রাজধানী মহাখালীর রেলগেট এলাকা। সেখান থেকে হেঁটে আমতলী এসেছেন রুনা আক্তার। কোলে তার ২ বছরের বাচ্চা। উদ্দেশ্য টিসিবির ট্রাক থেকে কম টাকায় তেল, ডাল কেনা।
সকাল থেকে বেলা গড়িয়ে দুপুর। টিসিবির গাড়ি আসেনি। এই নিয়ে তিন দিন তেল-ডালের অপেক্ষায় রুনা আক্তার। আক্ষেপ করে সংবাদ প্রকাশকে তিনি বলেন, “কম দামে তেল-ডাল কেনার জন্য ৩ দিন ধরে আসলাম কিন্তু কিছুই কিনতে পারলাম না। আজকেও সারাদিন দাঁড়িয়ে থাকাটাই বৃথা গেছে।”
শুধু রুনা আক্তার নয়, তার মতো প্রায় ২০০ জন দাঁড়িয়ে ছিলেন টিসিবির গাড়ির অপেক্ষায়। যার মধ্যে ছিলো বয়োবৃদ্ধ, নারী, শিশু, এমনকি অসুস্থ ব্যক্তিও। বৃহস্পতিবার (১০ মার্চ) আমতলী মোড়ে এই প্রতিবেদক সরেজমিনে এমন চিত্র দেখতে পান।
জহির উদ্দিন নামের এক ভদ্রলোক সাততলা থেকে এসেছেন। তিনি বলেন, “সবাইতো টিসিবির পণ্য কিনতে পারে না। আবার অনেক সময় কেনার আগেই পণ্য শেষ হয়ে যায়। তখন খালি হাতে ফিরে যেতে হয়।”
যারা সরকারি চাকরি করে তারা নিম্নবিত্ততে কম টাকার পণ্যে ভাগ বসায় বলে জানায় রাশেদা বেগম। এই নারী অভিযোগ করে বলেন, “আমি এর আগে টিসিবির পণ্য কিনেছি। তবে দেখেছি যে, যারা সরকারি চাকরি করে এবং এলাকার নেতারাও পণ্য কিনতে আসে। আর এতে করে আমাদের অনেক সমস্যা হয়। আমরা যারা নিম্নবিত্ত তারা অনেকেই পণ্য ভাগে পাই না কেনার জন্য। কারণ নেতারা আসলে তো তাদের আর সিরিয়ালে দাঁড়াতে হয় না এবং কোনো টোকেনও লাগে না।”
সারাদিন লাইনে দাঁড়িয়েও অনেকেই শেষ পর্যন্ত নিতে পারেন না প্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্য। বিক্রেতাদের সঙ্গে যোগসাজশে অনেকেই নিয়ে যায় পণ্য। বশির মিয়া নামের এক ব্যক্তি বলেন, “সারাদিন সিরিয়ালে দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য কিনতে পারি না। অথচ অনেকেই মাঝখান দিয়ে এসে পণ্য কিনে নিয়ে যায়। বয়স হয়ে গেছে এখন। মারামারি করে তো আর কিনতে পারবো না। গাড়িও সময়মতো আসে না। একেক দিন একেক সময় আসে। তবে এজন্য টিসিবি নতুন কোনো ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।”
পারভীন সুলতানা নামের আরেক নারী বলেন, “আমার মাসে তেলের বোতল লাগে তিনটা। দুইটা কিনতে পারলেও বাইরে থেকে ১টা কেনা লাগে। আবার এখন খোলা তেলও বিক্রি হয় না।”
মহাখালীর বেশ কয়েকটি জায়গাতে টিসিবির পণ্য বিক্রি হয়। ওয়্যারলেস এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, পণ্যবাহী গাড়ির পেছনে লম্বা লাইন। সকাল থেকে অপেক্ষায় আছেন পণ্য কেনার জন্য। দায়িত্বরত যারা আছেন ক্রেতাদের হাতে কালি দিয়ে দাগ চিহ্ন দিচ্ছেন যেন দ্বিতীয়বার না কিনতে পারে।
প্রায় তিন ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থেকে পণ্য পেয়ে খুশি মেহেরুন্নেসা নামের এক গৃহকর্মী। তিনি ২ কেজি করে তেল, মসুর ডাল, চিনি এবং ৫ কেজি পেঁয়াজ কিনেছেন। তিনি জানান, পণ্য কিনতে অনেক অপেক্ষা করতে হয় এবং অনেক সময় পণ্য শেষ হয়ে যায়। তখন সময়টাও বৃথা যায়।
অপেক্ষারত সবুজ মিয়া জানান, তিনি একটি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানে চাকরি করতেন। সংসারে সচ্ছলতা ছিল। করোনার সময়টাতে চাকরি চলে গেছে। এখন স্ত্রীর একার আয়ে সংসার চলে। তিনি বলেন, “বাসাভাড়াটা মাসের শুরুতে দিয়ে দেই। এরপর খাইলে খাইলাম, না খাইলে নাই।”
টিসিবির ডিলার মো. মহসীন বলেন, “প্রতিটি ট্রাকে ১ হাজার কেজি পেয়াজ, ৫০০ লিটার তেল অর্থাৎ ২৫০ বোতল, ৫০০ কেজি চিনি ও ৫০০ কেজি মসুর ডালসহ মোট ২৫০০ কেজি পরিমাণ পণ্য বরাদ্দ থাকে। বাজারের তুলনায় আমরা কমদামে বিক্রি করছি। সে কারণে অনেক ভিড় থাকে। আমাদেরও কষ্ট হয় যে সবাইকে আমরা দিতে পারি না। প্রতিজনকে পেঁয়াজ ৫ কেজি, তেল ২ লিটার, ২ কেজি চিনি ও ২ কেজি মসুর ডাল দিচ্ছি।”
ঢাকায় টিসিবি ভর্তুকি মূল্যে সয়াবিন তেল, চিনি, ডাল ও পেঁয়াজ বিক্রি করে। টিসিবির ট্রাক থেকে দুই লিটার সয়াবিন তেল কেনা যায় ২২০ টাকায়, বাজারে যা ৩৩০ টাকা। টিসিবি চিনি বিক্রি করে ৫৫ টাকা কেজিতে। বাজার থেকে চিনি কিনতে দাম পড়ে কেজিপ্রতি ৭৮ থেকে ৮০ টাকা। টিসিবি মসুর ডাল বিক্রি করে ৬৫ টাকায়, যা বাজারে ৯৫ টাকার নিচে পাওয়া যায় না। বাজার থেকে যে পেঁয়াজ কিনতে ৫০ টাকা লাগে, একই পেঁয়াজ টিসিবির ট্রাক থেকে ৩০ টাকায় কেনা যায়।
দেশের বাজারে সম্প্রতি নিত্যপণ্যের দাম ব্যাপকভাবে বেড়ে যাওয়ায় টিসিবির ট্রাকের পেছনে দীর্ঘ লাইন তৈরি হচ্ছে। অবশ্য সে তুলনায় পণ্য বরাদ্দ কম থাকে। দিনে একটি ট্রাকে যে পরিমাণ পণ্য দেওয়া হয় তা দিয়ে ২৫০ জন ক্রেতার চাহিদা মেটানো যায়।
তবে রমজান মাসকে সামনে রেখে পণ্য বিক্রিতে পরিবর্তন আনছে টিসিবি। এবার তালিকা করে স্বল্প আয়ের পরিবারকে দেওয়া হবে ফ্যামিলি কার্ড। যা দিয়ে সুলভ মূল্যে পণ্য কিনতে পারবেন তারা। এরইমধ্যে জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে তৈরি হচ্ছে সেই তালিকা। ১৫ মার্চ থেকে নতুন পদ্ধতিতে প্রথম ধাপের বিপণন শুরু হবে বলে সংবাদ প্রকাশকে জানান টিসিবির মুখপাত্র হুমায়ুন কবির।
হুমায়ুন কবির বলেন, “আসন্ন রমজান উপলক্ষে রাজধানীসহ দেশের সব জেলা, উপজেলা ও মহানগরে ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং মেম্বারদের সহযোগিতায় জেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে ১৫ মার্চ থেকে ফ্যামিলি কার্ডের মাধ্যমে প্রথম ধাপে টিসিবির ট্রাকে করে পণ্য বিক্রি শুরু হবে। চলবে ২৬ মার্চ পর্যন্ত। এরপর দ্বিতীয় ধাপের পণ্য বিক্রি শুরু হবে ২৭ মার্চ থেকে ২০ এপ্রিল পর্যন্ত।”
নিম্ন আয়ের পরিবারের কার্ড পাওয়া নিশ্চিত করার বিষয়ে জানতে চাইলে হুমায়ুন কবির বলেন, “উপজেলা প্রশাসন যেহেতু কার্ডে বিষয়টি দেখছে, তাদের নির্দিষ্ট গাইডলাইন দেওয়া আছে।”
তিনি আরও বলেন, “রমজানে ছোলা এবং খেজুরও যুক্ত হবে পণ্য বিক্রির তালিকায়। তবে শুধু রাজধানীতে খেজুর এবং সারাদেশে ছোলা বিক্রি করা হবে।”
জানা যায়, জেলা পর্যায়ে প্রতিটি পরিবার প্রথম ধাপে ২ লিটার তেল, ২ কেজি চিনি ও ২ কেজি মসুর ডাল পাবে। বাজারে নিত্যপণ্যের দাম বাড়লেও নতুন করে টিসিবির পণ্যের দাম বাড়ানো হবে না বলে নিশ্চিত করছেন মুখপাত্র।