• ঢাকা
  • সোমবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৪, ১০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

গৌরবের হাজারো স্মৃতি রক্ষিত আছে যেখানে


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২২, ১১:৫৮ এএম
গৌরবের হাজারো স্মৃতি রক্ষিত আছে যেখানে

ভাষা আন্দোলন বাঙালি জাতির গৌরবগাঁথা অধ্যায়গুলোর একটি। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতির দাবিতে যে আন্দোলনে জীবন দিয়েছিলেন সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউরসহ অনেকে। মাতৃভাষার জন্য বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দেওয়ার এমন নজির পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। বাঙালি জাতির এমন গৌরবময় অধ্যায়েরই হাজারো স্মৃতি ধারণ করে আছে ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর’।

রাজধানীর ধানমন্ডি আবাসিক এলাকার কলাবাগান বাসস্ট্যান্ড সংলগ্ন ১০ নম্বর সড়কের ৫ নম্বর বাড়িতে গড়ে তোলা হয়েছে এই ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর’। বাড়ির নাম চমক-উ-কুঠীর। এটি ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের বাড়ি। তিনতলা বাড়ির নিচের দুটি কক্ষ তিনি জাদুঘরের জন্য ছেড়ে দেন। এটিই ভাষা আন্দোলন নিয়ে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে তোলা প্রথম জাদুঘর।

ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুব ২০০৬ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি এই জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। তবে জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার মাসখানেক পরেই তিনি মারা যান। এরপর থেকে জাদুঘরটির দেখাশোনা করছে তার পরিবার। এমনকি জাদুঘরটি পরিচালনার জন্য গঠন করা হয়েছে কাজী গোলাম মাহবুব ফাউন্ডেশন ট্রাস্ট। বর্তমানে এই ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন কাজী গোলাম মাহবুবের স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব। তাদের সন্তানরাই এই ট্রাস্টের ফান্ড সংগ্রহ করে থাকে।

‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের’ তত্ত্বাবধায়ক লিপি মাহবুব বলেন, “মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জাদুঘর থাকলেও, ভাষা সৈনিকদের জন্য সরকারিভাবে কোনো জাদুঘর নেই। অথচ ভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করেই এই মুক্তিযুদ্ধ আসে। তাই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক প্রয়াত কাজী গোলাম মাহবুব ভাষা সৈনিকের জন্য এই ভাষা আন্দোলন জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেন।”

লিপি মাহবুব আরো জানান, প্রথমে নিজের বাসভবনের নিচ তলার একটি কক্ষকে জাদুঘর হিসেবে গড়ে তোলেন কাজী গোলাম মাহবুব। কিন্তু একটি কক্ষে স্থান সংকুলান না হওয়ায় পরে ড্রয়িং রুমেরও একটি অংশ সংযুক্ত করা হয়।

লিপি মাহবুব জাদুঘরটির প্রয়াত নির্বাহী পরিচালক এম আর মাহবুবের স্ত্রী। এম আর মাহবুবের মৃত্যুর পর থেকে তিনিই এই জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়কের দায়িত্ব পালন করে আসছেন। তিনি জানান, পেয়ারী মাহবুব ও এম আর মাহবুব দেশের আনাচে-কানাচে ঘুরে ভাষা সৈনিকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন স্মৃতি, স্মারক, তথ্য ও তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র সংগ্রহ করেছে। বর্তমানে এই জাদুঘরে পাঁচশ’র বেশি ভাষা সৈনিকের জীবনীগ্রন্থ রয়েছে।”

শুধু ভাষা সৈনিকদের জীবনীগ্রন্থ নয়, জাদুঘরে স্তরে স্তরে সাজানো আছে ভাষা আন্দোলনের দুর্লভ প্রায় দুইশ ছবি। এর মধ্যে অন্যতম প্রথম শহীদ মিনারের ছবি। আছে ভাষা আন্দোলনের প্রথম বই এবং ভাষা আন্দোলনের মুখপাত্র সাপ্তাহিক সৈনিক ও নওবেলাল পত্রিকার মূল কপি। এছাড়া ভাষা আন্দোলনের ঘোষণাপত্র ও ইয়াহিয়া খানের টেপ রেকর্ডার, ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের ব্যবহৃত কোট, ডায়েরি, টুপি, সম্মাননা পদক, চাবির রিং ও অন্যান্য ভাষা সৈনিকদের ব্যবহৃত ডায়রি, কলম, ট্যাজিস্টারসহ বিভিন্ন জিনিসপত্র সংরক্ষিত আছে এখানে। রয়েছে ১৯৪৭-এর ১৫ সেপ্টেম্বর ভাষা আন্দোলনের পক্ষে তমদ্দুন মজলিশ কর্তৃক প্রকাশিত অধ্যাপক আবুল কাশেম, ড. কাজী মোতাহার হোসেন ও আবুল মনসুর আহমেদের লেখা ‘পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা না উর্দু’ শীর্ষক একটি গুরুত্বপূর্ণ পুস্তিকাও।

ইতিহাসের পাতা থেকে যাতে বাঙালির গৌরবময় অধ্যায়টি মুছে না যায়, তাই অমূল্য সব তথ্য, ছবি ও স্মারক এনে সংরক্ষণ করা হচ্ছে এই জাদুঘরে। এখানে যেমন প্রথম শহীদ মিনারের ছবি আছে, তেমনি আছে ভাষা অন্দোলনে শহীদ হওয়া আট বছরের ছোট শিশু অহিউল্লাহর প্রোর্ট্রেট। শিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে দিয়ে এই প্রোর্টেটটি তৈরি করেন ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর’ সংশ্লিষ্টরা।

এ বিষয়ে লিপি মাহবুব বলেন, “একুশে ফেব্রুয়ারির ওই মিছিলে সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, শফিউল্লাহদের সারিতে শিশু ওয়াহিউল্লাহও ছিলেন। ওই সময় তার বয়স ছিল আট বছর। উনিও পুলিশের গুলিতে সেদিন প্রাণ হারান। কিন্তু তার নামটা ইতিহাসের পাতায় কেউ আনেনি। একজন ভাষা সৈনিক এই তথ্যটা এম আর মাহবুবকে দিয়েছেন। তারপর তিনি শিশু ওয়াহিউল্লাহর এক চাচাকে খুঁজে বের করেছেন। যিনি পুরান ঢাকায় থাকতেন। শিশু ওয়াহিউল্লার কোনো ছবি না থাকায় সেই চাচার কাছ থেকে বর্ণনা নিয়ে তার একটি ছবি আঁকানো হয়।

সরকারি ছুটির দিন ছাড়া প্রতিদিন সকাল ৯টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত দর্শনার্থীদের জন্য খোলা থাকে এই ভাষা আন্দোলন জাদুঘর। এছাড়া ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করার জন্য যে কেউ আসতে পারেন এখানে। জাদুঘরে প্রবেশের জন্য কাউকেই কোনো প্রবেশ মূল্য দিতে হয় না। একদমই বিনামূল্যে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে চোখ বোলাতে পারেন দর্শনার্থীরা।

প্রবেশ মূল্য না রাখার কারণ হিসেবে লিপি মাহবুব বলেন, “অনেকটা মানবিক দিক বিবেচনা করে এই জাদুঘরের কোনো প্রবেশমূল্য রাখা হয়নি। কারণ এখানে আসা বেশিরভাগ দর্শনার্থীই স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী। অন্যান্য জাদুঘরে প্রবেশ করতে পাঁচ-দশ টাকা প্রবেশ মূল্য দিতে হলেও এটি একজন শিক্ষার্থীর কাছে অনেক টাকা। শিক্ষার্থীরা যাতে নির্দ্বিধায় ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারেন তাই জাদুঘরের প্রতিষ্ঠাতারা কোনো প্রবেশ মূল্য রাখেননি।”

ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরে এলেই দর্শনার্থীরা কিছু সময়ের জন্য ১৯৫২ সালের সেই উত্তাল দিনগুলিতে ফিরে যাওয়ার অনুভূতি পাবেন। তবে মাত্র দুটি কক্ষে জাদুঘরের সকল দলিল, বই, ছবি গাদাগাদি করে রাখায় প্রয়োজনীয় বই খুঁজে পেতে অনেকটাই বেগ পেতে হয় দর্শনার্থীদের।

জাদুঘরের তত্ত্বাবধায়ক লিপি মাহবুব বলেন, “ছোট দুইটি ঘরে তো জাদুঘর করা সম্ভব না। জাদুঘরটি প্রতিষ্ঠার সময় এর জন্য সরকারের কাছে জায়গার আবেদন করা হয়েছে। সরকার শুধু জায়গা দিবে, আর এর রক্ষণাবেক্ষণসহ যাবতীয় কাজ কাজী গোলাম মাহবুবের পরিবার বহন করে নিয়ে যাবে। কিন্তু সরকার এখন পর্যন্ত কোনো জায়গা দেয়নি। তারপরও আমরা আশাবাদী, সরকার জাদুঘরের জন্য তারা একটি জায়গা বরাদ্দ করবে। তখন আমরা বইসহ যাবতীয় সকল কিছু সাজিয়ে রাখতে পারবো।”

লিপি মাহবুব আরো জানান, এই গবেষণা কেন্দ্রের অন্যতম সফলতা ভাষা সৈনিকদের নামে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কের নামকরণ। এছাড়া প্রতি বছর ভাষার মাস এলেই এখানে ভাষা সৈনিক ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের নিয়ে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে কুইজ প্রতিযোগিতা হয়। বিজয়ীদের পুরস্কৃত করা হয়। ভাষা সৈনিকদের একটি মিলন মেলার আয়োজন করা হয়। তখন সারাদেশ থেকে ভাষা সৈনিকরা এখানে আসেন। তারা শিক্ষার্থীদের ভাষা আন্দোলনের উত্তাল দিনগুলোর গল্প বলেন।

শুধু ভাষা আন্দোলনের তথ্য-উপাত্ত ও স্মারক সংরক্ষণ নয়, এখানে ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে গবেষণাও হয়। এই জাদুঘর থেকে ভাষা আন্দোলনের বিষয়ে এখন পর্যন্ত ৫৮টি বই প্রকাশিত হয়েছে। লিপি মাহবুব বলেন, “এম আর মাহবুব বিভিন্ন জায়গায় গিয়ে ভাষা সৈনিকদের সঙ্গে কথা বলে তথ্য সংগ্রহ করেছেন। ভাষা আন্দোলন নিয়ে গবেষণা করেছেন। ভাষা সৈনিকদের স্মৃতিচারণামূলক সাক্ষাৎকার ও জীবন বৃত্তান্ত নিয়ে জাদুঘর থেকে প্রকাশ করেছেন ‘যারা অমর ভাষা সংগ্রামে’ গ্রন্থ।”

‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরে’র চেয়ারম্যান ও ভাষা সৈনিক কাজী গোলাম মাহবুবের স্ত্রী পেয়ারী মাহবুব বলেন, “এই জাদুঘর তৈরির জন্য আমি এবং এম আর মাহবুব অনেক কষ্ট করছি। আমরা ভাষা সৈনিকের বাসায় গিয়ে তাদের কাছ থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করেছি। শুধু এই প্রজন্ম নয়, পরের প্রজন্মও যাতে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সম্পর্কে জানতে পারে সেই উদ্দেশ্যে এই জাদুঘর তৈরি করা।”

ভাষা সৈনিকদের জন্য এই জাদুঘর করতে পেরে নিজেকে গর্বিত মনে করেন পেয়ারী মাহবুব। তিনি বলেন, “ভাষা সৈনিকের কাছে আমি যখন তথ্য-উপাত্ত ও বিভিন্ন সরঞ্জাম আনতে গিয়েছি, তখন তারা খুব আগ্রহ নিয়ে আমার সঙ্গে কথা বলেছেন, তাদের ব্যবহারের জিনিসপত্র দিয়েছেন। অনেকে এই জাদুঘরে এসেও তাদের ব্যবহৃত জিনিসপত্র দিয়ে গেছেন। ভাষা আন্দোলন ও ভাষা সৈনিকদের নিয়ে এমন একটা জাদুঘর তৈরি করতে পেরে আমি খুবই গর্বিত।”

জাদুঘরের জন্য সরকারের কাছে জায়গা বরাদ্দ চেয়েও না পাওয়ায় আক্ষেপ প্রকাশ করেন পেয়ারী মাহবুব। তিনি বলেন, “এই গবেষণা কেন্দ্র আমি চালিয়ে যাবে। আমার অবর্তমানে আমার ছেলে-মেয়েরা এটি চালিয়ে যাবে। শুধু একটা আক্ষেপ, এই জাদুঘরের জন্য সরকারের কাছে জায়গা চেয়েছিলাম। কিন্তু সরকার সেটি দেয়নি। তাই দুইটি কক্ষেই জাদুঘরের সকল জিনিসপত্র, তথ্য-উপাত্ত ও দলিল রাখা। একটু বড় জায়গা পেলে এই ঐতিহাসিক অধ্যায় আমরা আরো সুন্দর করে নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরতে পারতাম।”

জাতির ইতিহাস সংরক্ষণে জাদুঘর গুরুত্ব অপরিসীম। যেখান থেকে প্রজন্মের পর প্রজন্ম খুঁজে নিতে পারে নিজের অস্তিত্ব। তাই বাঙালি জাতির গর্বিত অধ্যায় নিয়ে তৈরি করা ‘ভাষা আন্দোলন গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর’ সংরক্ষণে সরকারের এগিয়ে আসা উচিত বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
 

Link copied!