• ঢাকা
  • রবিবার, ১৫ ডিসেম্বর, ২০২৪, ৩০ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ভালো অভিনয় করে টাকাও পেয়েছিলেন ‘সিরিয়াল কিলার’


সংবাদ প্রকাশ ডেস্ক
প্রকাশিত: জানুয়ারি ১৩, ২০২২, ০৭:৩৫ পিএম
ভালো অভিনয় করে টাকাও পেয়েছিলেন ‘সিরিয়াল কিলার’

বছর ছয়েক আগে শুটিংয়ের সময় ঘূনাক্ষরেও বোঝা যায়নি লোকটি একজন ভয়ংকর খুনি। ২০১৬ সালে ইউটিউবে মুক্তি পাওয়া ‘ভাঙা তরী ছেঁড়া পাল’ গানের মিউজিক ভিডিওতে ফকির বা দরবেশের বেশে একজনকে দেখা যায়। তার নাম হেলাল ফকির। 

মিউজিক ভিডিওটি নির্মাণ করেছিলেন নোমান রবিন। নারায়ণগঞ্জ রেললাইনে চলছিল মিউজিক ভিডিওর শুটিং। ওই সময় স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে ওই লোকটিকেও শুটিংয়ে নেওয়া হয়। লোকটির পারফর্মেন্স এতো ভালো লেগেছিল যে শুটিং টিমের পক্ষ থেকে তাকে এক হাজার টাকাও দেওয়া হয়। কিন্তু সেসময় একবারের জন্যও কারো মনে সন্দেহ জাগেনি যে তিনি এতো বড় খুনি।

নির্মাতা রবিন সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “আমাদের ভিডিওর জন্য একজন সাধুর দরকার ছিল। রেললাইনের পাশ থেকে সাদা কাপড় পরা এক ব্যক্তিকে তখন স্থানীয় মানুষ আমার কাছে নিয়ে আসে। তার পরনের সাদা কাপড়টি একদম সাধুদের মত ছিল। বেশভূষাও সেরকম। যা আমাদের চরিত্রের সঙ্গে একদম মানানসই। ওই লোক বেশ ভালো অভিনয় করেছিলেন। এই চরিত্রের জন্য কোন বাজেট না থাকলেও আমি তাকে এক হাজার টাকা দিয়েছিলাম। আজ শোনা গেল সে সিরিয়াল কিলার।”

কে এই হেলাল হোসেন
অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছেন হেলাল হোসেন। তার বাড়ি বগুড়ায়। এক সময় মুদিখানার দোকান চালাতেন তিনি। পরে হত্যাসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন। গ্রেফতার এড়াতে ছদ্মবেশে বিভিন্ন মাজার ও রেলওয়ে স্টেশনে থাকা শুরু করেন। কেউ যাতে তার চেহারা চিনতে না পারেন, সেজন্য লম্বা দাঁড়ি ও চুল। 

যেভাবে ধরা পড়লেন
মিউজিক ভিডিও দেখে স্থানীয়রা শনাক্ত করেন বাউল ছদ্মবেশী সেলিম ফকির আসলে একজন খুনি। তিনিই খুনি হেলাল। স্থানীয়দের তথ্য ধরে ছয় মাস চেষ্টার পর র‍্যাবের গোয়েন্দারা তার অবস্থান শনাক্ত করতে সক্ষম হন।

গত বুধবার (১২ জানুয়ারি) রাতে কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশন এলাকা থেকে হেলাল হোসেন ওরফে খুনি হেলাল ওরফে সেলিম ফকিরকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়নের একটি দল (র‍্যাব)।

বৃহস্পতিবার (১৩ জানুয়ারি) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজার র‍্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

খন্দকার আল মঈন জানান, ছয় মাস আগে এক ব্যক্তি ইউটিউবে প্রচারিত একটি গানের বাউল মডেল সম্পর্কে র‍্যাবের কাছে তথ্য দেন। তখন জানানো হয়, এই বাউল মডেল সম্ভবত বগুড়ার বিদ্যুৎ হত্যা মামলার আসামি। অভিযোগ পেয়ে র্যাব ছায়া তদন্ত শুরু করে। একপর্যায়ে ঘটনার সত্যতা সম্পর্কে নিশ্চিত হয় র্যাব।

হেলালের বিরুদ্ধে যত অভিযোগ
র‍্যাব জানিয়েছে, হেলাল হোসেনের বিরুদ্ধে তিনটি হত্যা মামলা রয়েছে। এরমধ্যে একটি হত্যা মামলায় তার সাজাও দিয়েছেন আদালত। এছাড়া আরও দুটি ফৌজদারি অপরাধের মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে।

র‍্যাবের কমান্ডার জানান, তিনটি হত্যাকাণ্ড, যৌন হয়রানিসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িয়ে পড়েন বগুড়ার হেলাল হোসেন (৪৫)। ‘খুনি হেলাল’, ‘দুর্ধর্ষ হেলাল’ নামে এলাকায় পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি। এরপর বাউলের বেশ ধরেন হেলাল। তবে বাউলের বেশ ধারণের পর তিনি ‘সেলিম ফকির’ নামে পরিচিত হয়ে ওঠেন। পথে পথে ঘোরার পর থিতু হন রেলওয়ে স্টেশনে। গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতেন হেলাল ওরফে সেলিম ফকির। গানের গলা ভালো হওয়ায় নজরে পড়েন এক ইউটিউবারের। তার হাত ধরেই শুরু করেন বাউল গানের মডেলিং।

তবে হেলালের কপাল পোড়ে ‘ভাঙ্গা তরী ছেড়া পাল’ গানে বাউল মডেল হিসেবে অভিনয়ের পর। প্রায় পাঁচ বছর আগে মডেলিং করা তার এই গানটি বছরখানেক আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। তার গান ভাইরাল হওয়াই কাল হয় হেলালের। পরিচিতজনরা তাকে চিনে ফেলেন। তার পরিচয় নিশ্চিত হন স্থানীয়রা। এরপর হেলালের বেশভূষা বদলের তথ্য-প্রমাণসহ অভিযোগ করেন র‍্যাবে।

যে কারণে খুনি হলেন হেলাল
র‍্যাবের এই কর্মকর্তা আরও জানান, ২০০১ সালে বগুড়ায় আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে মাহমুদুল হাসান বিদ্যুৎকে পূর্ব পরিকল্পনা অনুযায়ী ধারালো অস্ত্র দিয়ে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যাকাণ্ডে নিহতের পরিবারের একজন সদস্য বাদী হয়ে বগুড়া সদর থানায় হত্যা মামলা করেন। এ মামলায় আদালত তাকে যাবজ্জীবন সাজা দেয়। ২০০৬ সালে রবিউল নামে এক ব্যক্তিকে দুর্বৃত্তরা কুপিয়ে হত্যা করে। সেই মামলায়ও হেলাল চার্জশিটভুক্ত আসামি।

এছাড়া ১৯৯৭ সালে বগুড়ার বিষ্ণু হত্যা মামলারও এজাহারভুক্ত আসামি তিনি। আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে এই হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হয়। এছাড়া ২০১০ সালে বগুড়া সদর থানায় একটি চুরির মামলায় ২০১৫ সালে গ্রেফতার হন হেলাল ওরফে বাউল হেলাল। তাছাড়া নারী নির্যাতন আইনেও তার বিরুদ্ধে একটি মামলা রয়েছে। খুনসহ বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের কারণে নিজ এলাকায় ‘দুর্ধর্ষ হেলাল’, ‘খুনি হেলাল’ নামে পরিচিতি পান তিনি।

যেভাবে ছদ্মবেশ নেন হেলাল
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাবকে হেলাল জানিয়েছে, প্রথমে তিনি বগুড়া থেকে ট্রেনে ঢাকার কমলাপুর রেলওয়ে স্টেশনে আসেন। পরে কমলাপুর থেকে ট্রেনে চট্টগ্রামে চলে যান। সেখানে আমানত শাহের মাজারে ছদ্মবেশ ধারণ করে বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। পরে ট্রেনে সিলেটের শাহজালাল মাজারে চলে যান। সেখানে ছদ্মবেশ ধারণ করে আরও কিছুদিন অবস্থান করেন। এভাবে তিনি বিভিন্ন রেলস্টেশন ও মাজারে ছদ্মবেশে অবস্থান করেন।

যাবজ্জীবন দণ্ডের পর পলাতক হেলাল প্রায় ৭ বছর ফেরারী জীবনযাপন করেছেন। সর্বশেষ চার বছর তিনি কাটিয়ছেন কিশোরগঞ্জের ভৈরব রেলওয়ে স্টেশনে। সেখানে স্টেশনের পাশেই এক নারীকে বিয়ে করে সংসার শুরু করেন হেলাল। স্টেশনে বাউল গান শুনিয়ে মানুষের থেকে পাওয়া অর্থে চলতো তার সংসার।

Link copied!