সরকারি পাঁচ ব্যাংকের সমন্বিত নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর একে একে বেরিয়ে আসছে রাঘববোয়ালদের নাম। এবার এই প্রশ্ন ফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) এক শিক্ষকের বিরুদ্ধে।
নিখিল রঞ্জন ধর নামের ওই শিক্ষক বুয়েটের ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যান্ড প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ারিং (আইপিই) বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান। পাশাপাশি তিনি আহছানউল্লাহ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (এইউএসটি) খণ্ডকালীন চুক্তিভিত্তিক কাজ করেন। নিখিলের মাধ্যমেই এইউএসটি সমন্বিত পাঁচ ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির টেন্ডারগুলো পায় এবং এই বিশ্ববিদ্যালয় থেকেই ফাঁস হয় প্রশ্ন।
৬ নভেম্বর বিকেলে রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের অধীন সরকারি পাঁচ ব্যাংকের অফিসার (ক্যাশ) পদের নিয়োগ (প্রিলিমিনারি) পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। এতে অংশ নেন ১ লাখ ১৬ হাজার ৪২৭ জন পরীক্ষার্থী। পরে পরীক্ষার্থীরা প্রশ্নপত্রফাঁসের অভিযোগ তুললে তদন্তে নামে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) তেজগাঁও গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। তদন্তে নেমে প্রশ্ন ফাঁসের সত্যতাও পায় আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।
এরপর প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেপ্তারে ওই দিন থেকেই অভিযানে নামে ডিবি। গত ৬ নভেম্বর থেকে ১০ নভেম্বর চার দিন অভিযান চালিয়ে গ্রেপ্তার করা হয় শামসুল হক শ্যামল, মোস্তাফিজুর রহমান মিলন, মোক্তারুজ্জামান রয়েল, জানে আলম মিলন ও রাইসুল ইসলাম স্বপন নামের পাঁচজনকে। পরদিন ১১ নভেম্বর গ্রেপ্তার করা হয় সোহেল রানা, এমদাদুল হক খোকন ও এবি জাহিদ নামের তিনজনকে। এই আটজনের মধ্যে পাঁচজন বিভিন্ন ব্যাংকের কর্মকর্তা এবং একজন ঢাকা কলেজের সাবেক শিক্ষার্থী।
এরই ধারাবাহিকতায় অভিযান চালিয়ে গত ১৭ নভেম্বর রাজধানীর দক্ষিণখান থেকে গ্রেপ্তার করা হয় প্রশ্নফাঁস চক্রের মূল হোতা এইউএসটির অফিস অ্যাটেনডেন্ট দেলোয়ার হোসেন ও আহছানিয়া প্রেস অ্যান্ড পাবলিকেশনের কাটিংম্যান রবিউলকে। তাদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ওই দিন মহাখালী থেকে গ্রেপ্তার করা হয় এইউএসটির ল্যাব অ্যাটেনডেন্ট পারভেজ মিয়াকে। বৃহস্পতিবার (১৮ নভেম্বর) তিনজনকে আদালতে তোলা হলে তারা ১৬৪ ধারায় প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে জবানবন্দি দেন। পরে তাদের কারাগারে পাঠান আদালত।
জবানবন্দিতে দেলোয়ার জানান, বুয়েট শিক্ষক নিখিল রঞ্জন ধর অল্প টাকায় ব্যাংকের নিয়োগ পরীক্ষার প্রশ্ন তৈরির টেন্ডারগুলো আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়কে এনে দিতেন। প্রশ্ন ছাপানোর সব কাজে তিনি সম্পৃক্ত থাকতেন এবং নিয়ন্ত্রণ করতেন। প্রতিবার প্রশ্ন ছাপার পর প্রেস থেকে তিনি দুই সেট ব্যাগে করে নিয়ে যেতেন। দেলোয়ার নিজেও কয়েকবার নিখিলের ব্যাগ প্রশ্ন দিয়েছেন। এ বিষয়ে কাউকে কিছু না বলার জন্য দেলোয়ারকে নিষেধ করেছেন নিখিল। নইলে চাকরি খাওয়ার হুমকি দেন তিনি।
তবে নিখিল সেসব প্রশ্ন নিয়ে কী করতেন বা কাউকে দিতেন কি না, সেটি নিশ্চিত করতে পারেননি দেলোয়ার।
দেলোয়ার জবানবন্দিতে আরও জানান, আশুলিয়ার ওই প্রেস থেকে রবিউল তাকে প্রশ্ন এনে দিত। পরে তিনি ওই প্রশ্ন পারভেজ মিয়া ও মোক্তারুজ্জামান রয়েলকে দিতেন। এর বিনিময়ে তারা প্রত্যেকে এক লাখ টাকা করে পেতেন।
এদিকে এসব অভিযোগের বিষয়ে অস্বীকার করেছেন বুয়েটের আইপিই বিভাগের প্রধান নিখিল রঞ্জন ধর। তিনি গণমাধ্যমকে জানান, দেলোয়ার যা বলেছে সেটি সঠিক নয়। তিনি প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কিন্তু কোনো প্রশ্ন আনেননি। শুধু কোনো কারিগরি সহযোগিতা প্রয়োজন হলে তিনি সেটা করতেন। এর বাইরে আর কিছুই নয়।
এ বিষয়ে ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার এ কে এম হাফিজ আক্তার গণমাধ্যমকে বলেন, “আদালতে দেওয়া একজন আসামির জবানবন্দিতে বুয়েট শিক্ষকের নাম এসেছে। তবে তিনি প্রশ্ন তৈরির সঙ্গে কীভাবে সম্পৃক্ত ছিলেন এবং তার ভূমিকা কী ছিল তা খতিয়ে দেখা হচ্ছে। প্রয়োজনে তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। তদন্তের আগে তার সম্পৃক্ততার বিষয়ে নিশ্চিত করে কিছু বলা যাচ্ছে না।”
ডিবি সূত্রে আরও জানা যায়, আদালতে দেওয়া আসামিদের জবানবন্দিতে এবং জিজ্ঞাসাবাদে আহছানউল্লা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকর্তা কাজী শরীফুল এবং দেলোয়ারের ভগ্নিপতি মুবিন উদ্দিনের সম্পৃক্ততার তথ্য পাওয়া গেছে। তাদের গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। প্রশ্নফাঁসের সঙ্গে জড়িত কাউকে ছাড় দেওয়া হবে না।