‘ফজলুল হক হলে আমাদের একটা গ্রুপ ছিল। নাম ‘সূর্য সেন স্কোয়াড’। বন্ধু আনোয়ার হোসেন (জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক ভিসি) ছিল এর লিডার। আমি, জুলফিকার, তারিক, ফাত্তা, আশরাফ, হাবিবুল্লাহ, আমিনুল হক, ইয়াহিয়াসহ আরও দশ-বারোজন ছিলাম তার সঙ্গে। আনোয়ার খুব মেধাবী ছিল। ও সব সময় বলত, ‘ওরা এভাবে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। একটা সময় যুদ্ধে যেতেই হবে। ওই যুদ্ধ হবে গেরিলাযুদ্ধ। তাই গেরিলার প্রস্তুতি এখন থেকেই নিতে হবে।’
আনোয়ারের কথায় আমরা উজ্জীবিত হতাম। এরপরই শুরু করি মলোটভ ককটেল বানানো। বাইরে থেকে কিছু কেমিক্যাল এনে শ দুয়েক ককটেল বানিয়েছিলাম অসহযোগের সময়। তিনটা রাইফেলও জোগাড় হয়ে যায়। এভাবে মনেপ্রাণেই গেরিলা হয়ে উঠি আমরা।
২৫ মার্চ ১৯৭১। সকাল থেকেই ফজলুল হক হল ছাড়তে থাকে ছাত্ররা। শেষে ছিলাম মাত্র একচল্লিশজনের মতো। একদিন আগেই রাইফেল আর ককটেলগুলো লুকিয়ে রাখি। কোনোটি মাটির নিচে, কোনোটা ছাদের ওপর। ওই দিনও বানালাম আরও কিছু ককটেল। দিন গড়িয়ে রাত আসে। ডাইনিং বন্ধ। তাই রাতের খাবারের জন্য চলে যাই সচিবালয়ের পেছনে, চিটাগাং রেস্টুরেন্টে।
হঠাৎ সাঁজোয়া যানের শব্দ। দেখলাম আর্মির কনভয় যাচ্ছে। অস্ত্র তাক করে চারপাশ দেখছে সেনারা। ওদের চোখেমুখে হিংস্রতার ছাপ। রেস্টুরেন্টে ছিলাম চারজন—আমি, আনোয়ার, তারিক আর জুলফিকার। চারপাশের এলাকা থমথমে। আনোয়ার বলল, ‘রিয়াজ, অবস্থা ভালো ঠেকছে না। আজই ক্র্যাকডাইন হতে পারে। চল হলে ফিরি।’
তাই করলাম। কিন্তু হলের উত্তর গেটের সামনে আসতেই শুরু হয় কামানের গর্জন। গোলাগুলিরও শব্দ পাই অবিরত। ওই সময়ের অনুভূতিটা ঠিক বোঝানো যাবে না। আমরা তখন কী করব?
হাউস টিউটর এসে বলল, ‘তোমরা নিরাপদ জায়গায় চলে যাও। তবে অবশ্যই হলের বাইরে যেও না।’
তখন হলের ছাদে অবস্থান নিই। সঙ্গে ছিল তিনটা রাইফেল আর কিছু ককটেল। চার বন্ধু হলের চারটা গম্বুজের নিচে পজিশন নিয়ে থাকি। কে কী দেখছি, তা ক্রলিং করে এসে একজন আরেকজনকে বলি। এভাবেই কাটে গোটা রাত।
চারপাশ দেখতে ওরা আগে আলোর মতো একটা গুলি ছোড়ে। এরপরই ফায়ার করতে থাকে। রাত দুইটার পর দেখি পুরান ঢাকার দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে। চারপাশে শুধু গুলি, চিৎকার আর মানুষের কান্নার শব্দ। কিছু করতে না পারার বেদনায় ছটফট করতে থাকি। ফজরের আজান পড়েছে তখন। ভাবলাম, এবার হয়তো গোলাগুলি থেমে যাবে। কিন্তু আজানের সময়ও পাকিস্তানি সেনারা গণহত্যা চালিয়ে যাচ্ছিল। কেন জানি ওরা ফজলুল হক হলে আসেনি। ফলে দৈবক্রমে বেঁচে যাই আমরা।
২৬ মার্চ ভোরবেলা। ছাদ থেকে নেমেই একে অপরের কাছ থেকে বিদায় নিই। কিন্তু গেটের সামনে যেতেই দৌড়ে আসে দারোয়ান। জানায়, শহীদুল্লাহ হলে অ্যাটাক হয়েছে। ছয়জনের লাশও পড়ে আছে। আর্মিরা এদিকেই আসছে। শুনেই যে যার মতো লুকিয়ে থাকি। আমি চলে যাই তিনতলায়, আমার ৩৫২ নম্বর রুমের সামনের বারান্দায়। সেখানে বসে রেলিংয়ের দেয়ালের ফাঁক দিয়ে দেখি সবকিছু।
ওরা এসেই দারোয়ানকে ডাকে। সে বিহারি হলেও বাঙালিদের পক্ষে ছিল। পাকিস্তান আর্মিদের সে বলে, ‘এই হলে ভালো ছাত্ররা থাকে। তারা কেউ আন্দোলন করে না। ছুটির কারণে সবাই বাড়ি চলে গেছে। এখন কেউ নাই স্যার।’
তার কথায় আর্মিরা প্রথম আশ্বস্ত হয়। কিন্তু হঠাৎ তাদের চোখ পড়ে পতাকার দিকে। প্রথম ওড়ানো বাংলাদেশের পতাকাটি তখনো হলের সামনে পতপত করে উড়ছিল। তা দেখে আর্মিরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। ‘মাদার—’ বলে গালি দিয়ে দারোয়ানের ওপর চড়াও হয়। এরপর পতাকাটি নামিয়ে বুটের তলায় কিছুক্ষণ মারিয়ে তাতে তারা আগুন ধরিয়ে দেয়। রাগে চারদিকে কয়েক রাউন্ড গুলিও ছুড়ে। একটি গুলি এসে পড়ে আমার ঠিক সামনেই। কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে পাকিস্তানি আর্মিরা তখন অন্যত্র চলে যায়। ফলে মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকেই ফিরে আসি আমরা। এরপর কিছু সময় অডিটরিয়ামে এবং পরে চলে যাই কার্জন হলে। ফজলুল হক হলেই থাকলে হয়তো বেঁচে থাকতে পারতাম না। কেননা, আর্মিরা আবারও এসে গোটা হল সার্চ করেছিল।’
২৭ মার্চ, সকালবেলা। চার ঘণ্টার জন্য কারফিউ তুলে নেওয়া হয়। তখন হেঁটে চলে আসি সদরঘাটে। পথে পথে দেখি লাশ আর রক্ত। অনেক বাড়িঘরও ছিল পোড়া। নাজিমুদ্দিন রোডে রিকশায় পড়ে থাকতে দেখেছি কয়েকটি লাশ। সদরঘাটে গিয়ে দেখি লাখো মানুষের ভিড়। জীবন নিয়ে সবাই পালিয়ে যাচ্ছে। আমিও জনস্রোতে মিশে যাই। পায়ে হেঁটে প্রথমে মুন্সিগঞ্জ এবং পরে লঞ্চে আসি চাঁদপুরে। সেখানে এসেই শুনি মাইকিং। বিকেলের মধ্যেই আর্মি চলে আসবে। সবাইকে তাই সতর্ক করা হচ্ছে। তখন কী করব? মনে হলো মৃত্যু আমার পিছু নিয়েছে।
সময়টা ছিল ধান কাটার। বরিশাল থেকে ধানকাটার একটি দল নৌকা নিয়ে যাচ্ছিল সুনামগঞ্জের দিকে। কেনাকাটার জন্য ওরা নামে চাঁদপুরে। নিজের অসহায়ত্বের কথা বলতেই তারা আমায় তুলে নিল। গুন টানা নৌকাতেই শুরু হয় যাত্রা। কিন্তু বিপদ তখনো পিছু ছাড়েনি। ভৈরবে এসে পাকিস্তানিদের গানবোটের মুখে পড়ি। নৌকায়ও চেকিং হয়। মাঝি গোপন পাটাতনের নিচে আমাকে শুইয়ে রেখে জীবন রক্ষা করে। এভাবে পথে পথে মৃত্যুভয়কে অতিক্রম করে এগারো দিনে পৌঁছি গ্রামে। সবাই ভেবেছিল মরে গেছি। মা আমার পাগলের মতো হয়ে যায়। জড়িয়ে ধরে তার সেকি কান্না! ওই দিনই ভেবেছি, লাখো মায়ের চোখের জল দূর করতেই যেতে হবে যুদ্ধে।“
একজন প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একাত্তরের পঁচিশ মার্চে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণহত্যা ও তার পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহের কথা এভাবেই তুলে ধরেন বীর মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন। এক বিকেলে তার বাড়িতে বসেই চলে আলাপচারিতা। এই মুক্তিযোদ্ধা এখন প্রয়াত। কিন্তু তার বলা সব কথাই ইতিহাস হয়ে আছে।
মুজাহিদ আলী ও আফতাবুন্নেসা বেগমের বড় সন্তান রিয়াজউদ্দিন। বাড়ি সুনামগঞ্জের জামালগঞ্জ উপজেলার মৌলিনগর গ্রামে। লেখাপড়ায় হাতেখড়ি মৌলিনগর প্রাইমারি স্কুলে। তিনি ষষ্ঠ শ্রেণিতে ভর্তি হন সুনামগঞ্জ সরকারি জুগলি হাইস্কুলে। সেখান থেকে ম্যাট্রিক পাসের পর চলে যান চট্টগ্রামে, চাচাতো ভাইয়ের বাড়িতে। অতঃপর ভর্তি হন চিটাগাং গভর্মেন্ট কলেজে। ইন্টারমিডিয়েট পাসের পরই তিনি ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে। মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি ছিলেন অনার্স থার্ড ইয়ারের ছাত্র।
বঙ্গবন্ধুর প্রতি বিশ্বাস আর অগাধ আস্থা ছিল মানুষের। বাঙালিরা যে সত্যিই বঞ্চিত—এটা তিনি বোঝাতে পেরেছিলেন। ফলে মানুষ তার মাধ্যমেই বঞ্চিত অবস্থা থেকে উত্তরণের স্বপ্ন দেখে। যার প্রমাণ মিলে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। নির্বাচনে জয় লাভ করলেও পাকিস্তানি সামরিক সরকার ক্ষমতা দেয় না। সবাই তখন বঙ্গবন্ধুর নির্দেশের অপেক্ষায় থাকে।
রিয়াজউদ্দিনের ভাষায়, “৭ মার্চ ১৯৭১। ফজলুল হক হল থেকে সকালেই রেসকোর্সে আসি। সঙ্গে ছিল জুলফিকার, তারিক, খোকন, সাত্তার প্রমুখ। দূরের মানুষেরা চলে এসেছে তখন। সবার হাতে হাতে বৈঠা আর বাঁশের লাঠি। মাথায় লাল কাপড় পরে এসেছেন শ্রমিকরা। বঙ্গবন্ধু স্টেজে উঠলেন। উনি যখন ‘ভায়েরা আমার’ বললেন। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। আমার জীবনের স্মরণীয় ঘটনা। পৃথিবীর ইতিহাসে আকৃষ্ট করার মতো এমন ভাষণ তো নাই। সাধারণ মানুষ তন্ময় হয়ে শুনেছে বঙ্গবন্ধুকে। আজও আমরা শুনি। উনি সব ঘটনাই তুলে ধরলেন। মাঝেমধ্যে মহাসমুদ্রে যেন তালির ঢেউ ওঠে। আমার কাছে ওই ভাষণ একটা পরিপূর্ণ কবিতা। ভাষণ নয় বঙ্গবন্ধুর মনের ভেতর থেকে উচ্চারিত কথাই যেন বেরিয়ে এসেছে। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের চূড়ান্ত মাহেন্দ্রক্ষণ ছিল ৭ মার্চ।’
জুন মাস তখন। পুরো বর্ষা চলছে। রিয়াজউদ্দিন, বরকত, আসাদসহ মোট পাঁচজন দেশের টানে ঘর ছাড়েন। মামা ফজলুল করিম তাদের নৌকা ভাড়া করে দিয়ে ভারতে যাওয়ার পথ বলে দেন। এরপর কী ঘটল ,সে ইতিহাস শুনি রিয়াজউদ্দিনের জবানিতে—
“হাওর থেকে একটা খাল পেরিয়ে বালাটে ঢুকব। সেখানে গিয়ে ভয় পেয়ে যাই। দেখলাম, খালের চারপাশে ভাসছে শত শত লাশ। লাশ সরিয়ে নৌকা এগোয়। মাঝি জানায় বালাট শরণার্থী ক্যাম্পে কলেরায় আক্রান্ত হয়েছে হাজারো মানুষ। লাশগুলো তাদের একাংশ। শুধু অস্ত্রের আঘাতেই নয়। একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধে নানা কারণে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছিল বহু মানুষ, যা ত্রিশ লক্ষ হিসাবটাকেও পেছনে ফেলবে।’
“বালাট মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটিং ক্যাম্পে প্রথম নাম লেখাই। সেখানে দুই বেলা খাওয়া ও থাকার ব্যবস্থা হয়। চাটাই ছিল বিছানা আর ইট ছিল বালিশ। ওখানকার ইনচার্জ ছিলেন ক্যাপ্টেন আফতাব। ট্রেনিংয়ের আগেই ওখানে ভলান্টিয়ারের কাজ করি। স্থানীয়ভাবে দশ-বারো দিন রাইফেল চালানোর ট্রেনিংও দেওয়া হয়। যৌথ কমান্ড তখন শুরু হয়ে গেছে। ভারতীয় মেজর ডি গমেজ ছিলেন ওখানকার কমান্ডে। আমি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া। ইংরেজি কিছুটা বলতে পারতাম। তাই ক্যাপ্টেন আফতাব মেজর ডি গমেজের সাথে যোগাযোগের জন্য আমাকে লিয়াজোঁ অফিসার বানিয়ে দিলেন।’
একদিন ওই ক্যাম্পে আসেন আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুর রাজ্জাক। উনি ছিলেন রিয়াজউদ্দিনের পূর্ব পরিচিত। তিনি তাকে পরিচয় করিয়ে দেন মো. আবদুল হামিদ (বর্তমান রাষ্ট্রপতি) এর সঙ্গে। তাদের মুখেই তিনি প্রথম শুনেন বাংলাদেশ লিবারেশন ফন্ট বা বিএলএফের কথা। রিয়াজউদ্দিনসহ একটি কমিটিও করা হয় তখন।
আপনার কাজ কী ছিল?
রিয়াজউদ্দিনের উত্তর, “বিএলএফের জন্য রিক্রুট করা। প্রতি সপ্তাহে একটা বাস আসত। সেটাতে করে ট্রেনিংয়ের জন্য যুবকদের বাছাই করে পাঠিয়ে দিতাম খেড়াপাড়া ক্যাম্পে। ছাত্রলীগ বা প্রগতিশীল ছাত্রসংগঠনের সদস্য হওয়াই ছিল যোগ্যতা। আমি ১১০ জন পাঠিয়েছিলাম ট্রেনিংয়ে। মেজর জেনারেল ওভানের প্রত্যক্ষ সহযোগিতা ছিল বিএলএফে। মূল ফোর্সেও উনি বিশেষ দায়িত্বে ছিলেন। মেজর ডি গমেজের মাধ্যমে বিএলএফকে অস্ত্র দেওয়া হয়েছিল। সেটার স্লিপও দিতাম আমি। নিজের কাছে অস্ত্র হিসেবে থাকত একটা রিভেলবার। এছাড়া মূল বাহিনীর লিয়াজোঁ অফিসার হিসেবেও কাজ চালিয়ে গেছি। সুনামগঞ্জে বিএলএফের অপারেশনে কমান্ডার আমি আর ডিপুটি কমান্ডার ছিল মুজিব। সার্বিকভাবে পুরো ময়মনসিংহ ও সিলেট জোনের লিডার ছিলেন আবদুল হামিদ ভাই। সুনামগঞ্জ সাব অঞ্চলে আমি ছিলাম ডেপুটি লিডার।’
একটি অপারেশনের কথা জানালেন মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন—
“পাকিস্তানি সেনাদের একটা বড় ক্যাম্প ছিল ছাতকে। সেখান থেকেই ওরা বর্ডার কাভার করত। ওদের দুর্বল করে দিতে অভিযান চালাতে হবে। সেপ্টেম্বর বা অক্টোবরের ঘটনা। বিএলএফকে রেইকির নির্দেশ দিলেন মেজর শওকত। বিএলএফে তখন বত্রিশজন। আমি আর হামিদ ভাই মিলে পাঁচজনকে সিলেক্ট করলাম। ছাতক শহরের অবস্থা আর যেখানে ওরা ঘাঁটি গেরেছে সেখানকার তথ্য নিয়ে আসতে হবে। ছয় দিনের মতো লাগল। রেকির সমস্ত তথ্যগুলো একত্রিত করে আমরা ম্যাপ তৈরি করি। অতঃপর বসি মেজর শওকত সাহেবের সঙ্গে। তারা নিজেরাও একটা রেকি করিয়েছিলেন। মিলিয়ে দেখলেন বেশির ভাগের সঙ্গেই আমাদের মিল রয়েছে। এরপর অ্যাটাকের পরিকল্পনা হয়।’
“সিলেট থেকে ছাতকের রাস্তায় গেরিলা আক্রমণের দায়িত্ব দেওয়া হয় বিএলএফকে। বর্ডার থেকে নিয়মিত গোলাগুলি তো চলছেই। সিলেট থেকে পাকিস্তানি সেনারা যেন কাউন্টার অ্যাটাক করতে না পারে, সেটিরও দায়িত্ব থাকে বিএলএফের। মেইন ফোর্সটা অ্যাটাক করেই সামনে এগিয়ে যায়। আমরা দুইপাশে রাজাকারদের ফাঁড়িগুলো উড়িয়ে দিতে থাকি। ওই আক্রমণের কারণে ছাতক থেকে পাকিস্তানিরা সরে যায় সিলেটের কাছাকাছি। অপারেশনে আবু তালেব ও আবু সালেকসহ মূল ফোর্সে শহিদ হয়েছিল ছাব্বিশজনের মতো।’
“এছাড়াও আমরা গেরিলা অপারেশন করি জামালগঞ্জ আর বিসমবরপুরে। বিএলএফের গ্রামীণ অপারেশনের উদ্দেশ্য ছিল রাজাকারদের অত্যাচার থেকে মানুষকে বাঁচানো। গোটা সুনামগঞ্জে বিএলএফের যোদ্ধা ছিল ১১০ জন। আটটি থানাতে ভাগ করে দেওয়া হয় তাদের। প্রথাগত মুক্তিযোদ্ধাদের সঙ্গে সমন্বয় করেই তারা অপারেশন করতো।’
মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে সুবিধা লাভ থেকে বিরত ছিলেন মুক্তিযোদ্ধা রিয়াজউদ্দিন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে ম্যানেজার হিসেবে তিনি চাকরি করেন মিল্কভিটায়। এরপর ১৯৮৩ সালে ডিপুটি ডাইরেক্টর হিসেবে যোগ দেন পরিবেশ অধিদপ্তরে। দেশের পক্ষে পরিবেশবিষয়ক আন্তর্জাতিক বহু সেমিনারে অংশ নিয়েছিলেন এই মুক্তিযোদ্ধা। সবশেষে তিনি পরিবেশ অধিদপ্তরে পরিচালকের দায়িত্বে ছিলেন।
পঁচাত্তর-পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে এই সূর্যসন্তান বলেন, “জাতির জনককে হত্যার পর দেশটা তো অন্ধকার পথে চলতে থাকে। একাত্তরের দালালেরা মাটি খুঁড়ে বেরিয়ে আসে জিয়ার সময়ে। সমাজে হঠাৎ করেই অতি মুসলিম ভাব শুরু হয়। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মের সাথে মেলানোটাও শুরু হয় পঁচাত্তরের পর থেকেই। জিয়াউর রহমান হাত মেলান যুদ্ধাপরাধীদের সঙ্গে। মুক্তিযোদ্ধাদের তখন অপরাধীর চোখেই দেখা হতো। ধর্মভিত্তিক রাজনীতিরও উত্থান ঘটে। এখন তো সেটা অনেক ডালপালা মেলেছে।’
পরবর্তী প্রজন্মই দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। তাই বুক ভরা আশা নিয়ে তাদের উদ্দেশে মুক্তিযোদ্ধা মোহাম্মদ রিয়াজউদ্দিন বলেন, “তোমরা নিজের কাজটাকে ভালোভাবে করো। দেশকে ভালোবাসার প্রকাশ সেটাই। বিবেকের কাছে সৎ থেকো। অন্যায়ের প্রতিবাদ করো। দেশের জন্য নিজেকে যোগ্য করে তোলা। মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাসটি জেনে নিও। কখনো কোথাও এই দেশকে অপমানিত হতে দিও না।’
লেখক: মুক্তিযুদ্ধ গবেষক