• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

ময়লার পাহাড় কারওয়ান বাজারে : দুর্ঘটনা-আন্দোলনই কি কারণ?


সুব্রত চন্দ
প্রকাশিত: নভেম্বর ২৯, ২০২১, ০৬:১৫ পিএম
ময়লার পাহাড় কারওয়ান বাজারে : দুর্ঘটনা-আন্দোলনই কি কারণ?
কারওয়ান বাজারের ভেতর ময়লা জমছে। ছবি: সংবাদ প্রকাশ

রাজধানীর কারওয়ান বাজারের ভেতরে মূল রাস্তার অর্ধেকটাই এখন ময়লা স্তূপে ভর্তি। গত চার দিন ধরেই জমছে কাঁচাবাজারের সব বর্জ্য। সিটি করপোরেশনের পক্ষ থেকে এসব ময়লা সরানোর দায়িত্ব থাকলেও কেউ এগুলো সরাচ্ছে না। বাজারের ব্যবসায়ীরা তো বটেই, বাজারে আসা ক্রেতা ও পথচারীদেরও পড়তে হচ্ছে ভীষণ অসুবিধায়।

কারওয়ান বাজারের ভেতরে শুধু কাঁচাবাজার নয়, রয়েছে মাছের আড়ৎ, ফলপট্টি, চালের আড়ৎ, হাঁস-মুরগিসহ মাংসের দোকান। এসব জায়গায় প্রতিদিন মাল বোঝাই ট্রাক আসে, মালামাল ওঠানামা করে। তাছাড়া লাখ লাখ মানুষ কারওয়ান বাজার থেকে কেনাকাটা করে। তাই প্রতিদিনই বিপুল পরিমাণ বর্জ্য উৎপন্ন হয় এই বাজারে। সেগুলো প্রতিদিনই সরিয়ে ফেলার দায়িত্ব উত্তর সিটি করপোরেশনের। কিন্তু গত চার দিন আগে দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির ধাক্কায় দুটি প্রাণ ঝড়ে যাওয়ার পর থেকেই ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ময়লা ব্যবস্থাপনা কিছু সময়ের জন্য থমকে যায়। পরে কিছু কিছু জায়গায় ঠিক হলেও, কারওয়ান বাজারের ময়লা আর কেউ সরাতে আসেনি।

সোমবার (২৯ নভেম্বর) সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, ফলপট্টি ও আলুপট্টির সামনের রাস্তায় বর্জ্য জমতে জমতে ভাগাড়ে পরিণত হয়েছে। এমনকি সেখানে থাকা ডিএনসিসির ময়লা রাখার ঘর বা সেকেন্ডারি ট্রান্সফার স্টেশনও (এসটিএস) ময়লা উপচে পড়ছে। তারপরও আবর্জনা অপসারণে নেই কোনো উদ্যোগ। বাজারজুড়ে ছড়িয়ে পড়েছে দুর্গন্ধ। ব্যবসায়ী ও ক্রেতাদের এই দুর্গন্ধ নাকে নিয়েই বেচাকেনা করতে হচ্ছে। আবার রাস্তার ওপর এসব আবর্জনা রাখায় চলাফেরাতেও ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে পথচারীদের, সৃষ্টি হচ্ছে যানজটের। রাস্তার ওপর ময়লা ছড়িয়ে পড়ায় গাড়ির চাকা পিছলে গিয়ে ঘটছে দুর্ঘটনা।

ছবি : সংবাদ প্রকাশ

পাইকারি সবজি ব্যবসায়ী জাহাঙ্গীর আলম বলেন, “গত চার দিন ধরে সিটি করপোরেশন ময়লা নিচ্ছে না। দোকানের সামনে ময়লার স্তূপ হয়ে আছে। অবস্থা এমন হয়েছে যে, এই ময়লার উপরেই আমাদের মালামাল রাখতে হচ্ছে। কিন্তু দুর্গন্ধে ক্রেতা আসছে না। আর দুই দিন এই অবস্থা থাকলে কারওয়ান বাজার পুরোপুরি ময়লার ভাগাড়ে পরিণত হবে। কারণ এখানে প্রতিদিন কয়েক টন বর্জ্য তৈরি হয়। এগুলো প্রতিদিন পরিষ্কার করা প্রয়োজন। কিন্তু গত কয়েক দিন সেটি না করায় ব্যবসায়ীদের যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি রোগ জীবাণু ছড়াচ্ছে।”

দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে কারওয়ান বাজারে সবজি নিয়ে আসেন ট্রাকচালক বাবু। তিনি বলেন, “এমনিতেই কারওয়ান বাজারে গাড়ি রাখার জায়গা পাওয়া যায় না। তার উপর চার দিন ধরে রাস্তায় ময়লা ফেলে রাখায় গাড়ি রাখারই জায়গা পাচ্ছি না। এতে যানজটের যেমন সৃষ্টি হচ্ছে, তেমনি চাকা পিছলে দুর্ঘটনাও ঘটছে। এছাড়া দুর্গন্ধ তো আছেই।”

কারওয়ান বাজারের পরিচ্ছন্নতাকর্মী আল আমিন বলেন, “আমরা দোকানের সামনে থেকে ময়লা নিয়ে রাস্তার ওপর রাখছি। কিন্তু সেগুলো নিয়ে যাওয়ার জন্য কোনো গাড়ি আসছে না। ময়লার কারণে ব্যবসায়ীরা ঠিকমতো পণ্য নামাতেও পারছে না আর বিক্রিও করতে পারছে না। এতে সবাই ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে।”

কেন এই ময়লা অপসারণ করা হচ্ছে না জিজ্ঞেস করলে আল আমিন বলেন, “শুনছি রাজধানীতে ময়লার গাড়ির চাপায় দুই জন মারা গেছে, তাই তারা ময়লা নিতে আসে না।”

বাজার করতে আসা হলিক্রস গার্লস স্কুলের শিক্ষিকা জুঁই ডি’কস্তা বলেন, “এটা সাধারণ মানুষের জন্য চরম দুর্ভোগ। কারণ প্রতিদিন বর্জ্য তৈরি হচ্ছে। এটা যদি প্রতিদিন পরিষ্কার করা না হয়, তাহলে আমাদের তো ভোগান্তি পোহাতেই হবে। সিটি করপোরেশনের উচিত এসব বর্জ্য দ্রুত অপসারণ করা।”

ছবি : সংবাদ প্রকাশ

হাসান নামের আরেক ব্যক্তি বলেন, “অদক্ষ চালক-পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে সিটি করপোরেশন গাড়ি চালাবে, রাস্তায় মানুষ মারবে, আবার সেটার প্রতিবাদ করলে অযথা সাধারণ মানুষকে ভোগান্তিতে ফেলবে— এটা তো হতে পারে না। সিটি করপোরেশনের এই ধরনের গোড়ামি, পাগলামি থেকে বেরিয়ে আসতে হবে।”

অভিযোগ আছে, সম্প্রতি ময়লার গাড়ির চাপায় দুই জন নিহত ও একে কেন্দ্র করে নিরাপদ সড়ক আন্দোলন শুরু হলে বিভিন্ন এলাকায় বর্জ্য অপসারণ বন্ধ করে দেয় সিটি করপোরেশন। ঘটনা ঘটার দুই দিনের মধ্যেই আবার বর্জ্য অপসারণ শুরু হলেও পাল্টায়নি কারওয়ান বাজরের চিত্র।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক সিটি করপোরেশনের একাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারী গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, অদক্ষ চালক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়ে ময়লা পরিবহনের সমালোচনা এড়াতে এবং বর্জ্য অপসারণ না করলে নগরবাসীর কেমন দুর্ভোগ হয়, সেটি বোঝাতেই ময়লা ফেলে রাখার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সিটি করপোরেশন। বর্জ্যের স্তূপে অতিষ্ঠ হয়ে যখন নগরবাসী সমালোচনা শুরু করবে, তখন আবার ওইসব অদক্ষ চালক ও পরিচ্ছন্নতাকর্মী দিয়েই বর্জ্য অপসারণ করার চিন্তাভাবনা তাদের।

এ বিষয়ে ডিএনসিসির বর্জ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী (অতিরিক্ত দায়িত্ব) এস. এম. শফিকুর রহমানের কাছে জানতে চাইলে তিনি প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলার পরামর্শ দেন।

তবে প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা কমডোর এস এম শরিফ-উল ইসলাম ও অতিরিক্ত প্রধান বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কর্মকর্তা মোহাম্মাাদ আরিফুর রহমানের সঙ্গে বেশ কয়েকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তারা কেউ ফোন ধরেননি।

গত বুধবার গুলিস্তানে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ময়লার গাড়ির চাপায় প্রাণ হারান নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নাঈম হাসান (১৭)। এই ঘটনায় ময়লার গাড়িটির মূল চালক মো. হারুন ও সহকারী মো. রাসেলকে গ্রেপ্তার করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তাদের দুজনের কারোই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল না বলে সংবাদ সম্মেলনে জানায় র‌্যাব।

নটর ডেম কলেজের শিক্ষার্থী নিহতের একদিন পরেই বৃহস্পতিবার পান্থপথের বসুন্ধরা সিটি শপিংমলের উল্টো দিকে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় মারা যান সংবাদকর্মী আহসান কবির খান। এই ঘটনায়ও গাড়িটির চালক মো. হানিফ ওরফে ফটিককে (২৩) গ্রেপ্তার করা হয়। পরে র‌্যাব সংবাদ সম্মেলন করে জানায়, হানিফ সিটি করপোরেশনের তালিকাভুক্ত কর্মচারী ছিলেন না। এমনকি তার ভারী যান চালানোর কোনো লাইসেন্সও নেই।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ট্রাফিক বিভাগের দেওয়া তথ্য অনুসারে, গত পাঁচ বছরে ঢাকা দুই সিটি করপোরেশনের ময়লার গাড়ির চাপায় রাজধানীতে প্রাণ হারিয়েছে অন্তত ২৭ জন। আহত হয়েছে ৪৩ জন। অদক্ষ চালকের বেপোরোয়া গাড়ি চালানার জন্যই এসব দুর্ঘটনা ঘটেছে বলে বিভিন্ন গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন ডিএমপির একাধিক পুলিশ কর্মকর্তা।

 

 

Link copied!