গ্রীষ্মের তীব্র দাবদাহ, বর্ষার অবিশ্রাম ধারাপতন আর রৌদ্র-মেঘের গুমোট ভাব পেরিয়ে আসে বছরের তৃতীয় ঋতু শরৎ। সোনার আলোয় ঝলমল করে ওঠে ধরাতল। দুই তীরে কাশফুলের উচ্ছ্বসিত শুভ্র হাসিতে চঞ্চলা স্রোতস্বিনী থমকে দাঁড়িয়ে চেয়ে থাকে। তার গতিপথ হয় মন্থর। আকাশের গাঢ় নীল আর শস্যক্ষেতের হরিৎ রং মেখে বাতাস হয় দিক্ভোলা—কোন দিকে বয়ে যাবে, পাহাড় না সমুদ্রের দিকে! আঙিনার কোণে শিউলিগাছটি পায় ফুল ফোটানোর আহ্বান। তার ঐশ্বর্যে ভরা শাখা-প্রশাখায় কুঁড়ি-কিশলয়ের প্রাচুর্য। গোটা বঙ্গভূমি যেন শারদোৎসবের একখানা শুদ্ধ, সুন্দর মণ্ডপ রূপে প্রতিভাত হয়। এমন সময় দেবীপক্ষের ভোরে সহসা বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের গম্ভীর কণ্ঠে উচ্চারিত হয় শাক্তদের ধর্মগ্রন্থ, শ্রীশ্রী চণ্ডীর শ্লোক—যা দেবী সর্বভূতেষু ...। পরক্ষণেই ভোরের শান্ত, নির্জন প্রান্তরে ছড়িয়ে পড়ে—বাজল তোমার আলোর বেণু, মাতল যে ভুবন...।
যখন থেকে গান শুনতে শিখেছি, সুরের দোলায় মন হারিয়ে গেছে অতীন্দ্রিয়লোকে, সেই সুদূর শৈশবে এই গানটি আমায় মন্ত্রমুগ্ধ করেছিল। সে ভালো লাগা আজও ম্লান হয়নি। হয়তো হবেও না এ জীবনে। বর্ষার শেষ। ঝকঝকে পরিষ্কার আকাশ থেকে রুপালি জ্যোৎস্নাধারা ঝরে পড়তে শুরু করেছে। পেঁজা তুলোর মতো একখণ্ড শুভ্র-উজ্জ্বল মেঘ অকারণে লেগে থাকে আকাশের গায়ে। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চির অমর সৃষ্টি “মোনালিসা”-র মতো রহস্যময় হাসি হেসে মৃদুমন্দ বাতাসে শিহরিত হয়ে ওঠে ধানক্ষেত। তখন মনের মধ্যে আলোর বেণুটিও সুরের ইন্দ্রজাল ছড়াতে থাকে, ভর করে শরতের মোহন রূপ। ঠিক এমন সময়ে বাঙালির ঘরে ঘরে বার্তা আসে শারদ-রাণী দেবী দুর্গার আগমনের। যত সব ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠান আছে তার মধ্যে শারদীয়া দুর্গোৎসব সম্ভবত সর্বশ্রেষ্ঠ। এমন মহাসমারোহ, এত দীর্ঘ সময় অনুষ্ঠানের বিস্তৃতি বোধ করি আর কোন ধর্মীয় অনুষ্ঠানে বিরল। তাই জাতি-ধর্ম-বর্ণনির্বিশেষে প্রতিটি বাঙালি এ নিয়ে গর্ব করতে পারে। কারণ, এটি একমাত্র বাংলার উৎসব, বাঙালির উৎসব। এই উৎসবকে ঘিরে সুপ্রাচীন কাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত সংগীত, চলচ্চিত্র, গল্প-উপন্যাস-কবিতা কত সাহিত্য যে সৃষ্টি হয়েছে, তার হিসাব নেই। আমাদের আর্থসামাজিক এবং ঐতিহ্যগত জীবনে এ উৎসবের বিপুল ভূমিকা রয়েছে। সামষ্টিক জীবনে এত বড় আনন্দের উৎসব আর নেই। তবু অগোচরে কিছু কথা থেকেই যায়। যে কথাগুলো মনে বিষণ্নতা আনে, দীর্ঘশ্বাস আনে। সেই অনালোকে থেকে যাওয়া কথাটি বলাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
দুর্গোৎসব একসময় বসন্তকালে অনুষ্ঠিত হতো। যেহেতু বসন্ত ঋতুরাজ। এ সময়ে ফুল-ফলের প্রাচুর্য থাকে প্রকৃতিতে। মধু ঋতুতে তাই বাসন্তীপূজা নামে এটি প্রচলিত ছিল। আজও এটা কমবেশি অনুষ্ঠিত হয়। কিন্তু কৃষিভিত্তিক বাংলায় বসন্ত রবি ফসলের মৌসুম। কৃষকগণ তখন শস্যের আবাদ অথবা শস্য সংগ্রহে ব্যস্ত থাকে। এত দীর্ঘ সময় উৎসবে মেতে থাকার প্রতিকূল পরিবেশ। অন্যদিকে দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা বাসন্তীপূজার সময় পরিবর্তনও এক রকম অসম্ভব। সমাজের ধর্মানুভূতিতে আঘাত লাগবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে কৃষিকাজের অবসরই ধর্মীয় উৎসবের প্রশস্ত সময়। বাংলার মানুষ বৈশাখে শুরু হওয়া খরিপ ফসলের মৌসুম শেষ করে বর্ষার সমাপ্তিতে। শরতে তাই সমাজজীবনে অখণ্ড অবসর। কৃষিভিত্তিক বাংলার ঘরে ঘরে তখন ফসলের প্রাচুর্য। আউশ ধান, মানকচু, আখ, পান, নারিকেল-সুপারি, কলা—কী নেই এ সময়ে! এমন সময়ই তো উৎসবে মেতে ওঠার শ্রেষ্ঠ সময়। তাই হয়তো সমাজবিদ, পণ্ডিতগণ মিলে দুর্গোৎসবের সময় স্থানান্তরিত করার প্রয়াস করেছিলেন। কিন্তু ধর্মভীরু মানুষ তো সহজে এটা মেনে নিতে পারে না! তাদের বিশ্বাসযোগ্য কোন ধর্মীয় আবেগ থাকতে হবে। তাই রচিত হলো পৌরাণিক কাহিনি। শ্রীরামচন্দ্র সনাতন ধর্মের একজন আদর্শ পুরুষ। তিনি সত্যে অবিচল, প্রজাবৎসল রাজা। রামায়ণের বীর নায়ক, যে রামায়ণ দাদু-ঠাকুমা থেকে শুরু করে সব মানুষের মানুষের মুখে মুখে ফেরে। অতএব রাজা শ্রীরামচন্দ্রের দোহাই দিয়ে ‘অকালবোধন’ নাম নিয়ে বসন্তোৎসব চলে এলো শরতে। এটা কৃষিভিত্তিক বাংলায় উৎসবের একান্ত উপযুক্ত সময় বলে। নইলে আর্য রাজা শ্রীরামচন্দ্র প্রাক্-আর্যদের সংস্কৃতি পালন করে প্রতিমা পূজা করবেন, এমনটা ভাবার কোনো যৌক্তিক অথবা ঐতিহাসিক প্রমাণ মেলে না। প্রতিমা পূজা একান্তই এই দক্ষিণ-পূর্ব ভারতের ভূমিপুত্র—প্রাক্-আর্য জনগোষ্ঠীর নিজস্ব সংস্কৃতি। তারপর সহস্র বছর ধরে নান উত্থান-পতন, পরিবর্তন-পরিমার্জন, সংযোজন-বিয়োজনের মধ্য দিয়ে শারদোৎসব আধুনিক রূপ লাভ করেছে।
সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যুগোপযোগী পরিবর্তন গ্রহণ করতে পারে যে ধর্ম তা-ই শ্রেষ্ঠ। কারণ, ধর্ম মানুষের জন্য। আর মানুষের জীবন-সমাজ-সভ্যতা প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। তাই ধর্মীয় বিধি-নিষেধগুলোও প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে মানুষের জন্য কল্যাণ ও মঙ্গলময় হয়ে উঠবে, সুন্দর ও শাশ্বত হয়ে উঠবে, এটাই সত্য। ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে সহস্র বছর ধরে দুর্গতিনাশিনী দেবীরূপে যে প্রতিমা পূজা করে আসছে ভক্তগণ, তারও পরিবর্তন হয়েছে বারে বারে। আজকে যে দুর্গা প্রতিমা আমরা পাই, তা অনেক প্রতিমার সংকলন। আর সুপ্রাচীন কাল থেকে স্বয়ং দুর্গা দেবীর কত বিবর্তন হয়েছে! খ্রিষ্টপূর্ব চতুর্থ শতকে কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে পাওয়া যায় ‘অপরাজিতা’ নামে দেবী দুর্গা পূজিতা হতেন। দেবী পুরাণ, খিল হরিবংশ, দেবী ভাগবত এমনকি তৈত্তিরীয় আরণ্যকের অন্তর্গত যাজ্ঞিকা উপনিষদে দুর্গা দেবীর ভিন্ন ভিন্ন রূপ বর্ণনা পাওয়া যায়। তারপর চতুর্থ শতকে মধ্য ভারতের উদয়গিরিতে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় নির্মিত দেবীর প্রস্তরমূর্তি আর নবম শতকে পুরুলিয়ার দেইলাঘাটায় প্রাপ্ত ক্লোরাইট পাথরের দেবীমূর্তির রূপও এক নয়। বহু পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত রূপ লাভ করেছে ষোড়শ শতকে। তারপরেও পরিবর্তন হয়েছে। এর কারণ হচ্ছে মানবসভ্যতার অগ্রগমন। প্রাচীন যুগে মানুষের জীবনযাত্রা, চিন্তাচেতনা যেমনটি ছিল ক্রমশ তা পরিবর্তিত হয়েছে। তাই দেবীর শিল্পমূর্তিতেও তার ছোঁয়া লেগেছে।
একটি বিশেষ লক্ষণীয় বিষয় হচ্ছে, দেবী দুর্গার প্রতিমার সঙ্গে অন্যান্য দেব-দেবীর সন্নিবেশ ঘটেছে। আর এ সংকলন ঘটেছেও সহস্র বছর ধরে। পৌরাণিক মতে, সুরথ রাজা মেধস মুনির উপদেশ অনুযায়ী রাষ্ট্রীয় বৃহত্তর অশুভ শক্তি বিনাশ করে শান্তি ও কল্যাণ স্থাপনের জন্য দুর্গোৎসব করেন। সর্বসাধারণের মঙ্গল বিধানের জন্যই এ পূজার সূচনা। তাই কালক্রমে দেবী দুর্গা হয়ে ওঠেন রাষ্ট্রশক্তি অথবা স্বদেশ মূর্তির প্রতীক। একটি আদর্শ রাষ্ট্রে যেসব বৈশিষ্ট্য আবশ্যক, সেই সব বৈশিষ্ট্যের দেব-দেবীগণ দেবী দুর্গার পাশে স্থান লাভ করেন। জ্ঞানের দেবী সরস্বতী, সম্পদের দেবী লক্ষ্মী, সার্বভৌমত্ব রক্ষাকারী দেব সেনাপতি কার্তিক, এবং গণপতি গণেশ স্থান লাভ করেন মহাদেবীর সঙ্গে। স্বদেশ মূর্তির কথা চিন্তা করলে একটি আদর্শ রাষ্ট্রে এই বিষয়গুলো একান্তভাবেই আবশ্যক এবং সে হিসেবে এটি সুন্দর এবং শ্রেষ্ঠ সংকলন। সেই সঙ্গে প্রকৃতির ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব ধরনের উদ্ভিদরাজি, জীবজন্তু অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে এ সংকলনে। কারণ, পরমেশ্বর এই সবকিছুর স্রষ্টা। প্রকৃতির ক্ষুদ্র-বৃহৎ সবকিছুই তাঁর উপাসনার উপাচার।
আধুনিক সময়ে মানুষের ধর্ম-ভাবনা, ধর্মীয় উৎসবের রূপরেখা আমূল পরিবর্তন হয়েছে। পরিবর্তন হয়েছে প্রকৃতিতেও। এখন শরতের আগমন হয় চুপিসারে। পুরো ঋতুজুড়ে থাকে ভ্যাপসা গরম আর বৃষ্টির আধিক্য। কাশবন বিদায় নিয়ে সেখানে ঠাঁই নিয়েছে উচ্চ ফলনশীল ফসল নয়তো ভিনদেশি চাম্বলগাছ। নদীতীরে কাশফুলের জন্য অনাবাদী জায়গা নেই। একই অবস্থা শিউলি ফুলেরও। তাই কখন যে চুপিসারে শরৎ আসে, টেরই পাওয়া যায় না। এই নেতিবাচক পরিবর্তনের প্রভাব পড়েছে আমাদের মনেও।
সভ্যতার অগ্রগমনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ সুন্দর, সংস্কৃতিবান, বিভেদ-বৈষম্যমুক্ত হবে—এমনটা জীবনের অনির্দেশ শর্ত। কিন্তু অপরাজনীতির কারণে হোক বা সংস্কৃতিহীনতার কারণেই হোক, বাস্তবতার নিরিখে দেখা যায় মানুষ প্রতিদিন আরও বিদ্বেষপূর্ণ ও কঠোর স্বভাব লালন করছে। তাই বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান শারদোৎসব আজ নানা রকম সংশয়-শঙ্কার মধ্য দিয়ে পালন করতে হচ্ছে। ধর্মীয় সহনশীলতা দিন দিন একেবারেই লোপ পেতে বসেছে। বড় হয়ে উঠেছে সংখ্যাগুরু-সংখ্যালঘুর মতো সংকীর্ণ, ঘৃণ্য শব্দগুলো, যা একজন বিবেকবান মানুষের উচ্চারণ করতে বাধাগ্রস্ত হওয়ার কথা। আর তার প্রভাব পড়ছে সব ধর্মমতের অনুসারীদের ওপর। কোনো প্রার্থনালয়ই আজ আর নিরাপদ নয়। অথচ আমরা নিজেদের ধার্মিক বা ধর্মভীরু বলে পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি।
অন্যদিকে শারদোৎসবও আজ আর ঠিক ধর্মীয় অনুষ্ঠান নেই। এটি প্রাণহীন একটি নিরস আয়োজনে পরিণত হয়েছে। সামাজিক মিলনের একটি মাধ্যম মাত্র, যাকে আড্ডা বলা যেতে পারে। যে ধর্মীয় বাতাবরণে এই অনুষ্ঠান ছিল, সেটি ক্রমশ মুছে যাচ্ছে। হয়ে উঠছে সমাজ এবং রাজনীতিনির্ভর জাঁকজমকপূর্ণ একটা প্রতিযোগিতা মাত্র। এর বাহ্যিক রূপটি দীর্ঘদিনের সংস্কার এবং অভ্যাসের ফলে সাধরণ মানুষের কাছে ধর্মীয় অনুষ্ঠান বলেই হয়তো প্রতিভাত হচ্ছে। কিন্তু অন্তর গেছে শুকিয়ে। একটু লক্ষ করলেই তা টের পাওয়া যায়।
আজ সবচেয়ে বড় সাধনা হচ্ছে, আত্মস্থ হওয়া, প্রাণপূর্ণ হওয়া। বিদ্বেষ-বৈষম্যের মতো তুচ্ছ অমানবিক বৈশিষ্ট্যগুলোর কারণ এবং অনুপযোগিতার কথা উপলব্ধি করা। মানুষের কৌতূহল, বিস্ময়বোধ একেবারেই ভোঁতা হয়ে উঠেছে। অতৃপ্তি, লোভ, ঔদ্ধত্য মনে বাসা বেঁধে আমাদের দিন দিন প্রাণহীন করে ফেলেছে। মানবিক প্রয়োজনে, জীবনবোধে আমরা যদি প্রাণোচ্ছল হয়ে উঠতে পারি, তবে আমাদের ধর্মীয়-সামাজিক উৎসব, দৈনন্দিন জীবনায়োজন সবই প্রাণস্ফূর্তিতে উচ্ছ্বসিত করে উঠবে।
শারদোৎসবও আবার প্রাণের আলোয় ঝলমল করে উঠবে। আবার মানুষের প্রাণে প্রাণে বেজে উঠবে আলোর বেণু। সেই সাধনায় ব্রতী হওয়া ছাড়া আমাদের আর অন্য পথ নেই।