ইসলাম ধর্মাবলম্বীদের অন্যতম ধর্মীয় উৎসব ঈদুল আজহা, যা বাংলাভাষী মানুষের কাছে ‘কোরবানির ঈদ’ নামে পরিচিত। এই ঈদে প্রত্যেক সামর্থ্যবান মুসলমান মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের লক্ষ্যে পশু কোরবানি করে থাকেন। তবে খুশির ঈদ যাতে আমাদের একটু অসচেতনতায় পণ্ড না হয়, সেদিকেও লক্ষ্য রাখতে হবে।
সচেতনতার অভাবে, সুন্দর পরিবেশ ও আনন্দঘন ঈদের দিনে পশুর রক্ত ও বর্জ্য পদার্থ দিয়ে অনেকেই রাস্তাঘাট, বাসা বাড়ির চারপাশ একেবারে দুর্গন্ধযুক্ত করে ফেলে। কিন্তু একটু সচেতন হলে এবং উদ্যোগ নিলে পরিবেশ দূষণরোধ এবং রোগ-জীবাণুর বিস্তার এড়ানো সম্ভব।
সম্প্রতি ইউনিসেফের এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রাজধানী ঢাকায় প্রতিদিন গড়ে ৬ হাজার মেট্রিক টন কঠিন বর্জ্য উৎপাদিত হচ্ছে। অথচ সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আজ পর্যন্ত গড়ে ওঠেনি। গবেষণায় উঠে এসেছে, কঠিন বর্জ্য থেকে সৃষ্ট পরিবেশ দূষণের কারণে রাজধানীর নিম্ন আয়ের ৩৪ ভাগ মানুষ স্বাস্থ্যগত জটিল অবস্থার শিকার হচ্ছে। এর মধে ২৭ ভাগ মানুষ ময়লা পানির কারণে, ১৯ শতাংশ মানুষ জলাবদ্ধতার কারণে স্বাস্থ্যগত নানা জটিলতার শিকার হচ্ছে। এদের অধিকাংশ বস্তিবাসী।
ইউনিসেফের গবেষণায় উল্লেখ করা হয়েছে, রাজধানীর কঠিন বর্জ্যরে অব্যবস্থাপনার ফলে মারত্মক পরিবেশ দূষণ হচ্ছে। এর সরাসরি প্রভাব পড়ছে ঢাকায় বসবাস করা প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর। প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্য, স্বল্প এবং দীর্ঘ মেয়াদে ঝুঁকির মধ্যে পড়ছে। জ্বর, সর্দি, মাথাব্যথা, চর্মরোগ, ইউরিন ইনফেকশন, প্রস্রাবে জ্বালাপোড়া, কোনো ক্ষেত্রে ক্যান্সার, জন্ডিস, নিউমোনিয়া, টাইফয়েড রোগের মতো বিপজ্জনক রোগের বিষয়টিও গবেষণায় উঠে এসেছে। গবেষণায় বলা হয়েছে, এ ধরনের রোগ সাধারণত অবিশুদ্ধ ও অনিরাপদ পানি খাওয়া, অনেকক্ষণ ময়লার মধ্যে থাকার কারণে হয়ে থাকে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকা মহানগরের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। সঠিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না করতে পারলে মহানগর দূষণে আক্রান্ত হবে। পরিবেশ রক্ষায় সচেতন না হলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বাসযোগ্য ঢাকা রেখে যাওয়া সম্ভব হবে না। বর্তমানে ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের অধীনে মোট ১২৯টি ওয়ার্ড রয়েছে। প্রতিদিন এই শহরে ৬ হাজার ২৫০ মেট্রিক টন বর্জ্য সৃষ্টি হয়। দুই সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব ট্রান্সফার স্টেশন ও ডাস্টবিন থেকে নিয়মিত বর্জ্য অপসারণ করা। এরপর সেগুলো চূড়ান্ত ডিসপোজাল সাইটে নিয়ে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে ডিসপোজ করা। অথচ টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার অভাবে তা সম্ভব হচ্ছে না।
আন্তর্জাতিকভাবে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার দেশের বর্জ্য ব্যবস্থাপনার তো খারাপই, দেশের যে অবস্থান ওয়েজো বর্জ্য ব্যবস্থাপনা আরো খারাপ। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার উন্নতি করতে হলে অবশ্যই এই বিষয়ে সিটি করপোরেশনকে নানা উদ্যোগ নিতে হবে। এই বিষয়কে জোরালোভাবে দেখতে হবে।
চিকিৎসকরা বলছেন, বর্জ্যের অস্বাস্থ্যকর পরিবেশের প্রভাবে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চর্মরোগ, ডায়রিয়া, কলেরাসহ নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
এ প্রসঙ্গে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য পর্যাপ্ত বাজেট কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দ রাখা উচিত। কঠিন বর্জ্য অব্যবস্থাপনার ফলে মিথেন গ্যাস নিঃসরণ হচ্ছে, যা জলবায়ু পরিবর্তনেও ভূমিকা রাখছে। বর্জ্যে অব্যবস্থাপনা চক্রের মাধ্যমে খাদ্যপ্রণালি হয়ে শরীরেও ঢুকে যাচ্ছে। অসংক্রামক ব্যাধি সেই চক্রের মাধ্যমে সংক্রামক ব্যাধিতে রূপ নিচ্ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে একটি রাষ্ট্রের মোট জিডিপির প্রায় ৫ শতাংশ জনস্বাস্থ্যের জন্য বরাদ্দ রাখা উচিত। অথচ সেখানে আমাদের রয়েছে শূন্য দশমিক ১ শতাংশেরও কম।”
এই স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ আরও বলেন, “বর্জ্যে অব্যবস্থাপনা থেকে দুই ধরনের রোগ হতে পারে। একটি হলো পানিবাহিত এবং অপরটি হলো বায়ুবাহিত রোগ। বর্জ্যের থেকে পানিবাহিত, যেমন : টাইফয়েড, ডায়রিয়া, কলেরা, হেপাটাইটিস, জন্ডিস রোগ হতে পারে। আবার বর্জ্যের থেকে কিডনি জাতীয় রোগও কিন্তু ছড়াতে পারে। অন্যদিকে বর্জ্য পচে যে গ্যাস তৈরি হয় সেই গ্যাস বায়ুতে মিশে যায়। এর ফেল মানুষের শ্বাসকষ্টজনিত রোগ হয়ে থাকে।
ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, “বর্জ্যের দ্রবণীয় ক্ষতিকর পদার্থ নানাভাবে মানুষের, স্থলচর ও জলচর প্রাণির খাদ্যচক্রে প্রবেশ করে। পুরো ব্যাপারটিই মানুষের অসুস্থতা এবং পরিবেশ দূষণের সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কযুক্ত। তাই এসব বর্জ্যর ক্ষেত্রে মাটিচাপা কিংবা পুড়িয়ে ফেলতে হয়। তবে মাটিচাপা দেওয়াই উত্তম। নয়তো যে কেউ সংক্রমিত হতে পারে।”