রাজধানীতে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তেমন নেই বললেই চলে। খেলার মাঠ ও পার্কের অভাব চোখে পড়ে সিটি করপোরেশনের প্রত্যেক এলাকাতেই। তাই রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাউজক) থেকে আবাসন প্রকল্প অনুমোদনের সময় নাগরিক সব সুযোগ-সুবিধার অংশ হিসেবে স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক ও কবরস্থানের জন্য জায়গা রাখাটা বাধ্যতামূলক করা হয়। কিন্তু সেটার ব্যত্যয় ঘটাতে যাচ্ছে ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড। রাজধানীর হাতিরঝিলের কাছে তাদের মহানগর আবাসন প্রকল্প রয়েছে। রাজউক থেকে লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন নেওয়ার সময় প্রতিষ্ঠানটি মহানগর প্রজেক্টের নকশায় স্কুল ও খেলার মাঠ দেখালেও সম্প্রতি সেসব জায়গা প্লট আকারে বিক্রি করে দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছে, যা রাজউকের বিধিমালার পরিপন্থী।
অনুমোদিত নকশায় দেখানো হয়, প্রকল্পটির বি-ব্লকের বি-১০৬ প্লটটি বরাদ্দ করা হয়েছে স্কুলের জন্য। আর মাঠের জন্য বরাদ্দ করা হয় প্লট-বি-৮৭। স্কুল ও খেলার মাঠ মিলিয়ে জায়গার পরিমাণ ৬৮ কাঠা। সে অনুযায়ী ১৯৮০ সাল থেকে প্রতিষ্ঠানটি প্লট বিক্রি শুরু করে। বর্তমানে সেখানকার প্রায় প্রতিটি প্লটই বিক্রি হয়ে গেছে। সেসব প্লটে বাস করছে সাড়ে তিন হাজার পরিবার। কিন্তু হঠাৎ করে জমির দাম বাড়ায় স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দ করা জমি এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে না দিয়ে বিক্রির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দকৃত জমি বিক্রির এমন খবরে সংবাদ প্রকাশের কাছে ক্ষোভ প্রকাশ করেন এলাকাবাসী।
এলাকাবাসীর বক্তব্য
সৌদি আরব প্রবাসী মো. বিল্লাল হোসেন (৫২) ১৯৯৫ সালে রাজধানীর হাতিঝিলে পাশে অবস্থিত ইস্টার্ন হাউজিং মহানগর প্রজেক্টে এক নম্বর রোডের বি-ব্লকে আড়াই কাঠা জমি কেনেন, যার কাঠা প্রতি সেসময় দাম ছিল আড়াই লাখ টাকা। নিয়ম অনুযায়ী, জমি কেনার পর বাড়ি করেন বিল্লাল হোসেন। তার চার সন্তানের মধ্য ছোট সন্তানের নাম সুমাইয়া আক্তার (৮)। তাদের বাসা মহানগর প্রজেক্টে হলেও পড়াশোনা করে রামপুরা বনশ্রীতে অবস্থিত নিবরাস মাদরাসায়। অথচ প্রকল্পের ভেতরেই তাদের বিদ্যালয় থাকার কথা ছিল। প্লট কেনার ২৬ বছর পেরিয়ে গেলেও সেই সুবিধা পাননি বলে অভিযোগ করেছেন বিল্লালসহ আরও অনেকে। প্রজেক্টে কোনো স্কুল না থাকায় চার কিলোমিটার দূরের বনশ্রীতে সন্তান ভর্তি করাতে বাধ্য হচ্ছেন এলাকাবাসী। পাশাপাশি খেলার মাঠ নেই বলে, বিকেলে ঘরবন্দি সময় কাটাচ্ছে বাচ্চারা। এতে শিশু-কিশোরদের মানসিক বিকাশ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বলেও মনে করছেন অনেকে।
বিল্লাল হোসেনের অভিযোগ, “জমি কেনার সময় হাউজিং কোম্পানি নকশায় স্কুল ও বিশাল খেলার মাঠ দেখিয়েছে আমাদের। কিন্তু এত বছরেও স্কুল ও খেলার কোনো মাঠ দেখিনি। বি-ব্লকের শেষ মাথায় দেখিছে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য ৬৮ কাঠা বরাদ্দ আছে। কিন্তু হঠাৎ করে জানুয়ারি মাসে সাইন বোর্ড পাল্টে ফেলে তারা। সেখানে স্কুলের জন্য নির্ধারিত স্থান সাইন বোর্ড টাঙিয়ে ‘ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড-এর নিজস্ব সম্পত্তি বিনা অনুমতিতে প্রবেশ নিষেধ’—এই সাইনবোর্ড লাগিয়ে দেয়।”
মহানগর প্রকল্পে ২০ বছর ধরে বসবাস করছেন আব্দুল ওয়াদুদ (৭০)। বিল্লালের মতো তিনি বি-ব্লকে আড়াই কাঠা জমি কিনে বাড়ি করেন। বাড়ি করার পর পরিবার নিয়ে বসবাস করছেন সেখানেই। ২০ বছরেও স্কুল খোলা হয়নি বলে নাতি-নাতনি নিয়ে বিপাকে পড়েছেন সত্তর ঊর্ধ্ব ওয়াদুদ। সংবাদ প্রকাশের কাছে তিনি অভিযোগ করে বলেন, “আমাদের সবাইকে দেখিয়েছে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য ৬৮ কাঠা জমি রাখা আছে। কিন্তু হঠাৎ করে জমির দাম বাড়ায় স্কুলের জায়গায় সীমানা প্রাচীর তুলে সেটা বিক্রি করছে তারা। এদিকে আমাদের নাতি-নাতনিরা মাঠের অভাবে রাস্তায় খেলাধূলা করে।”
মহানগর আবাসিক সমাজ কল্যাণ সমিতির বক্তব্য
এই বিষয়টি নিয়ে মহানগর আবাসিক সমাজকল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. সোলাইমান সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী যেকোনো হাউজিং প্রজেক্ট অনুমোদনের সময় সকলের জন্য সুযোগ-সুবিধা হিসেবে স্কুল, খেলার মাঠ, পার্ক এবং কবরস্থান থাকা বাঞ্ছনীয়। সে মোতাবেক ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড কর্তৃক মহানগর প্রজেক্টের নকশা অনুমোদনের সময় স্কুল ও খেলার মাঠ দেখিয়ে রাজউক থেকে লে-আউট প্ল্যান অনুমোদন নেওয়া হয়।”
সোলাইমান আরো বলেন, “প্রকল্পের প্লট বিক্রির সময় এ সকল সুযোগ-সুবিধা উল্লেখ করে সাইন বোর্ড টাঙিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করা হয়েছিল। বর্তমানে স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটি সীমানা প্রাচীর দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে। কিন্তু দীর্ঘ দিন অতিবাহিত হলেও ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড কর্তৃক সুযোগ-সুবিধা হিসেবে বরাদ্দকৃত স্কুল ও খেলার মাঠটি এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে দেওয়া হচ্ছে না। ইদানীং এলাকাবাসীর মুখ থেকে জানা যাচ্ছে যে, স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দকৃত জায়গাটি অন্য কোনো ব্যক্তির কাছে বিক্রি বা বরাদ্দ দেওয়ার প্রক্রিয়া চলছে। ফলে এলাকাবাসীর মধ্যে উত্তেজনা বিরাজ করছে।”
সোলাইমান আরো অভিযোগ করেন, “৩৯৫টি প্লটে বাস করে সাড়ে তিন হাজার পরিবার। আর প্রতিটি পরিবারের সন্তান স্কুল না থাকায় অন্য এলাকায় গিয়ে তাদের পড়াশোনা করতে হচ্ছে। পাশাপাশি খেলার মাঠটি এলাকাবাসীর কাছে বুঝিয়ে না দেওয়ায় ছেলেমেয়েরা রাস্তায় খেলাধূলা করে। রাস্তায় খেলার কারণে অনেক সময় ঘটে দুর্ঘটনা। ফলে আমরা চাই ইস্টার্ন হাউজিং স্কুল ও খেলার মাঠটি বিক্রি না করে দ্রুত এলাকাবাসীকে বুঝিয়ে দিক।”
সোলাইমান যোগ করেন, “আগের সাইনবোর্ড সরিয়ে নতুন সাইন বোর্ড লাগানোর কারণে মহানগর আবাসিক সমাজকল্যাণ সমিতি থেকে প্রতিবাদ করা হয়। তখন ওইখানে হাউজিং কর্তৃক নিরাপত্তার জন্য সশস্ত্র আনসার সদস্য নিয়োগ করা হয়।”
নিরাপত্তার দায়িত্বে আনসার
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, স্কুলের জন্য রাখা জায়গার মূল ফটকে নিরাপত্তার দায়িত্বে আছেন দুইজন আনসার সদস্য। পুরো জায়গায় দেখা যায়, স্কুলের জন্য বরাদ্দ দেওয়া সাইন বোর্ডটি খুলে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের ‘নিজস্ব সম্পত্তি’র সাইন বোর্ড লাগানো। পাশাপাশি পুরো মাঠে বাসের খুঁটি বসিয়েছে কর্তৃপক্ষ।
নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা আনসার দলের কমান্ডার ইদ্রিস আলী বলেন, “আমরা জানুয়ারি মাসের ৫ তারিখ এখানে আসি। আমাদের বলা হয়েছে এখানে যাতে বাইরের কোনো লোক ঢুকতে না পারেন, সেটা খেয়াল রাখার জন্য। আমরা এখানে পর্যায়ক্রমে সাত জন ডিউটিতে আছি। এর বাইরে আমরা কিছু জানি না।”
আবাসন প্রকল্প নিয়ে মেয়র যা বলেছিলেন
সম্প্রতি ঢাকা মহানগর এলাকায় বিশদ অঞ্চল পরিকল্পনা বা ড্যাপের এক অনুষ্ঠানে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম বলেন, “রাজধানীর অনেক হাউজিং কোম্পানি মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করছে। তারা নকশায় অনেক লোভনীয় সেবা দেখিয়ে ক্রেতাদের প্রলুব্ধ করে। নকশায় স্কুল, খেলার মাঠ, মসজিদ, মাদরাসা, কবরস্থান দেখায়। তারপর জমির দাম বেড়ে গেলে কিছুই রাখে না, সব বিক্রি করে দেয়। এটা একধরনের প্রতারণা। এখন থেকে এইগুলো করা যাবে না। নকশায় যা থাকবে, তা শেষ পর্যন্ত ঠিক রাখতে হবে।”
ইস্টার্ন হাউজিংয়ের জবাব
ইস্টার্ন হাউজিং কোম্পানির নগর পরিকল্পনাবিদ রবিউল আওয়াল সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এলাকাবাসীর এমন অভিযোগ ভিত্তিহীন। স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য বরাদ্দ দেওয়া জায়গা বিক্রির কোনো সুযোগ নেই। প্রকল্প এলাকায় আমাদের স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য যে জমি বরাদ্দ ছিল, তা হাতিঝিল প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় সেনাবাহিনী ব্যবহার শুরু করে। এখনো পর্যন্ত সেই জমি তারাই ব্যবহার করছে। সেনাবাহিনী চলে গেলে আমরা স্কুল ও খেলার মাঠের জন্য জায়গা বুঝিয়ে দিতে পারবো।”
রবিউল আওয়াল আরো বলেন, “এলাকাবাসী যে জায়গা স্কুল ও খেলার মাঠ ব্যবহারের কথা বলছে, তা সম্পূর্ণ আমাদের নিজস্ব সম্পত্তি। এখানে তাদের অভিযোগ ভিত্তিহীন।”
তবে এলাকাবাসীর সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সেনাবাহিনীর অস্থায়ী ক্যাম্পটি করা হয়েছে এইচ-ব্লকে। আর স্কুল ও মাঠের জন্য রাজউক থেকে বরাদ্দকৃত জায়গাটি রয়েছে বি-ব্লকে।
এদিকে অস্থায়ী ক্যাম্পের সঙ্গে স্কুল ও মাঠের ৬৮ কাঠার কোনো সম্পর্ক নেই বলে জানান এলাকাবাসী।
ডিএনসিসির বক্তব্য
ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সেলিম রেজা সংবাদ প্রকাশকে বলেন, “এলাকাবাসী আমাদের কাছে ইস্টার্ন হাউজিংয়ের বিরুদ্ধে একটা লিখিত আবেদন করেছে। আমরা পরবর্তী সময়ে ওই হাউজিংয়ের কাছে ব্যাখ্যা চেয়েছি। পাশাপাশি রাউজককেও চিঠি দিয়েছি। চিঠির জবাব পেলে আমরা ব্যবস্থা নেবো।”
রাজউকের বক্তব্য
রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) বেসরকারি আবাসিক প্রকল্পের বিধিমালা প্রণয়ন করে ২০০৪ সালে। বিধিমালার ৩য় অধ্যায়ে লেখা আছে—“আবাসিক প্রকল্প এলাকা যত ক্ষুদ্র হউক না কেন ইহাতে ন্যূনতম একটি নার্সারি স্কুল, খেলার মাঠ থাকতে হবে। নিরুপিত জনসংখ্যার ভিত্তিতে কাঁচাবাজার, মার্কেট, কমিউনিটি সেন্টার, ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান, কবরস্থান ইত্যাদির জন্য প্রয়জনীয় জায়গা সংরক্ষণ ও নির্মাণ করতে হবে।”
রাউজক অনুমোদিত হাউজিং প্রজেক্টে যে সুযোগ-সুবিধা থাকার কথা, তা যদি না থাকে, তাহলে কী ধরনের ব্যবস্থা রাজউকের নেওয়া উচিত, তা নিয়ে সংবাদ প্রকাশকে রাউজক চেয়ারম্যান এ বি এম আমিন উল্লাহ নুরী বলেন, “প্রতিটি প্রকল্প অনুমোদনের সময় বিধিমালা অনুযায়ী অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপরে নকশা পরিবর্তন করে কেউ যদি প্লট বিক্রি করে, তাহলে রাজউক ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করবে।”