডা পানিতে গোসল না করে, একটু গরম পানিতে গোসল করলে, গোসলের পর তাড়াতাড়ি চুল শুকিয়ে ফেললে, ধুলাবালিতে গেলে মাস্ক পরিধান করলে, ধূমপান না করলে, ফ্রিজের পানি বা আইসক্রিম জাতীয় খাবার না খেলে শীতজনিত রোগ থেকে অনেকটাই দূরে থাকা যায়। এছাড়া যাদের ব্যথার সমস্যা আছে, তারা ব্যথাস্থান গরম কাপড় দিয়ে আবৃত রাখলে এবং গরম কাপড় দিয়ে সেঁক দিলে ব্যথা অনেকটাই নিরাময় হয়।”

ওমিক্রনে নিয়েও শঙ্কা প্রকাশ করেন এই চিকিৎসক। তিনি বলেন, “ওমিক্রনের লক্ষণ সাধারণ ঠাণ্ডা কাশির মতোই। আগের যেই ডেল্টা ভেরিয়েন্ট ছিল, সেটায় শ্বাসকষ্ট বা ফুসফুসের সংক্রমণ দেখা যেত। কিন্তু ওমিক্রমণের লক্ষণ শীতকালীন ঠাণ্ডা-কাশির মতোই গলাব্যাথা, মাথাব্যাথা বা নাক বন্ধ, হালকা জ্বর হয়। ডেল্টা ভেরিয়েন্টে রোগীর স্বাদ-গন্ধ পাওয়ার অনুভূতি চলে যেত। ওমিক্রণে তেমন লক্ষণ খুবই কম দেখা যাচ্ছে। তাই ঠাণ্ডাকাশি নিয়ে যারা আসেন তাদের আমরা করোনা পরীক্ষা করার পরামর্শ দেই। কিন্তু বেশিরভাগ মানুষই সেটা করে না। যারা সচেতন তারা করে। এসব লক্ষণ নিয়ে আসা রোগীদের আমরা ওষুধ দিয়ে দেই। কেউ যদি এর সঙ্গে শ্বাসকষ্ট নিয়ে আসে, তাহলে আমরা তাকে আমাদের করোনা ইউনিটে পাঠিয়ে দেই।”

শীতকালে সাধারণ সর্দিকাশির সাথে সহজে ওমিক্রনের সংক্রমণকে শনাক্ত করা যায় না। তাই বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ যত দ্রুত সম্ভব টিকা নিয়ে নেওয়া এবং স্বাস্থ্য সচেতন থাকা।

Link copied!