জার্মান বুদ্ধিবৃত্তিক ইতিহাসে ভারতচর্চার সুদীর্ঘ ইতিহাস আছে। বড় বড় নামজাদা জার্মান পণ্ডিত ভারত নিয়ে অনেক গবেষণা করেছেন, লিখেছেন এবং মন্তব্য করেছেন। প্রাচীন বিশ্বসভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ অংশও ভারত। তাছাড়া বিশ্বসভ্যতার অন্য একটা দিকও আছে—আরব ও ইউরোপ ভাগ্যজয়ের জন্য ভারতমুখী ছিল। সেই ইতিহাসও বিশ্ববিদিত। কথাটা আমরা অন্যভাবেও বলতে পারি: হযরত ঈসা অর্থাৎ যিশু খ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই ইউরোপের দৃষ্টি ভারতে ছিল।
মহামতি আলেকজান্ডার (খ্রি.পূ. ৩৫৬-৩২৩) ভারত আক্রমণ করেছেন। ১৭৫৭ সালে ইংরেজ দস্যুদের হাতে পদানত হবার আগেও ভারত ছিল পশ্চিমাদের আগ্রহের কেন্দ্র। বর্তমান যুগে যেমন সারা দুনিয়ার লোকজন ইউরোপ ও আমেরিকায় ভাগ্য জয়ের আশায় পাড়ি জমায়, তেমনি তৎকালীন সাহসী ও উদ্যমী লোকজন ভারতমুখী ছিল। আরব, তুরকি, পারসি, মোগল উজবেক ও আফগানরা অনেকদিন ভারত আক্রমণ করেছে, লুট করেছে আবার কেউ কেউ স্থায়ীভাবে বসবাস করেছে। শুধু ইউরোপ কেন, আরব ও পারস্যদেশের লোকজনও ভারত নিয়ে উল্লেখযোগ্য বইপুস্তক লিখেছেন। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পারস্যদেশীয় বিশিষ্ট পণ্ডিত আল বেরুনির ( ৯৭৩-১০৪৮) কথা। তাঁর লেখা ভারততত্ত্ব এখন চিরায়ত পুস্তক হিসেবে বিশ্বস্বীকৃত।
ভাসকো দা গামা (১৪৬০-১৫২৪) প্রথম ইউরোপীয় নাবিক যিনি সমুদ্রপথে ভারতে আসেন। আর ক্রিস্টোফার কলম্বাস (১৪৫১-১৫০৬) ভারত অভিমুখে যাত্রা করে পথ ভুলে আমেরিকায় পৌঁছান। তাই আমেরিকায় পৌঁছে সেখানকার অধিবাসীকে রেড ইন্ডিয়ান অর্থাৎ লাল ভারতীয় বলে আখ্যা দেন। সেই মহামতি সম্রাট আলেকজান্ডারের আমল থেকে শুরু করে এখনও পশ্চিমাদের ভারতমুখী নানা তৎপরতা অব্যাহত আছে। সেবব তৎপরতার নানামুখী স্রোত আছে, যথা রাজনৈতিক, বাণিজ্যিক, সাংস্কৃতিক এবং বুদ্ধিবৃত্তিক। আমাদের আলোচনা সীমিত রাখব জার্মান বুদ্ধিজীবীদের ভারত ভাবনা, সুনির্দিষ্টভাবে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের ভারত ভাবনা বিষয়ে।
যে কজন জার্মান পণ্ডিত ও গবেষক ভারত নিয়ে নিজেদের ভাবনা প্রকাশ করেছেন তাঁদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য হলেন:
(১) মিথিয়াস খ্রিস্টিয়ান স্প্রেনজেল (Mathias Christian Sprengel: 1746-1803)।
(২) কার্ল ভিলহেম ফ্রেডারিখ স্কেলজেল (Karl Wilhelm Friedrich Schlegel: 1772-1829)।
(৩) ইমানুয়েল কান্ট (Emanuel Kant : 1724-1804)।
(৪) জর্জ ভিলহেম ফ্রেডারিখ হেগেল (Georg Wilhelm Friedrich Hegel: 1772-1829)।
(৫) আর্থার সোপেনহাওয়ার (Arthur Schopenhaur: 1788-1860)।
(৬) কার্ল মার্কস (Karl Marx: 1818-1883)।
(৭) ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস (Friedrich Engels: 1820-1895)।
(৮) ম্যাক্স মুলার (Max Muller : 1823-1900)।
(৯) পল ডিউসেন (Paul Deussen : 1845-1919)।
(১০) ম্যাক্স বেবার (Max Weber : 1864-1920)।
এই বিশেষ কয়েকজন ছাড়াও আরও অনেক জার্মান পণ্ডিত, গবেষক ও ভারত বিশেষজ্ঞ আছেন। তবে এই লেখায় আমরা কেবল কার্ল মার্কসের আজীবন বন্ধু বিশিষ্ট চিন্তাবিদ, কমিউনিস্ট ইস্তেহারের সহলেখক ফ্রেডারিখ এঙ্গেলসের ভারত ভাবনা নিয়ে সামান্য আলোকপাত করব। উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদবিরোদী চিন্তাশীল সকল মানুষ জানেন, ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস পদানত ভারতে ব্রিটিশ দখলদারদের শোষণ ও নিপীড়নের চমৎকার বিবরণ প্রদান করেছেন। কারণ এঙ্গেলস ছিলেন সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী একজন কল্যাণমুখী বিপ্লবী। সেসব বিবরণ থেকে তাঁর ভারত ভাবনার একটা ধারণা পাওয়া যায়। আবার কার্ল মার্কস ও অন্যদের সমীপে লিখিত চিঠিতেও তাঁর ভারত ভাবনা প্রকাশ পেয়েছে।
ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ১৮৫৮ সালের ৮ মে ‘লক্ষ্ণৌ আক্রমণের বিশদ বিবরণ’ নামে একটা প্রবন্ধ লিখেন এবং তা ২৫ মে ‘নিউ ইর্য়ক ডেইলি ট্রিবিউন’ পত্রিকায় মুদ্রিত হয়। তাঁর সেই লেখায় দখলদার ইংরেজের লুটপাট, খুন, জবরদখল এবং সামগ্রিক দস্যুতার একটা চিত্র ফুটে উঠেছে। সেই প্রবন্ধটি পাঠে জানা যায়, ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস কিভাবে ভারতের অতীত, বর্তমান ও ভবিষ্যত নিয়ে চিন্তাভাবনা করেছেন। তাঁর ভাবনার প্রধান কারণ ও উদ্দেশ্য ছিল উপনিবেশবাদের লুণ্ঠনচিত্র তুলে ধরা ও সাধারণ মানুষের মুক্তির জন্য প্রেরণা সৃষ্টি ও দিকনিদের্শনা প্রদান করা। তিনি সমগ্র জীবনটাই জ্ঞানসাধনা, মানুষের মুক্তি ও বিপ্লবের জন্য উৎসর্গ করেছেন। তাঁর ভারত ভাবনার প্রতিটি শব্দে, বাক্যে ও বক্তব্যে মানুষের প্রতি আন্তরিকতা, আদর এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধিতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ‘দি লন্ডন টাইমস’ পত্রিকার লেখক জনাব রাসেলের প্রতিবেদন ও মন্তব্যের জবাবেই ফ্রেডারিক এঙ্গেলস সাহসী মতামত ও বিশ্লেষণ প্রকাশ পেয়েছে।
ভারত ইতিহাসের দিকে দৃষ্টিপাত করলে জানা যায়, ১৭৫৭ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ভারতের দখলদার ব্রিটিশের জুলুম ও অনাচার ভারতবাসী কোনো না কোনোভাবে প্রতিরোধ করার চেষ্টা করেছে। আর প্রতিদিনের সেই প্রতিরোধে কোথাও না কোথাও ভারতীয়দের প্রাণ হরণ হয়েছে। রক্ত ঝরেছে। ভারতীয়দের রক্তে ব্রিটিশদের হাত রঞ্জিত হয়েছে। সমগ্র ভারত একদিনে ব্রিটিশদের হাতে পদানত হয়নি। যুদ্ধ, খুন, লুটপাট ও উচ্ছেদের মাধ্যমে ব্রিটিশরা জবরদখল কায়েম করেছে। দখলদার ব্রিটিশদের লক্ষ্ণৌ আক্রমণ প্রসঙ্গে ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস বলেন:
“আক্রমণকারী পক্ষ এগুতে শুরু করলেই এলোমেলো ধাবন শুরু হয় পশ্চাদ্ভাগের দিকে, আর যেখানে বহির্গমনের অল্প কয়েকটি সংকীর্ণ পথ বর্তমান সেখানে ভীড়াক্রান্ত দঙ্গলটা থেমে যায় আর বিনা প্রতিরোধে আগুয়ান বৃটিশের গুলি ও বেঅনেটে কচুকাটা হয়ে পড়ে। আতঙ্কিত দেশীয়দের ওপর এই রকম একটা আক্রমণেই “ব্রিটিশ বেঅনেট” যত হত্যা করেছে তা ইউরোপ ও আমেরিকা মিলিয়ে ইংরেজরা যত যুদ্ধ করেছে তার চেয়েও বেশি।” (উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, পৃ. ১৮৭)।
‘দি লন্ডন টাইমস’ পত্রিকার সাংবাদিক জনাব রাসেলের বিবরণ থেকে এঙ্গেলস অনেক ভয়াবহ চিত্র, লুঠতরাজ ও ধ্বংসযজ্ঞের বিষয়ে মতামত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেন: “মি. রাসেলের ভদ্র মন্তব্য অনুসারে সেদিন কাইজারবাগ জয় এত অপ্রত্যাশিত হয় যে নির্বিচার লুণ্ঠন আটকাবার সময় ছিল না। তারই বৃটিশ গ্রেনেডিয়াররা অবাধে অযোধ্যা প্রভুর জড়োয়া, দামী অস্ত্র, বেশভূষা ও সর্ববিধ কাপড়চোপড় হস্তগত করেছে, এ দৃশ্য খাঁটি মুক্তিপ্রিয় জন বুলের কাছে ভারি মজার লেগেছিল নিশ্চয়। শিখ, গুর্খা ও লোকলস্করেরা এ দৃষ্টান্ত অনুসরণে খুবই রাজী ছিল এবং লুণ্ঠন ও ধ্বংসে যে দৃশ্যের অবতারণা হয় তা স্পষ্টতই মি. রাসেলের বর্ণনা ক্ষমতাকেও ছাড়িয়ে যায়। অগ্রগমনের প্রতিটি নতুন পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গে চলেছে লুটপাঠ ও বিধ্বংস।” (উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, পৃ. ১৮৭-১৮৮)
নানা দেশেই দালাল, মানে রাজনৈতিক কাক, কোকিল ও কুকুর তখনও ছিল এখনও আছে। জবরদখলদার ও দস্যু ব্রিটিশদের সৃষ্ট কিছু কিছু রাজনৈতিক কাক, কোকিল ও কুকুর আগের মতো বর্তমানে বাংলাদেশেও বিদ্যমান। আক্ষরিক অর্থে না হলেও অন্ততপক্ষে ভাবনা ও চেতনায়। তারা এখনও দস্যু ব্রিটিশদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ। দালালদের হয়তো তাতেই সুখ। তারা বলে ব্রিটিশরা অনেক দিয়েছে। দখলদার ব্রিটিশের বড় সফলতা ভারতে তাদের অনুগত রাজনৈতিক কাক, কোকিল ও কুকুর জন্ম দিতে সক্ষম হয়েছে। ইতিহাসের দীর্ঘ সময়ে পদানত, অনুন্নত ও পরাধীন ভারতের এটাই বৈশিষ্ট্য। তাই ভারত এখনও পরাধীনতার সংস্কৃতি থেকে বের হতে পারেনি, অন্তত একটা শিক্ষিত নামধারী গোষ্ঠী। সেসব দালাল, মানে রাজনৈতিক কাক, কোকিল ও কুকুরের উদ্দেশ্যে জার্মান চিন্তাবিদ ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস অত্যন্ত বলিষ্ঠভাবে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘বৃটিশ সামরিক সার্বিসের চিরস্থায়ী কলঙ্ক হয়ে থাকবে ১৮৫৮ সালের লক্ষ্ণৌ লুট।’
মহান ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস ব্রিটিশ দখলদারদের বিরুদ্ধে লন্ডনে বসেই নিজের নিরাপত্তা ঝুঁকি মাথায় নিয়ে ভারতে ব্রিটিশদের লুঠতরাজ ও দস্যুতার বিরুদ্ধে লিখেছেন। তাতে তাঁর সাহসিকতার প্রমাণ যেমন আছে তেমন আছে উপনিবেশবাদ, শোষণ ও লুন্ঠনের প্রতিবাদ। আর তাঁর এসব লেখার মূলে আছে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও মুক্তি ভাবনা। তিনি আজীবন উপনিবেশবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের তীব্র সমালোচনা করেছেন, নিন্দা করেছেন এবং মানবতার জন্য সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবার আহ্বান জানিয়েছেন। একই সাথে তিনি ভারতে দখলদার ব্রিটিশদের দস্যুতা সম্পর্কে সাহসী বক্তব্য তুলে ধরেন। তিনি বলেন: “ভারতের ওপর সভ্যীকরণ ও মানবীকরণ প্রগতি চালিয়ে বেপরোয়া সৈন্যরা যদি বা কেবল দেশীয়দের অস্থাবর সম্পত্তি লুট করেছে, ব্রিটিশ সরকার আবার অব্যবহিত পরেই এসে তাদের স্থাবর সম্পত্তিও কেড়ে নিলেন।” (উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, পৃ. ১৮৯)।
আমরা এখানে এঙ্গেলসের এই লেখাতে দেখতে পাই ব্রিটিশরা ভারতে প্রবেশ করেছে দখলদার ও দস্যু হিসাবে এবং প্রায় দুইশত বছরব্যাপী লুঠতরাজ অব্যাহত রেখেছিল। এই মহান চিন্তাবিদ ভারতে সম্ভাব্য বিপ্লবের আশাবাদী ছিলেন তবে দেখতে পাননি ভারতে ব্রিটিশ শাসনের ফলাফল কেবল চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয় বরং রাজনৈতিক কাক, কোকিল ও কুকুর পুনরুৎপাদন প্রক্রিয়াও চিরস্থায়ী করেছে। কারণ ভারত আপোষের মাধ্যমে ব্রিটিশদের কাছ থেকে ক্ষমতা গ্রহণ করেছে, অর্জন করে নাই। যুদ্ধ বা সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করে নাই। সুবিধাবাদের বীজ এখানেই রোপিত হয়েছে।
বরাত
১. কার্ল মার্কস ও ফ্রেডারিখ এঙ্গেলস, উপনিবেশিকতা প্রসঙ্গে, বিদেশী ভাষায় সাহিত্য প্রকাশালয়, মস্কো, ১৯৮৬।
২. Dietmar Rothermund, The German Intellectual Quest for India, Manohar Publications, New Delhi, 1986.
৩. G. R. Madan, Western Sociologists on Indian Society, Routledge and Kegan Paul, London, 1979.