• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

মহিমান্বিত বিজয়, উপেক্ষিত গণহত্যার স্বীকৃতি


কবির য়াহমদ
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ১৫, ২০২১, ০৭:০২ পিএম
মহিমান্বিত বিজয়, উপেক্ষিত গণহত্যার স্বীকৃতি

বাংলাদেশের বয়স পঞ্চাশ, বিজয়েরও। একাত্তরের ছাব্বিশে মার্চে স্বাধীনতার যে ঘোষণা, তার পূর্ণতা পায় একই বছরের ষোলো ডিসেম্বরে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের মাধ্যমে। এই আত্মসমর্পণ কেবল পাকিস্তান নামের রাষ্ট্রের চূড়ান্ত পরাজয়ই নয়, এর সঙ্গে আছে তাদের এদেশীয় দোসর এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনের দোসরদেরও পরাজয়। ইতিহাসে তাই মহিমান্বিত এই বিজয়, বাঙালির শৌর্য-সংগ্রামের স্মারক।

বাংলাদেশ নামের রাষ্ট্র স্রেফ নয় মাসের একটা যুদ্ধেই আসেনি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিল দীর্ঘ মুক্তির সংগ্রাম। বিজয়ের সঙ্গে ছিল বায়ান্ন, বাষট্টি, ছেষট্টি, উনসত্তর, সত্তর, একাত্তরসহ নানা সময়ে নানান সংগ্রাম-আন্দোলনের যোগ। প্রতিটি আন্দোলন-সংগ্রামে বাঙালি বুকের রক্ত ঢেলেছে, আদায় করেছে দাবি; স্বাধিকার-স্বাধীনতার। চূড়ান্ত ধাপ হয়তো এখানে একাত্তরের স্বাধীনতার যুদ্ধ, কিন্তু স্বাধিকার থেকে স্বাধীনতার প্রতিটি ধাপ এখানেও প্রণিধানযোগ্য। কারণ, মুক্তির জন্য যে দীর্ঘ প্রস্তুতি, তার প্রতিটি ধাপ অতিক্রম করেছে বাঙালি সাফল্যের সঙ্গে। এখানে বাঙালির মুক্তির দূত হয়ে এসেছিলেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সত্য, তবে তাঁর সঙ্গে ছিলেন আরও অনেকেই, যারা বঙ্গবন্ধুকে যোগ্য সাহচর্য দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বগুণ সবাইকে একই দাবিতে ধরে রেখেছিল শেষ পর্যন্ত। তাই প্রবল প্রতিকূল পরিস্থিতিতেও বাঙালি দিকহারা হয়নি।

একাত্তরের পঁচিশে মার্চ পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনী ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে নিরীহ বাঙালিদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। গণহত্যা চালায় নির্বিচারে। গ্রেপ্তার করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। কিন্তু গ্রেপ্তারের আগে তিনি স্বাধীনতার ঘোষণা করেন। সেই কালরাত থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত ৯ মাসে পাকিস্তানিরা ও তাদের এদেশীয় দোসরেরা দেশব্যাপী ব্যাপক গণহত্যা চালায়। হত্যা করে ৩০ লাখ মানুষকে, ২ লাখ নারী ও মেয়েশিশুর ওপর যৌন সহিংসতা চালায়। মাত্র ৮ মাস ২২ দিনে এত বিপুলসংখ্যক মানুষের ওপর এমন গণহত্যা পৃথিবীর ইতিহাসে এর আগে এবং পরে আর ঘটেনি।

জাতিসংঘের ‘কনভেনশন অন দ্য প্রিভেনশন অ্যান্ড পানিশমেন্ট অব দ্য ক্রাইম অব জেনোসাইড’-এর আর্টিকেল দুই অংশে গণহত্যার পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের কথা বলা আছে, যার কোনো একটি সংঘটিত হলে গণহত্যা বলা যাবে। ‘‘In the present Convention, genocide means any of the following acts committed with intent to destroy, in whole or in part, a national, ethnical, racial or religious group, as such: (a) Killing members of the group; (b) Causing serious bodily or mental harm to members of the group; (c) Deliberately inflicting on the group conditions of life calculated to bring about its physical destruction in whole or in part; (d) Imposing measures intended to prevent births within the group; (e) Forcibly transferring children of the group to another group.’’ কোনো গোষ্ঠীর মানুষকে হত্যা, তাদের শারীরিক ও মানসিকভাবে চরম ক্ষতিসাধন, জীবনমানের প্রতি আঘাত ও শারীরিক ক্ষতিসাধন, জন্মদান বাধাগ্রস্ত করা এবং শিশুদের অন্য গোষ্ঠীর হাতে তুলে দেওয়া। এই পাঁচটি বৈশিষ্ট্যের মধ্যে প্রথম চারটি বৈশিষ্ট্যই পাকিস্তান বাহিনীর দীর্ঘ নয় মাসের হত্যাযজ্ঞে রয়েছে। তবু স্বাধীনতার ৫০ বছরেও একাত্তরের ৯ মাসের গণহত্যার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি।

পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক বাংলাদেশে সংঘটিত এই গণহত্যা সম্পর্কে সত্যিকার অর্থে এত দিন আমরা উদাসীন ছিলাম, বিশেষত রাষ্ট্রীয় পর্যায়ে। মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃতি, মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের সংখ্যা নিয়ে অযাচিত বিতর্ক সৃষ্টির অপচেষ্টা, স্বাধীনতার ঘোষক নিয়ে বিতর্ক, একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ, দেশবিরোধীদের রাজনৈতিক পুনর্বাসনে কেটেছে এত দিন আমাদের। মাত্র এগারো বছর আগে বাংলাদেশে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়। শীর্ষ কয়েকজন যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও দণ্ড কার্যকর ছাড়া সন্তোষজনক গতিও নেই বিচার প্রক্রিয়ায়। এই সময়ে যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রক্রিয়া দেশে-বিদেশে বাধার মুখে পড়েছে, তবে শেখ হাসিনা সরকার শুরুতে দৃঢ় ভূমিকা নিলেও বর্তমানে এই কার্যক্রম অনেকটাই শ্লথ। পলাতক যুদ্ধাপরাধীদের ফিরিয়ে আনার জোরালো তৎপরতা নেই, উচ্চ আদালতে আপিলগুলো রয়েছে শুনানির অপেক্ষায়।

বাংলাদেশ যখন স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী পালন করছে, তখন এই দীর্ঘ সময়েও আমরা গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতিও আদায় করতে পারিনি। ২০১৭ সালের ১১ মার্চ জাতীয় সংসদের চতুর্দশ অধিবেশনে ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করার পর ওই বছর থেকে রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালিত হচ্ছে। এছাড়া দিবসটির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আদায়ে প্রয়োজনীয় কার্যক্রম নেওয়ার জন্য একটি বিলও পাস হয় সংসদে। রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম বলতে এটা আদতে এতটুকুই! বাংলাদেশ যখন রাষ্ট্রীয়ভাবে গণহত্যা দিবস পালন শুরু করে, তার দুই বছর আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী গণহত্যা দিবস নামে একটি দিবস পালন হয়। ২০১৫ সালে জাতিসংঘ ৯ ডিসেম্বরকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ ঘোষণা করে। এর ফলে ২৫ মার্চকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতির আর সুযোগ থাকছে না, কারণ একই নামের দুটি দিবস পালনের সুযোগ নেই। তবে ২৫ মার্চকে গণহত্যা দিবস হিসেবে পালনের বৈশ্বিক সুযোগ না থাকলেও বাংলাদেশের এখনো সুযোগ রয়েছে একাত্তরের ৯ মাসের পাকিস্তান সশস্ত্র বাহিনী কর্তৃক গণহত্যার স্বীকৃতির।

২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে বিশ্বব্যাপী পালনের সুযোগ আমরা হারিয়েছি মূলত বিভিন্ন সময়ের সরকারগুলোর কারণে। ১৯৯৩ সাল থেকে ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণার জন্য সরকারের কাছে দাবি জানিয়ে আসছে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি। সরকার তাতে সাড়া দেয়নি। ২০০৬ সালে আন্তর্জাতিকভাবে চেষ্টা শুরু করে সংগঠনটি। এর আগে ২০০১ সালে ইউনেসকোর কাছে বাংলাদেশের গণহত্যার স্বীকৃতি আদায়ের বিষয়টি প্রথম তুলেছিলেন মুক্তিযুদ্ধের গবেষক এবং ওয়ার ক্রাইম ফ্যাক্ট ফাইন্ডিং কমিটির প্রধান ডা. এম এ হাসান। জবাবে ইউনেসকো জানিয়েছিল, স্বীকৃতির জন্য বাংলাদেশকে জাতিসংঘে তা তুলে ধরতে হবে। সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সম্মতিক্রমে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাস করতে হবে। ২০০৭ থেকে ২০১৫ সাল পর্যন্ত ইউনেসকো এবং গণহত্যার ভিকটিম বিভিন্ন দেশে চিঠি লিখে, আইনপ্রণেতাদের সঙ্গে কথা বলে গণহত্যা দিবস পালন প্রস্তাবের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে নির্মূল কমিটি। ২০১৫ সালের মার্চে আর্মেনিয়া থেকে পাল্টা চিঠি দিয়ে বাংলাদেশে দিবসটি কীভাবে পালন করা হয় এবং এ-সংক্রান্ত তথ্য-উপাত্ত পাঠানোর জন্য বলা হলে নির্মূল কমিটির পক্ষ থেকে তখন জাতিসংঘের সংশ্লিষ্ট দপ্তরকে জানানো হয়, বাংলাদেশে এখনো দিবসটি ঘোষণা হয়নি। তবে এই দিনে বিভিন্ন সংগঠন ও সাধারণ মানুষ গণহত্যায় শহীদদের স্মরণে নানা কর্মসূচি পালন করে থাকেন। দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে যে দিবসের স্বীকৃতি নেই, বিশ্বব্যাপী হবে কীভাবে? হয়ওনি। ফলে ২৫ মার্চ নয়, ৯ ডিসেম্বরকেই বেছে নেয় জাতিসংঘ।

স্বাধীনতার ৫০ বছরে আমাদের অর্জন আছে, হতাশাও আছে। হেনরি কিসিঞ্জারের সেই মন্তব্যের ‘তলাবিহীন ঝুড়ি’ এখন নয় বাংলাদেশ। নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতুর মতো বড় স্থাপনা গড়তে পারা দেশ বাংলাদেশ। এছাড়া আছে উল্লেখের মতো অনেক অর্জন। এসব অর্জনে এখন পাকিস্তানের নাগরিকদের কারও কারও আক্ষেপ ‘খোদা কি ওয়াস্তে হামে বাংলাদেশ বানা দো’। কিছুদিন আগে টেলিভিশনে এসে পাকিস্তানের সাংবাদিক ও কলামিস্ট জাইঘাম খান ইমরান খানকে উদ্দেশ করে বলছেন, ‘‘...আল্লাহর ওয়াস্তে আমাদের বাংলাদেশ বানিয়ে দাও। আমরা ইমরান খানের কাছে কৃতজ্ঞ হয়ে যাব। পাঁচ বছর না, অন্ততপক্ষে দশ বছরেও যদি আমাদের বাংলাদেশের স্তরে নিয়ে যেতে পারেন তিনি। সেটাও হওয়ার নয়।’’

হিটলারের গেস্টাপো বাহিনী পাঁচ বছরে প্রায় ৬০ লাখ ইহুদিকে হত্যা করে, এই গণহত্যার স্বীকৃতি আছে। কিন্তু বাংলাদেশে মাত্র ৮ মাস ২২ দিনে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা ও দুই লাখ নারীর প্রতি সহিংসতার আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি মেলেনি এখনো। এখন সুযোগও নেই ২৫ মার্চের অপারেশন সার্চলাইটের সেই হত্যাযজ্ঞের দিনের স্বীকৃতির। তবে এখনো স্বীকৃতির সুযোগ আছে মুক্তিযুদ্ধের ৯ মাসের পাকিস্তানের গণহত্যার।

বিজয় সব সময়ই আনন্দ, উৎসব, উদযাপন ও গৌরবের। পরস্পরকে মুখোমুখি দাঁড় না করিয়েই বলি এই ৫০ বছরে উপেক্ষায় রয়ে গেছে আমাদের ওপর পরিচালিত পাকিস্তানিদের গণহত্যা। বিজয় যে রক্তের সিঁড়ি ধরে, সেই গণহত্যার বৈশ্বিক স্বীকৃতি দরকার আমাদের।

Link copied!