বাড়ি থেকে বেরিয়ে সেই চির পরিচিত রাস্তাটা ধরে হাঁটা লাগালাম। কেন হাঁটা লাগালাম বা কোথায় পৌঁছাতে চাইছিলাম, সেটা ঠিক মনে পড়ছে না। আজকাল ভুলো রোগ ধরেছে খুব। যখন-তখন যাকে-তাকে যেকোনো কিছুকে ভুলে যাচ্ছি। মনেও পড়ছে, তবে যখন মনে পড়ার দরকার, তখন মনে পড়ছে না। তবে হাঁটতে হাঁটতে কখনো ভাবিত হলাম না কোথায় যাচ্ছি মনে না পড়ায়। কারণ, এটাই হয়তো অভ্যাস। রোজই এ সময়ে আমি এই রাস্তাটা দিয়ে হাঁটি। তাই এক-আধ দিন কোথায় যেতে চাই ভুলে গেলেও যায় আসে না। অভ্যাস আমায় ঠিক পৌঁছে দেবে গন্তব্যস্থলে।
এই রাস্তাটা আমার ছেলেবেলায় মাটির রাস্তা ছিল। পরে কৈশোরে ইটের রাস্তা হয়। কলেজে পড়ার সময় পিচ রাস্তা হয়ে যায়। কয়েক বছর আগে রাস্তা বড় করা হলো দুপাশের জমি অধিগ্রহণ করে। এটা এখন এক্সপ্রেস ওয়ে। শাঁ শাঁ করে গাড়ি ছুটছে সিক্স লেন দিয়ে।
আমি ধার ঘেঁষে এগিয়ে চলছিলাম কোথায় যাব ভাবতে ভাবতে। আমার পিঠে ব্যাগ। তাতে ঠিক কী আছে, এখন মনে পড়ছে না বা মনে পড়ার প্রয়োজন হচ্ছে না। তবে জলের একটা বোতল নিশ্চয় আছে। চুলটা ভেজা, মানে চান করে বেরিয়েছি।
মিলি বলছিল, “তাড়াতাড়ি ফিরো” –এই কথাটা বারবার শুধু মনে পড়ছিল সব ভোলার মাঝে। অনেকটা যেন ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিকের মতো আমার মেমোরিতে বেজে চলেছে কথাটা! “তাড়াতাড়ি ফিরো...”
মিলি কি আমার বউ? আমি নিশ্চিত নই। আমার এক বিয়ে করা স্ত্রী ছাড়াও একজন বান্ধবী আছে। যাদের দুজনের কাছেই আমি পালা করে যাই, শুই, আদর করি, বাজার করি, শোবার আগে ইঁদুর কল পাতি। একজনের নাম মিলি। আরেকজনের নাম কী? মনে পড়ছে না। তাতে কিছু যায় আসে না। আরেকজন যে আছে, সেটা মনে থাকলেই হলো।
মিলি কি আমার বউ? নাকি আমার বান্ধবী? সেটা মনে আছে কি না, কে জানে? তবে তা নিয়ে এখন আমার মাথা ঘামাতে ইচ্ছে করছে না।
অনেকক্ষণ হাঁটার পর একটা ভাঙা জরাজীর্ণ বাড়ি দেখতে পেলাম রাস্তার পাশে। বাড়িটার শরীরজুড়ে বটের ঝুড়ি। পলেস্তারা খসে লাল ইটগুলো দৃশ্যমান। বাড়িটা দোতলা। দুইতলায় একটা ছোট ঝুলবারান্দা। বারান্দার ওপর কাঠের কাজ করা শেড। সেখানে দড়িতে একটা শাড়ি ঝুলছে। সদ্য কেচে মেলা। জল ঝরছে টিপটিপ। শাড়িটার রং নীল। আমি কি এই বাড়িটাতেই আসতে চাইছিলাম? এখানে কি আমার স্ত্রী থাকে? নাকি আমার বান্ধবী থাকে? তার নামটা কী যেন!
কোনোটাই ঠিক মনে পড়ছে না। শাড়িটা একটা ক্লু। শাড়িটা কি আমার স্ত্রী অথবা বান্ধবীর? আমি বাড়িটার সামনে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মনে করার চেষ্টা করলাম শাড়িটা কি আমি চিনি! নাহহ!
আরও একটু দেখা যাক। আমি বাড়িটা ছাড়িয়ে আবার হাঁটতে লাগলাম। রাস্তাটা শুরুতে যতটা চেনা মনে হচ্ছিল, এখন আর ততটা মনে হচ্ছে না। সবকিছু ক্রমশ অচেনা লাগছে।
আমি কি রাস্তা হারিয়ে ফেলেছি? বরং কাউকে একটু ফোন করে দেখা যাক। পকেট থেকে মোবাইল ফোনটা বের করলাম। বোতাম টিপতেই পিন জানতে চাইল। আমার যে পিনটা মনে ছিল সেটা দিলাম। কিন্তু ইনকারেক্ট পিন দেখাল! কী মুশকিল! এটাই তো আমার পিন! রোজ এটা দিয়েই তো খুলি। আজ আবার কী হলো! আবার চেষ্টা করলাম, হলো না। আবার করলাম। আবার এবং আবার, বারবার। হলো না। আন্দাজে অন্য ডিজিট দিলাম, কাজ হলো না। হতাশ হয়ে ফোনটা পকেটে ফেরত করলাম।
পুরোনো বাড়িটা ছাড়িয়ে অনেকটা চলে এসেছিলাম। মনে হলো বাড়ির দরজা নক করে দেখলে হয়। আবার পেছনে ফিরে চললাম। চললাম তো চললাম। বাড়িটা আর দেখতে পেলাম না! কী আশ্চর্য! এটা তো সোজা রাস্তা। এটা ধরেই তো এগিয়ে এসেছিলাম! যতটা সময় এগিয়ে এসেছিলাম, ততটা সময় পিছিয়ে এসে দেখলাম, সেখানে একটা ব্যস্ত বাস গুমটি!
একটা চায়ের দোকানে এসে বসলাম। দোকানদারকে জিজ্ঞেস করলাম, দাদা আমি খুব বিপদে পড়েছি, কিছু চিনতে পারছি না, এটা কোন জায়গা বলবেন?
দোকানদার আমার দিকে অবাকভাবে চাইল। আপাদমস্তক নিরীক্ষণ করল। তারপর বলল, এটা কান্দি বাসস্ট্যান্ড।
কান্দি বাসস্ট্যান্ড! আমি তো থাকি যাদবপুর! বাড়ি থেকে হেঁটে কান্দি চলে এলাম কী করে?! মিলি বা আমার বান্ধবী দুজনেই কলকাতায় থাকে। আমি এদের কারও একজনের বাড়ি থেকে বেরিয়ে হাঁটা শুরু করলে একবেলায় কান্দি আসি কী করে!? আমার মাথা কাজ করছে না। দোকানদার আমার উদ্ভ্রান্ত অবস্থা দেখে বলল, বাড়িতে ফোন করুন না!
বললাম, দাদা ফোনটাও খুলছে না, কেন জানি না!
দোকানদার বলল, এক কাজ করুন, এখান থেকে বাসে চড়ে কলকাতা চলে যান। তারপর নিশ্চয় চিনতে পারবেন সবকিছু।
আমারও সেটাই ঠিক হবে মনে হলো।
‘কলকাতা কলকাতা…’ হাঁক মারা একটা বাসে উঠে বসলাম। জানলার ধারে সিট পেলাম। আজ সারা দিন প্রচুর হাঁটাহাঁটি হয়েছে। বাস চলতেই মিঠেল হাওয়ায় চোখ জুড়িয়ে এলো। আস্তে আস্তে ঘুমিয়ে পড়তে লাগলাম। চোখ বুজে আসতে আসতে জানালা দিয়ে দেখতে পেলাম সেই জরাজীর্ণ ইট বের করা বাড়িটা! নীল শাড়িটা পতাকার মতো উড়ছে। আর জল ঝরছে না। নীল শাড়ির উড়ান দেখতে দেখতে আমি এক্কেবারে ঘুমিয়ে পড়লাম…
বাস থেকে নেমে আমি হাইওয়ে ধরে বাড়ির দিকে হাঁটতে লাগলাম। এই রাস্তা আমার অতি পরিচিত। ছোটবেলা থেকেই এখান দিয়ে আমার যাতায়াত। চোখ বেঁধে ছেড়ে দিলেও এই রাস্তা দিয়ে আমি বাড়ি পৌঁছে যাব।
পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে মিলিকে ফোন করলাম।
“মিলি আমি পৌঁছে গেছি।”
মিলি বলল, “আচ্ছা, তাড়াতাড়ি ফিরো।”
আগের কথাগুলো মনে পড়ল। আমি কান্দি গেলাম কীভাবে? আর মোবাইলের পিনটাও ভুলে গেছিলাম কী করে? তাহলে কি তখন আমি স্বপ্ন দেখছিলাম? নাকি ওটাই সত্যি? এখন স্বপ্ন দেখছি?…
মিলি তাড়াতাড়ি ফিরতে বলল। কিন্তু কোথায় ফিরব? স্বপ্নে না বাস্তবে? কোথায় গেলে মিলির কাছে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব?
এখন আমার সব মনে পড়ছে। কিছু ভুল করছি না। শুধু কী কী ভুলে গেছিলাম, সেগুলো ভুলে যেতে চাই। কারণ, ভুলে যাওয়া ছাড়া আমি মিলির কাছে তাড়াতাড়ি ফিরতে পারব না।