• ঢাকা
  • বুধবার, ১১ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে জাতীয় ঘটনার গুরুত্ব কতটুকু?


আবদুল্লাহ আল মামুন
প্রকাশিত: মার্চ ২৬, ২০২২, ০৮:১৯ এএম
ইংরেজি মাধ্যম স্কুলে জাতীয় ঘটনার গুরুত্ব কতটুকু?

ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের নাম শুনলে অনেকেই বলে থাকেন, সেখানে বাংলা পড়ানো হয় না, বাংলার সঙ্গে কোনো সম্পর্কই তাদের নেই। এমনকি অনেকেই বলছে বিদেশি কারিকুলামের স্কুলগুলোতে জাতীয় দিবসগুলোর প্রতি তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। তবে বাস্তব চিত্র ঠিক এ রকম নয়। ইংরেজি মাধ্যম স্কুলেও বাংলার চর্চা চলে। প্রতিটি ক্লাসেই বাংলা বাধ্যতামূলক বিষয়। ‘ও’ লেভেল পরীক্ষায় বাংলা বিষয় রয়েছে। বিভিন্ন জাতীয় দিবস ও উৎসবের অনুষ্ঠানও পালন করা হয় বাংলায়। এমনকি স্কুলের শুরুটাও হয় বাংলায় জাতীয় সংগীত গাওয়ার মধ্য দিয়ে।

রাজধানীর একাধিক ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তাদের পাঠ্যসূচিতে বাংলা বিষয় রয়েছে। স্কুলভেদে ১০০ নম্বর থেকে ৪০০ নম্বর পর্যন্ত বাংলা পড়ানো হয়। এর মধ্যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও বাংলা ব্যাকরণ রয়েছে। জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের (এনসিটিবি) বই-ই এ ক্ষেত্রে তারা পড়াচ্ছে।

বাংলাদেশ শিক্ষা তথ্য ও পরিসংখ্যান ব্যুরোর (ব্যানবেইস) তথ্য বলছে, ইংরেজি মাধ্যমে শিক্ষার্থীর সংখ্যা বেড়েই চলেছে। দেশে ২০১৮ সালে ‘ও’ লেভেলে ৬৪টি ‘এ’ লেভেলে ৫৪টি এবং জুনিয়র লেভেলে ৪১টি-মোট ১৫৯টি ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের নিবন্ধন ছিল। ২০১৯ ও ২০২০ সালে ১৭টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান কমে ১৪২টিতে দাঁড়ায়। ২০১৮ সালে শিক্ষার্থী ছিল ৫৪ হাজার ৫০৭ জন এবং ২০২০ সালে বেড়ে দাঁড়ায় ৭৮ হাজার ২০১ জনে। তবে নার্সারি ও কেজি শ্রেণিতে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলগুলো ব্যানবেইসের হিসাবে নেই। ফলে একেবারে শিশু শ্রেণিতে শিক্ষার্থীর সংখ্যা কত, সে তথ্য পাওয়া যাচ্ছে না। 
বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশন সূত্রে জানা যায়, সারা দেশে ইংরেজি মাধ্যমের স্কুলের সংখ্যা প্রায় ৩৫০ (কিন্ডারগার্টেন স্কুলগুলো এ হিসাবের অন্তর্ভুক্ত নয়) সেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় তিন লাখ। বাংলাদেশ কিন্ডারগার্টেন ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন জানায়, দেশে প্রায় সাড়ে চার হাজার ইংরেজি মাধ্যমের কিন্ডারগার্টেন স্কুল আছে, যেখানে শিক্ষার্থীর সংখ্যা প্রায় দুই লাখ।

ব্রিটিশ কারিকুলামনির্ভর ইংরেজি মাধ্যম স্কুলের প্রথম থেকে অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত ‘অর্ডিনারি লেভেল’, সংক্ষেপে ‘ও’ লেভেল এবং পরবর্তী নবম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি ‘অ্যাডভান্স’ লেভেল, সংক্ষেপে ‘এ’ লেভেল হিসেবে গণ্য হয়। পরবর্তী শিক্ষা এ-১ ও এ-২ শ্রেণিভুক্ত। এর পরীক্ষাও হয় ইংল্যান্ডের স্কুল-কলেজের অনুসারে। এর পাশাপাশি ‘ইংলিশ ভার্সন’ নামে শিক্ষাদান হয়।

মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস কিংবা বাঙালি সংস্কৃতি ও জাতীয় দিবসকে ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলো কতটুকু ধারণ করছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে সিদ্দিকি’স ইন্টারন্যাশনাল স্কুলের চেয়ারপারসন রিফাত আহমেদ বলেন, ‘‘বাচ্চাদের গল্পের মতো করে আমাদের দেশের ইতিহাসকে তুলে ধরতে হবে। শুধু স্কুলকে ভরসা করলে হবে না। কেননা, একটা বাচ্চা বেশির ভাগ সময় পরিবারের সঙ্গে থাকে। তাই পরিবারকেও ভূমিকা রাখতে হয়। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস এ কারণেই শেখানো হচ্ছে যেন তাদের মধ্যে দেশপ্রেম তৈরি হয়। শিক্ষার্থী বা বাচ্চারা যারা একদিন রাষ্ট্রপরিচালনা করবে তারা যদি দেশকে ভালো না বাসতে পারে তাহলে দেশের জন্য কিছু করতে পারবে না। সে জন্য এটা একটা প্রকল্প হিসেবে আমাদের নিতে হবে। শুধু দেশকে চেনা নয়; এর সঙ্গে সঙ্গে সবচেয়ে বড় এটা গৌরবের বিষয় হলো আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। সে ক্ষেত্রে স্কুলের পাঠ্যবই থেকে কিছুটা ইতিহাস জানতে পারছে শিক্ষার্থীরা। তবে বইয়ের এমন শিক্ষাটার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো বাস্তবসম্মতভাবে শিল্পের মাধ্যমে তাদের শেখাতে হবে। সেটা হতে পারে অভিনয়ের মাধ্যমে কিংবা নাটক, গল্প, কবিতাসহ ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতির মাধ্যমে। তখনই শিক্ষাটা স্থায়ী হবে।’’

রিফাত আহমেদ আরও বলেন, “জাতীয় দিবসগুলোতে বিভিন্ন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ছাড়াও যেমন আমরা আমাদের স্কুলে প্রবেশপথে মুক্তিযুদ্ধসহ দেশের ইতিহাসের বিভিন্ন ছবি দেয়ালে টানিয়ে রেখেছি, যেন শিক্ষার্থীরা দেশ সম্পর্কে ছবি দেখেও জানতে পারে।”

অন্যদিকে ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলগুলোতে বাংলা ভাষা সম্পর্কে রিফাত আহমেদ বলেন, ‘‘ইংরেজি মাধ্যম স্কুলগুলোতে বাংলা বিষয় আছে, তবে বাধ্যতামূলক নয়। কারণ প্রাইভেট স্কুলগুলো ব্রিটিশ কারিকুলামে পরিচালিত হয়। তাই বাংলাটা যেভাবে শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে, সেটা শুধু দুইটা অনুবাদ এবং রচনা লিখতে হয়। খুব একটা যে বিস্তারিতভাবে যেমন বাংলা সাহিত্য পড়তে হবে কিংবা কবিতা আবৃত্তি করতে হবে এমনটা নয়। তাই একটা বাচ্চা শর্টকাটে চলে যেতে চায়। শিক্ষার্থীদের কাছে সহজভাবে তুলে ধরার অভাব রয়েছে।’’

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্কলাসটিকা স্কুলের একজন অভিভাবক বলেন, ‘‘আমার সন্তান ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে। তারা লাইব্রেরিতে বাংলা বই পড়ার জন্য উৎসুক থাকে। তাদের পরীক্ষার জন্য বাংলার নানা টপিকস আমাদের তৈরি করে দিতে হয়। এমনকি কত সুন্দর করে বাংলা রচনা লেখা যায়, সেটাও তৈরি করে দিতে হয়। ইংরেজির পাশাপাশি সে বাংলায়ও সমান পারদর্শী।”

বাংলাদেশ ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল অ্যাসোসিয়েশনের এক সদস্য বলেন, ইংলিশ মিডিয়াম সব স্কুলেই বাংলা পড়ানো হয়। প্রায় সব ধরনের অনুষ্ঠান বাংলায় হয়। বাংলা মাধ্যম স্কুলে সব বিষয়ই বাংলায় পড়ানো হয় বলে তারা বেশি দক্ষ; আর ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলে শুধু বাংলা ছাড়া অন্য সব বিষয় ইংরেজিতে পড়ানো হয়। এ ছাড়া কথোপকথন, যোগাযোগ হয় ইংরেজিতে। এ জন্যই বাংলা মাধ্যমের শিক্ষার্থীদের মতো তারা বাংলায় অতটা পারদর্শী নয়। তিনি আরও বলেন, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষার্থীরা যে বাংলা ভাষা, সাহিত্য, ইতিহাস-ঐতিহ্য জানে না, তা একদমই ঠিক নয়।

কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন বলেন, ‘‘ইংরেজি মাধ্যমে পড়াটা দোষের নয়। বাংলা-ইংরেজি সব ধরনের বই পড়ার প্রতিই বাচ্চাগুলোকে আগ্রহী করতে হবে। স্কুলের কাজ হলো বাংলা বা ইংরেজি, যে ভাষাতেই হোক, সে যেন মনের ভাব বা বিষয়গত জ্ঞান প্রকাশ করতে পারে।’’

সেলিনা হোসেন আরও বলেন, ‘‘স্কুলটি বাংলা মাধ্যমের না ইংলিশ মিডিয়ামের, সেটি বড় কথা নয়। বড় কথা হলো অন্যান্য কৃতিত্বের সঙ্গে সঙ্গে স্কুলটি তার শিক্ষার্থীদের মাতৃভাষায় যথেষ্ট পারদর্শী করতে পারছে কি না। অভিভাবকেরও দায়িত্ব হবে বাসায় বাংলা বই কিনে আনা।’’

Link copied!