• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা নীতিমালা নেই, বিপাকে যাত্রীরা


আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশিত: আগস্ট ২৬, ২০২২, ১১:৩৮ এএম
অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা নীতিমালা নেই, বিপাকে যাত্রীরা

দেশে হঠাৎ জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির প্রভাব পড়ছে মুমূর্ষু রোগী পরিবহনে ব্যবহৃত অ্যাম্বুলেন্স ভাড়াতেও। অকটেন ও ডিজেলের দাম বাড়ায় অসহায় রোগীদের কাছ থেকে ইচ্ছেমতো ভাড়ায় আদায় করছেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। এমনটাই অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। যদিও মালিক সমিতি দাবি করছে, তারা ভাড়া বাড়ায়নি। অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা নীতিমালা না থাকায় কেউ কেউ সুযোগ নিচ্ছে।

সরেজমিনে বুধবার (২৪ আগস্ট) রাজধানীর একাধিক হাসপাতাল ঘুরে রোগী, স্বজন, অ্যাম্বুলেন্স মালিক, চালক ও সহকারীদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।

অ্যাম্বুলেন্স চালকরা বলছেন, তারা এলাকা কিংবা দূরত্ব বুঝে ভাড়া নিয়ে থাকেন। ভাড়া নির্ধারিত না থাকায় একেকজনের কাছ থেকে ভিন্ন রকম ভাড়া আদায় করছেন। জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির ফলে তারাও একটু বাড়িয়ে ভাড়া নিচ্ছেন। তবে কেউ কেউ যাত্রীদের থেকে অনেক বেশি ভাড়া নিচ্ছেন বলে জানান তারা।

শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে বরিশাল থেকে অ্যাম্বুলেন্সে আসা এক যাত্রী বলেন, “জ্বালানি তেলের দামের দোহাই দিয়ে আগের চাইতে ভাড়া এখন বেশি নেওয়া হচ্ছে। বরিশাল থেকে ঢাকায় আসতে ভাড়া দাবি করেছে ১২ হাজার টাকা। আমাদের তো জরুরি প্রয়োজনে রোগী নিয়ে আসতেই হবে। তাই বলে কোনো নজরদারি করার মতো কি কেউ নেই। ভাড়া কম দিতে গেলেই বলে তেলের দাম বাড়ছে।”

কিশোরগঞ্জ থেকে ভাঙা পায়ের ফলোআপ চিকিৎসা নিতে জাতীয় অর্থোপেডিকস প্রতিষ্ঠান ও পুনর্বাসন কেন্দ্রে (পঙ্গু হাসপাতালে) আসেন মাজেদুল ইসলাম (৮০)। চিকিৎসা শেষে অ্যাম্বুলেন্স ভাড়া নিয়ে তিনি সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আগে কিশোরগঞ্জ থেকে চার হাজার টাকায় পঙ্গুতে এলেও আজ ছয় হাজার দাবি করছে।”

অ্যাম্বুলেন্স চালক-সহকারীদের সঙ্গে ভাড়া নিয়ে দর-কষাকষি করতে দেখা যায় জামালপুরগামী আরেক রোগীর স্বজনদের। তিনি জানান, অসুস্থ বোনকে নিয়ে তিনি বাড়ি ফিরতে চান। অ্যাম্বুলেন্সে জামালপুর সদর যেতে পাঁচ হাজার টাকার ভাড়া সাত হাজার দাবি করছে।

জানতে চাইলে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের এক চালক সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অকটেনের দাম ১৩৫ টাকা হয়েছে। পথে খরচ হবে তিন হাজার, চালক-হেলপারের ভাড়া ছাড়াও মালিককে দিতে হবে। তাই আগের হিসাব করলে না খেয়ে মরতে হবে। বাধ্য হয়েই একটু বেশি চাইছি।”

অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিসের মালিক রাসেল মিয়া (ছদ্মনাম) জানান, অ্যাম্বুলেন্স সাধারণত ডিজেল, অকটেন ও গ্যাসে চলে। পাবনা থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ২৪০ কিলোমিটার। দূরপাল্লার পরিবহন ভাড়া কিলোমিটারপ্রতি ৪০ পয়সা বেড়েছে। অর্থাৎ ৫০০ টাকার ভাড়া ৬১০ হয়েছে। তেলের দাম বাড়ার আগে ট্রিপপ্রতি সাড়ে সাত থেকে আট হাজার নিতেন।

তিনি বলেন, “পাঁচ লিটার মবিলের দাম বর্তমানে আড়াই হাজার টাকা করে বিক্রি হচ্ছে। দুই মাস আগেও পাঁচ লিটার মবিলের দাম ১৮০০ থেকে ১৯০০ টাকা ছিল। ফলে অনেকে বেশি ভাড়া নিতে বাধ্য হচ্ছেন।”

হৃদরোগ ইনস্টিটিউটের সামনে বরিশালগামী কয়েকজন চালক জানান, পদ্মা সেতুর আগে ফেরিতে টোল ছিল ৮৫০, সেখানে সেতুতে ১৩০০ নেওয়া হচ্ছে। পাশাপাশি এক্সপ্রেসওয়ে ব্যবহারে ২৫০সহ ১৫৫০ টাকা গুনতে হয়। এভাবে যাতায়াতে প্রায় ৩১০০ টাকা খরচ হয়।

পঞ্চগড়ের অ্যাম্বুলেন্স চালক রমিজ উদ্দিন বলেন, “পঞ্চগড় থেকে ঢাকার দূরত্ব প্রায় ৫০০ কিলোমিটার। ঢাকার লাশবাহী ফ্রিজার ভ্যান পঞ্চগড় গেলে ২২ থেকে ২৩ হাজার নেওয়া হচ্ছে। জ্বালানির দাম বাড়ায় ফ্রিজারে পাঁচ, নরমালে তিন হাজার এবং রংপুর-দিনাজপুরগামী আইসিইউ অ্যাম্বুলেন্সে ন্যূনতম পাঁচ হাজার টাকা না বাড়ালে এ পেশায় টিকে থাকা যাবে না।”

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) হিসাব অনুযায়ী, চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত সারা দেশে নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ৭ হাজার ৯৫২টি, যার মধ্যে ২০১০ পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে ২ হাজার ৪৮৬টি। বাকিগুলোর রেজিস্ট্রেশন ২০১১ সাল থেকে দেওয়া হয়েছে।

অন্যদিকে, বিআরটিএর হিসাব বলছে, শুধু রাজধানীতে চলতি বছরের জুলাই মাস পর্যন্ত নিবন্ধিত অ্যাম্বুলেন্সের সংখ্যা ৫ হাজার ৪৯৬টি। যার মধ্যে ২০১০ পর্যন্ত নিবন্ধন নিয়েছে ১ হাজার ২৭৭টি।

যা বলছে ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতি

ঢাকা মহানগর অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমবায় সমিতির সভাপতি আলমগীর হোসেন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সারা দেশে আমাদের প্রায় ৩ হাজার অ্যাম্বুলেন্স রয়েছে। তার মধ্যে শুধু ঢাকায় ১৩০০ থেকে ১৪০০ অ্যাম্বুলেন্স আছে। জ্বালানি তেলের দাম বাড়ায় কেউ কেউ বেশি ভাড়া নিচ্ছেন বলে অভিযোগ পেয়েছি। তবে সমিতি থেকে ভাড়া বাড়ানো হয়নি। রাজধানীর বাইরে এ সমস্যাটা তৈরি হয়েছে।”

আলমগীর হোসেন বলেন, “দেশের কোনো কোনো জায়গা যেমন উত্তরবঙ্গের সিলেট কিংবা চট্টগ্রামে অ্যাম্বুলেন্সগুলো সিএনজি অর্থাৎ গ্যাসে চলে। আর দক্ষিণবঙ্গে যেমন খুলনা, বরিশাল ও সাতক্ষীরা অঞ্চলের বেশির ভাগ অ্যাম্বুলেন্সগুলো ডিজেলের মাধ্যমে চলে। যার কারণে তারা ভাড়াটা বেশি নিচ্ছে। নির্ধারিত ভাড়া না থাকায় এলোমেলো অর্থাৎ যার যার ইচ্ছেমতো ভাড়া দাবি করছে। সরকারিভাবে যদি কিলোমিটারপ্রতি ভাড়া নির্ধারণ করা যেত, তাহলে সমস্যা হতো না। যেমন আগে খুলনা থেকে ঢাকায় আসতে লাগত ১০ হাজার টাকা, এখন তেলের দাম বৃদ্ধির ফলে ১১ হাজার টাকা নিবে এমনভাবে নির্ধারণ করা হলে ভালো হতো। কোনো সিদ্ধান্তে না আসার কারণে কেউ ১০ হাজার, কেউ ১৪ হাজার আবার কেউ ১৫ হাজার টাকা করে নিচ্ছে। অর্থাৎ এলোমেলো অবস্থা। যেখানে ডিজেল গাড়ি আছে, সেখানে ভাড়া নিয়ে সমস্যাটা বেশি। তার মধ্যে কুড়িগ্রাম, পঞ্চগড় ও দিনাজপুর জেলাতে বেশি সমস্যা দেখা যায়। ফলে অনেকে খেয়ালখুশিমতো চললেও তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় না। বিআরটিএর উচিত একটি নীতিমালা করে দেওয়া। নির্ধারিত ভাড়া করা হলে কেউ অতিরিক্ত ভাড়া আর চাইতে পারবে না।”

বিআরটিএর সঙ্গে কোনো আলাপ হয়েছে কি না, এমন প্রশ্নের জবাবে আলমগীর হোসেন বলেন, “২০১৮ সালে অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনা নীতিমালা নিয়ে ১৪টি দাবিসহ বিআরটিএকে আমরা লিখিত একটি চিঠি দিয়েছি। দাবিগুলোর বিষয় ছিল নিবন্ধন, হুটারসংক্রান্ত, স্ট্রিকারসংক্রান্ত, অক্সিজেনসংক্রান্ত, হেলপার/সহায়তাকারী, কালো গ্লাস/পেপারসংক্রান্ত, আসনসংক্রান্ত, রুট পারমিটসংক্রান্ত, ফুয়েলসংক্রান্ত, ফার্স্ট এইড বক্সসংক্রান্ত, অগ্নিনির্বাপক যন্ত্রসংক্রান্ত, বাম্পারসংক্রান্ত, বার্ষিক করসংক্রান্ত ও টোলসংক্রান্ত। ওই বছরই হাইকোর্টেও নীতিমালা চেয়ে রিট আবেদন করেছি। যার মাধ্যমে ভাড়া নির্ধারণ, গাড়ির ফিটনেস নিয়ে নির্দেশনা আসার কথা। কিন্তু রিটে কোনো নির্দেশনা এখনো আসেনি। অন্যদিকে বিআরটিএ আমাদের কখনো এ বিষয়ে ডাকেনি।”

যা বলছে বিআরটিএ

এ বিষয়ে বিআরটিএর পরিচালক (রোড সেফটি) মো. মাহবুব-ই-রাব্বানী সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “অ্যাম্বুলেন্সের ভাড়া আমরা নির্ধারণ করিনি। আর এই বিষয়টি ইঞ্জিনিয়ারিং শাখা দেখে।”

মো. মাহবুব-ই-রাব্বানী বলেন, “কন্ট্রাক্টে যে পরিবহনগুলো সারা দেশে চলে, সেগুলোতে ভাড়া নির্ধারণ করা যায় না। যেমন ট্রাকের ভাড়া নির্ধারণ করা যায় না। কিছু কিছু বিষয় আছে, যা ডিমান্ড সাপ্লাইয়ের ওপর নির্ভর করে। ট্রাক এক রোডে একেক দিন একেক রকম ভাড়া হয়। অ্যাম্বুলেন্সও এই ধরনের। কাজেই এ ক্ষেত্রে যে ভাড়া নির্ধারণ করা খুব কঠিন, তারপরও তারা যে দাবি নিয়ে চিঠি দিয়েছে, এ বিষয়টি আমার জানা নেই।”

তবে সব অ্যাম্বুলেন্সই পেট্রলে চলে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।

Link copied!