• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

প্রজাপতির ডানা


অমর মিত্র
প্রকাশিত: জুলাই ১৭, ২০২১, ০৪:৪৯ পিএম
প্রজাপতির ডানা

প্রজাপতিটি স্বপ্নে আসে যখন রং ফুটফুট ডানা নিয়ে, গুয়ায়াস নদীর পশ্চিম কূলের শহর গুয়াকুইল থেকে ঘুমের ভেতরে ডাক আসে, জয়িত্রী…। প্রজাপতির ডানা খসে স্বপ্ন আর ঘুম দুই-ই ভেঙে যায়। সেই দেশটা প্রশান্ত মহাসাগরের ওপারে, পশ্চিম গোলার্ধে, আসলে তখন হয়তো তার দ্বিপ্রহর, কিংবা অপরাহ্ণ বেলা, জয়িত্রীর রাত গভীর। অ্যালেক্স তা জেনেও ফোন করবে ওই সময়ে। অ্যালেক্স তার ঘুম ভাঙাবেই ল্যান্ড লাইনে ফোন করে। অ্যালেক্স কি বুঝে নিতে চায় সে ঘরে না বাইরে? রাতে সে একা আছে, না অন্য কেউ আছে ঘরে? মার্কো পোলোর কথা বলেছিল জয়িত্রী। সেই ভেনিসীয় ভূপর্যটক, লকডাউনে নিজের শহরে ফেরার পথে সেজান নদীর তীরে সেজান শহরে এসে পড়েছে, মেয়র তাকে সাদরে আতিথ্য দিয়েছেন। এই শহর করোনামুক্ত, এই শহর নিরাপদ, আপনি এখানে রয়ে যান, দেশে ফিরে ভ্রমণবৃত্তান্তে এই শহরের সুনাম করবেন।
অ্যালেক্স বলেছিল, বুড়ো মার্কো মৃত্যুর ভয়ে সেজান শহরে এসে ঘাঁটি গেড়েছে। ভেনিসে ফিরুক, ভেনিস, মিলানে গেলেই মরে যাবে, ইতালিতে বুড়োদের চিকিৎসা হচ্ছে না শুনেছি, হাসপাতালে নিচ্ছে না, ট্র্যাস, আবর্জনার ভেতরে জ্যান্ত অবস্থায় বসিয়ে দিচ্ছে জলের বোতল আর প্যারাসিটামল হাতে ধরিয়ে।
কী বলছ তুমি অ্যালেক্স, অ্যালেক্সি নিকোলভ, প্রথম মহাকাশচারী, ভস্তক থেকে বেরিয়ে তুমি নক্ষত্রমালার ভেতরে হেঁটে গিয়েছিলে, তোমাকে আমি আদর করে বলতাম না, নভশ্চর অ্যালেক্স!
মার্কো পোলো—বুড়ো চিল, সেজান শহরে রয়েছে কেন? অ্যালেক্স গরগর করে উঠল, যেন এক সারমেয় সন্দেহ করেছে অচেনা মানুষ কাউকে। 
এমনি করে বলে, হি ইজ আ রেস্পেক্টেড ম্যান, ভুবন ঘুরে বেড়ান মানুষ, অ্যালেক্স, তুমি মহাকাশ বিজ্ঞানী, ইকুয়েডরের আকাশ দেখতে গিয়েছিলে, সব ঠিক হয়ে যাক, ফিরে আসবে প্রিয় নভশ্চর।
ঘ্যাসঘেসে গলায় অ্যালেক্স বলল, আমি সেই কুকুর লাইকা, যে স্পুটনিকে করে মহাকাশে পাড়ি দিয়ে আর ফেরেনি।
তুমি ফিরবে অ্যালেক্স, প্রিয় নিকোলভ।
স্টপ জয়িত্রী, স্টপ, আমি নিকোলভ নই, আমি লাইকা, হারিয়ে যাচ্ছি মহাশূন্যে। 
জয়িত্রী চুপ করে থাকে। কী বলবে, অ্যালেক্স কি সত্যিই হারিয়ে যাবে? জয়িত্রীর চোখে ভেসে ওঠে স্পুটনিকের জানালায় লাইকার মুখ। সে-ই ছিল প্রথম জীবিত প্রাণী, যে মহাকাশে ভেসে গিয়েছিল। লাইকা ভেসে চলেছে মহাশূন্যে। তার চোখের সমুখে অগণন নক্ষত্র। তার বিস্ময় আর কাটে না। সেই বিস্ময় নিয়ে কোথায় মিলিয়ে গেল, কোন ছায়াপথে চলে গেল, তা কেউ জানে না। লাইকা আর ফেরেনি। 
তুমি ওই মার্কোকে বলো মেয়রকে বলতে।
মেয়র অখুশি হবেন। জয়িত্রী ঘুম চোখে বলেছে।
অ্যালেক্স বলল, লোকটা সেজান সিটিতে পড়ে আছে কেন, ভেনিসে গিয়ে মরুক?
আমি কি ফোন রেখে দেব, এখন মাঝরাত, আমি কি ঘুমোব না?
অ্যালেক্স বলেছিল, মেয়রকে বলো আমাকে নিয়ে যেতে, বুড়ো মার্কোর সঙ্গে তোমার কী জয়িত্রী? 
জয়িত্রী চুপ করে ছিল। অ্যালেক্সের কথা মন্দ মনে হয়েছিল, তারপর নিস্পৃহ স্বরে উত্তর দিয়েছিল, তা আমি তো জানি না।
তুমি মেয়রকে বলতে পেরেছিলে? ঘ্যাসঘেসে গলায় জিজ্ঞেস করে অ্যালেক্স।
জয়িত্রী বলেছিল, না, মেয়রের সঙ্গে কি দেখা করা যায়, মেয়র ডাকলে তবে যেতে পারি।
তুমি তাঁর কাছে সময় চাও।
চাওয়া যায় না, মেয়রের নিষেধ আছে তা কি তুমি জান না? জয়িত্রী অবসাদক্লিষ্ট গলায় বলেছিল। 
আমি যদি মরে যাই, এখানে পটাপট মানুষ মরছে, হাসপাতাল থেকে বডি ভ্যানিশ হয়ে যাচ্ছে, আমিও ভ্যানিশ হয়ে যাব লাইকার মতো, একটা অবোধ প্রাণীকে মহাকাশে পাঠাল তারা, ফিরবে কি না ঠিক নেই, মানুষ খুব নিষ্ঠুর, আমিও মরে যাব একা একা। অ্যালেক্স বলে উঠেছিল ক্রুদ্ধ স্বরে, আমাকে কোভিড নিয়ে নেবে।
জয়িত্রী চুপ করে ছিল। আশ্চর্য, তার ভেতরে শেষ কথার কোনো প্রতিক্রিয়া হয়নি। একই কথা বারবার বলার কারণে কী? নাকি সে তার অ্যালেক্সি নিকোলভের কাছ থেকে দূরে সরে যাচ্ছে। সে যে আদরে তাকে নভশ্চর ডেকে শিহরিত হতো, সেই শিহরণ কি আছে আর? জয়িত্রীর ভেতরের প্রেম কি নিঃশেষিত? এই যে অ্যালেক্স এত দিন নেই, তার বিরহ কোথায়? সে মেনে নিয়েছে অ্যালেক্সের ওই প্রবাসজীবন। লকডাউনে আটক হয়ে থাকা। অ্যালেক্স থাকলে মার্কোকে কি সময় দিতে পারত? আগ্রাসী অ্যালেক্স, সে কিছুতেই মেনে নিত না। মেয়র বললেও না। জয়িত্রী এক সপ্তাহ আগে মেয়রের সঙ্গে দেখা করেছে। মাসে দুই পক্ষে দুদিন তাকে রিপোর্ট করতে হয়। পূর্ণিমা ও অমাবস্যার দিনে। সামনের ৭ তারিখে আবার যাবে। ফুলমুন ডে, বুদ্ধপূর্ণিমা। মেয়র যখন তাকে সময় দেন, তখন সূর্যাস্ত হয়ে যায়। সেজান নদীর পারে সূর্য ডুবলে মেয়র ডাক দেন। তাকে রিপোর্ট দিতে হয়। তখন মেয়র জিজ্ঞেস করেন মার্কো কেমন আছে? যেন মেয়র মার্কোর খবর রাখেন না। জয়িত্রীর রিপোর্টে থাকে সব কথা। সেই যে বালিকা মরিচক্ষেত থেকে ১৫০ কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরতে ফিরতে মৃত্যুর দিকে হেঁটে গেল, তার কথা, সেই নছিমন বিবি, আয়না বিবিরা কপোতাক্ষ নদের ধারে বসে অশ্রুপাত করছিল দূর আরব দেশে আটকা পড়া স্বামীর জন্য, সেই কথা…।
মেয়রের সামনে জয়িত্রীর মনে পড়েনি অ্যালেক্সের কথা। সে কি কোনো দিন সেজান নদীর ধারে বসে চোখের জল ফেলেছে অ্যালেক্সের জন্য? সে যখন মেয়রকে পড়ে শুনিয়েছে রিপোর্টের অংশ অংশ, তার কেন মনেই পড়েনি অ্যালেক্সের কথা, তখন কি সে মেয়রকে বলতে পারত না, ফিরিয়ে আনুন স্যার। বিমান পাঠালেই হয়ে যায়। বলেনি।
অ্যালেক্স বলল, মেয়রকে মেসেজ করো।
করেছিলাম, উত্তর পাইনি। জয়িত্রী বলল। কথাটা সত্য বলল না।
আমি এবার ঘর থেকে বেরিয়ে পড়ব, আমি হাঁটতে থাকব, তুষারপাত বন্ধ হয়েছে, চেরি ফুটেছে, এখন আমি হেঁটে সেজান শহরে ফিরব জয়িত্রী।
জয়িত্রী বলেছিল, এসব করো না, মাথা স্থির করে থাকো, বহুদূর, নদী আছে, পাহাড় আছে, সমুদ্র আছে, কোভিড আছে, খুব শিগগির সবকিছু স্বাভাবিক হয়ে যাবে।
জয়িত্রী তুমি হোয়াটসঅ্যাপে এস, আমি তোমাকে দেখব।
জয়িত্রী ল্যান্ড লাইন রেখে মোবাইল ফোন খুলল। এই অ্যানড্রয়েড ফোনের ক্যামেরা খুব ভালো। এতে মার্কো এবং তার অনেক ঝকঝকে ছবি আছে। উদ্যানে, রঙ্গালয়ের সামনে, রাস্তায়, সেজান নদীর ধারে। এটি মেয়রের উপহার। উপহার বলা যাবে না, কাজের জন্য দেওয়া। নয় ইঞ্চি পর্দা। কত রকম অ্যাপস। ‘ব্রিজ অন দ্য সেজান’ অ্যাপ ডাউনলোড করে নিতে হয়েছে। সেই অ্যাপ খুলে রাখতে হয়। সেই অ্যাপে নাকি আপনা-আপনি সব ডেটা ট্রান্সফার হয়ে যায়। এবং সরাসরি চলে যায় মেয়রের কাছে। এসব শোনা কথা। লোকে সত্য-মিথ্যায় কল্পনা করতে ভালোবাসে। এই মোবাইল থেকেই সে তার রিপোর্ট ট্রান্সফার করে মেয়রের মেলে। আবার এখান থেকেই পড়ে শোনায় কিছু কিছু অংশ। জয়িত্রী বোঝে না বাংলাদেশের খুলনা জেলার কপোতাক্ষতীরে রোদনরতা তিন রমণীর কথা জেনে মেয়রের হবে কী? তাদের স্বামী আরব দেশে বসে আছে অনাহারে, হায়, মক্কা মদিনা জেদ্দা সৌদি, মরুভূমি হয়ে গেল আবার সব।
জয়িত্রী ফোন অন করতে হোয়াটসঅ্যাপে ভিডিও কল। অ্যালেক্সের মুখ। জয়িত্রী দেখল প্রেত। গালভর্তি দাড়ি, এই কি নভশ্চর অ্যালেক্স! দীর্ঘদেহী অ্যালেক্স সেই রূপবান যুবক উদোম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বুকের হাড় গোনা যাচ্ছে। কোটরে ঢুকে গেছে নীল নয়নতারা। গাল ভেঙে গেছে। খাবার পায় তো অ্যালেক্স? পেট ঢুকে গেছে ভেতরে। সোনালি চুল ধূসর হয়ে গেছে অনেক। অ্যালেক্সের পৌরুষ ঘুমিয়ে আছে। জয়িত্রী চেনে ওই অঙ্গ। আকর্ষণীয়, দৃঢ়, যৌবনের উল্লাসে ভরপুর। একদিন নয়, কয়েক দিন সে ওই পৌরুষ পরখ করেছে ঝড়ের উল্লাসে। সে চোখ বন্ধ করল। কী রকম হয়ে গেছে অ্যালেক্স। বুড়ো ঘুঘু। পালক খসিয়ে দিচ্ছে ক্রমাগত। অ্যালেক্স বলল, তুমি উন্মুক্ত হও, তোমার রাত্রিবাস ফেলে দিয়ে আমার মতো হও জয়িত্রী। দেখি আমি আগের মতো হতে পারি কি না।
জয়িত্রীর ভয় করতে লাগল। বলল, তুমি ফোন বন্ধ কর অ্যালেক্স। জয়িত্রী ফোন অফ করে দিল। এই ভিডিও কল কি ‘ব্রিজ অন দ্য সেজান’ অ্যাপ মারফত মেয়রের কাছে চলে যাবে? হয়তো যাবে। কেউ কেউ ফিসফিস করছে, ওই অ্যাপ ব্যক্তির সব গোপনীয়তায় থাবা বসাবে। না হলে ওই অ্যাপ কেন? তাকে আর একটি ফোন কিনতে হবে। আর একটি নাম্বার। পৃথক করে ফেলতে হবে মেয়রের অ্যাপ থেকে ব্যক্তিগত জীবন। সে ল্যান্ড লাইনের রিসিভার নামিয়ে রাখল ক্রেডল থেকে। আর যেন ফোন না আসে। টেবিল থেকে জলের বোতল নিয়ে প্রায় এক বোতলই শেষ করে ফেলল। তারপর চিত হয়ে শুয়ে পড়ল। পালক খসে যাওয়া বুড়ো পাখি। এমনকি হতে পারে, দিনের পর দিন অবরুদ্ধ হয়ে থাকলে মানুষ এমনি হয়ে যায়? জয়িত্রীর চোখে জল এসে গেল। সে নির্দয় নয়, মায়া-মমতাহীন নয়। অ্যালেক্স কাছে থাকলে ভালোবাসা উথলে পড়ে। কিন্তু অ্যালেক্স দূরে চলে যাওয়ার পর এখন আর তেমন উতলা হয় না। তাহলে কি তার ভেতরে প্রেম নেই? সে কি কোনো দিন ভালোবাসেনি তার নভশ্চরকে? অ্যালেক্স সত্যিই কি নভশ্চর নিকোলভ নয়, লাইকা? নভশ্চর ঘরে ফিরে এসেছিল, লাইকা ফেরেনি। অ্যালেক্সও ফিরবে না সত্যি? যদি তাকে কোভিড-১৯ খেয়ে নেয়? আর ভাবতে পারছে না জয়িত্রী। ঘুমতে চেষ্টা করল, পারল না। মনে হলো গান শোনে। নেট অন করে ইউটিউবে মোজারট, বাখ, বেটোভেন…। একটি বাঁশির কথা বলেছিল মার্কো পোলো। সং অব দ্য রিভার। ইন্ডিয়ান ফ্লুট পারফর্মার হরিপ্রসাদ চৌরাশিয়া, সেই বাঁশি সে শুনেছিল একদিন খুব ভোরে। কী স্নিগ্ধ তার সুর। মনে হয় অন্ধকারের নদী ভোরের দিকে বয়ে যাচ্ছে। সেই নদী সেজান হতে পারে। সেই নদী গঙ্গা কাবেরি, ভোলগা, রাইন হতে পারে। কিন্তু সেই বাঁশি শুনতে হলে তাকে নেট অন করতে হবে। নেট অন করলেই অ্যালেক্স।
অ্যালেক্স…না লাইকা, মহাকাশযান স্পুটনিক ভেঙে সে লাফিয়ে পড়বে পৃথিবীর উদ্দেশে। তারপর ভাসতে থাকবে। ভেসেই যাবে অনন্তে। আর যদি সেই মহাকাশযানের ভেতরে থেকে যায়, ছায়াপথের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে, তারাদলের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে ঘুমিয়ে পড়বে অবসাদে। সেই ঘুম আর ভাঙবে না। জয়িত্রী বালিশে মুখ গুঁজল। বাঁশি শুনতে খুব ইচ্ছা করছে, কিন্তু ভয় করছে। এখন অনলাইন হলেই অ্যালেক্স। লাইকা। তাহলে কি সে অ্যালেক্সকে ব্লক করে দেবে? তখন আর সে যোগাযোগ করতে পারবে না। স্পুটনিকের সঙ্গে একসময় পৃথিবীর যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। লাইকা হারিয়ে গিয়েছিল অন্ধকারে তারাদলের ভেতরে। সত্যিই তাই, নাকি তাকে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়া হয়েছিল। পৃথিবীর মানুষের কাজ ফুরিয়েছিল তো। স্পুটনিক লাইকাকে নিয়ে ধেয়ে যাক অনন্ত শূন্যতার দিকে। কুকুরের লেজে তারাবাজি…। 
জয়িত্রীর মনে পড়ল বাড়ির গ্রামোফোনের কথা। রেকর্ড সংগ্রহ ছিল বাবার কম না। নানা অপেরা সংগীত ছিল বাবার খুব পছন্দের। মা-ও ওই অপেরাই পছন্দ করত। অপেরাগুলো ছিল প্রেমে ব্যর্থতার। কান্নায় ভরা ছিল অনেকটা অংশ। কোনো কোনো অপেরা কান্নাতেই শেষ হতো। মা চোখের জল মুছত মাথার কাপড় দিয়ে। গ্রামোফোন আস্তে আস্তে হারিয়ে গেল। রেকর্ড গেল কমপ্যাক্ট ডিস্ক আসতে। কম্প্যাক্ট ডিস্ক এলে গ্রামোফোন আর দরকার পড়ল না। ছোট ছোট ডিস্ক প্লেয়ারে বাজার ছেয়ে গেল। কদিনের অজানা জ্বরে মা চলে গেল। বাবা আবার বিয়ে করলেন, কিন্তু গ্রামোফোন ত্যাগ করেননি, শোনা কমে গিয়েছিল। জয়িত্রীর মনে হলো সে আগামীকাল সকালে মার্কোকে নিয়ে গ্রামোফোন খুঁজে বেড়াবে। আর রেকর্ড। কোভিড-১৯ তাকে ফিরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে ওই দিকে। কিন্তু সে কি ‘সং অব দ্য রিভার’ রেকর্ড পাবে? রেকর্ডই পাবে কি না, সন্দেহ। রেকর্ড ডিস্ক সব উঠে গেছে। সব মোবাইল ফোনে ঢুকে গেছে। জয়িত্রী উপুড় হয়ে বালিশে মুখ চেপে রাখল। কী দেখেছে সে? কাকে দেখেছে। অ্যালেক্সের প্রেত। মহাকাশে গিয়ে অবসাদে ঘুমের ভেতরে মরে যাওয়া লাইকার প্রেত। এই রকম অন্ধ নিস্তব্ধ রাতের ভেতরে একসময় ঘুমই আসে। যেমন এসেছিল লাইকার। অ্যালেক্সের যেমন আসে। অনেক বেলায় জেগে উঠল জয়িত্রী।

দুই.

মার্কো বলল, তুমি মেয়রকে বল।
মেয়র ওকে পছন্দ করেন না।
কেন, কী করেছিল সে?
জয়িত্রী মাথা নাড়ে, কিছুই করেনি, কিন্তু মেয়র ওকে পছন্দ করতেন না, ও কোনো কিছুই সহজে মেনে নেয় না, জয়িত্রী বলল, ও বাটারফ্লাই এফেক্টের কথা বলত, একটি রঙিন প্রজাপতি যদি ফুলের মধু পান করতে করতে তার ডানা কাঁপাতে পারে নিশ্চিন্তে, অনাবৃষ্টিতে পতিত হয়ে যাওয়া সোমালিয়ার আকাশে তখন মেঘের সঞ্চার হতে পারে, সুন্দরই পৃথিবীকে সুন্দর করে। আর এর বিপরীত হয়েছিল আইজ্যাক আসিমভের গল্পে। টাইম মেশিনে করে কিছু মানুষ চলে গিয়েছিল হারিয়ে যাওয়া দূর অতীতে। একটি ধাতব পাতের ওপর দিয়ে হাঁটছিল তারা, নিষেধ করে দেওয়া হয়েছিল, তারা যেন কোনো ফুলপাতা। পতঙ্গ স্পর্শ না করে। তারা দেখতে পাচ্ছিল অতিকায় ডাইনোসর হেঁটে যাচ্ছে, অবলুপ্ত নানা বন্য প্রাণী ঘুরে বেড়াচ্ছে দুপাশে। একজন দেখল একটি রঙিন প্রজাপতি থির থির করে ডানা কাঁপাচ্ছে একটি ফুলের ওপর বসে, লোকটি হাত বাড়াতেই সেই ছোঁয়ায় প্রজাপতির ডানা খসে গেল, ফুলের ওপর থেকে ছিটকে পড়ে মরে গেল। দশ লাখ বছর আগে যা ঘটেনি, তা ঘটিয়ে এলো লোকটা। এরপর তারা বর্তমানে ফিরে এসে দেখল, আমেরিকার ইলেকশনে যুদ্ধবাজ মানুষটি জিতে গেছে, দেখল তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ লেগে গেছে…।
তার জন্য কি মেয়র…? কথা অসম্পূর্ণ রাখে মার্কো পোলো। 
মনে হয়, মেয়র বলেছিলেন, উন্মাদে এমন করে ভাবে।
জয়িত্রীর আজ নীল জিন্স, দুধ শাদা কলার দেওয়া হাফহাতা শার্ট। তার ওপরে পাতলা উলেন জ্যাকেট। জ্যাকেটের রং আকাশি নীল। পায়ে শু। ইয়ারিং দুটি দুই বিন্দুর মতো কানের লতিতে ফুটে আছে। চুলে লাল রিবন একেবারে গোড়া থেকে বাঁধা। রেকর্ডের কথা শুনে মার্কো বলল, যা ছেড়ে এসেছি, তার দিকে আর ফেরা যায় না, তুমি এই শহরে গ্রামোফোনের দোকান কোথায় পাবে, রেকর্ডই বা পাবে কোথায়? 
জয়িত্রী শহরের প্রধান বিপণিতে ফোন করল, সেখান থেকে খবর এলো রেকর্ড এবং গ্রামোফোন দেখতে হলে মিউজিয়ামে যেতে হবে। মার্কো পোলো বলল, বাড়ি থেকে নিয়ে এস।
বাবা নিয়ম করে অপেরাগুলো শোনাত আমাদের, একই গান কিন্তু শুনতে ক্লান্তি ছিল না, এমন সুর, অন্তরাত্মায় গিয়ে প্রবেশ করত, আমরা যে যার জায়গায় চুপ করে বসে থাকতাম, ঠিক যেন প্রেয়ার হচ্ছে, চার্চে যে গান হয়, যিশুর গান, সেই গান যেমন সকলে শুনতে শুনতে চোখের জল ফেলে, তেমনি।
মার্কো বলল, কলকাতা শহরে এখনো এমন দোকান আছে যারা পুরোনো রেকর্ড বিক্রি করে, রেকর্ড জোগাড় করে বনেদি বাড়ি থেকে, যে মানুষটা রেকর্ড শুনত, তার মৃত্যুর পর সব আবর্জনা হয়ে যায়, সব বিক্রি করে দেয় বাড়ির লোক, হল্যান্ডের গ্রামোফোন, রেকর্ড, আর যদি থাকে বই, তা-ও।
পুরোনো রেকর্ড কেউ কেনে?
অনেক খরিদ্দার আছে জয়িত্রী, এক রেকর্ড কালেক্টরের সঙ্গে আমার আলাপ হয়েছিল, বুড়ো ইয়াকুব, খিদিরপুরে বাড়ি, কোভিড তাকে ধরেছিল, সে বেঁচেও উঠেছে, বলে মিউজিক তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।
জয়িত্রী বলল, গান তাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে, অ্যালেক্স গান শুনতে পারে একা একা। 
মার্কো হাসল, বলল, লাইকা কি গান শুনতে শুনতে হারিয়ে গিয়েছিল? 
তুমি জান তা?
না, আমি জানি না, হয়তো জানতাম, হয়তো তখন আমি বৈকানরে ছিলাম, যেখান দিয়ে স্পুটনিক উড়ে গিয়েছিল, ভুলে গেছি, তুমি কি মিউজিয়ামে যাবে?
যাব, আমি কোনো দিন এই মিউজিয়ামে যাইনি, গানের জাদুঘর। 
মার্কোও কোনো দিন গানের জাদুঘর দেখেনি। সেখানে গেলে যে গান শুনতে চাইবে, তা হয়তো শুনতে পাওয়া যাবে। গানের ইতিহাস জানা যাবে। জয়িত্রী সেখানে গিয়ে ‘সং অব দ্য রিভার’ শুনে আসতে পারে। জয়িত্রী সেখানে গিয়ে অপেরাগুলোর রেকর্ড দেখতে পারে। কেউ দান করে দিয়েছে হয়তো। জয়িত্রী বলল, তার নতুন মার সব ভালো, কিন্তু গান পছন্দ করত না, অপেরার গান একদম না।
তাহলে?
বাবার সঙ্গে অশান্তি হতো।
তারপর?
আমি জানি না, একবার একটা লং প্লেয়িং রেকর্ড আছড়ে ভেঙেছিল নতুন মা।
মার্কো বলল, তোমার সামনে?
না, বাড়ি ফিরে আমি শুনেছিলাম, তা বাদে মা খুবই ভালো, খুব কেয়ারিং, বাবাকে খুব যত্ন করে, 
ভালোবাসে, কিন্তু গান তার বিশ্রী লাগে।
তারপর?
বাবা গান শুনত বটে, মা নিয়ম করে দিয়েছিল, দিনে এক ঘণ্টা, একটা অপেরাও সম্পূর্ণ হতো না, এই করতে করতে বাবা গান শোনা বন্ধই করে দিল।
তাহলে তুমি নিয়ে আসতে পার সব নিজের কাছে।
না, বাবা তাহলে আঘাত পাবেন, সেই আঘাত সহ্য করতে পারবেন না।
সেদিন রাতে জয়িত্রী তার মোবাইল অন করে ইউটিউবে খুঁজে বের করল সেই অপেরা। গান শুনতে শুনতে তার শৈশবে ফিরে গেল। সেই যে মা বসে আছে, ভাই বসে আছে, সে বসে আছে। বাবা দুচোখ বন্ধ করে আছে। চতুর্দিকে সুরের মূর্ছনা। অপেরায় সেই প্রেমিক তার ভালোবাসার মেয়েকে খুঁজে বেড়াচ্ছে। কুচবরণ সেই কন্যার মেঘবরণ চুল। হাসিতে মুক্তো ঝরে। সেই চাষির মেয়েকে ধনী কৃষকের পুত্র লুট করে নিয়ে গেছে। মেয়ে বলেছে তার একটা ব্রত আছে, তা না সম্পূর্ণ করলে সে অভিশপ্ত হয়ে যাবে। স্বামীও রেহাই পাবে না…। সময় নিতে লাগল মেয়ে, তার প্রেমিক এসে তাকে উদ্ধার করে নিয়ে যাবে। জয়িত্রী শুনতে শুনতে ভাবছিল ভিডিও কল বেজে উঠবে। তাকে ডাক দেবে অ্যালেক্স, তার মহাকাশচারী প্রেমিক। কিন্তু অ্যালেক্সের ফোন এলো না। জয়িত্রী গান বন্ধ করে দিল। হোয়াটসঅ্যাপে ডাক দিল। অফলাইন আছে সে। অবসাদে ঘুমিয়ে পড়েছে অবরুদ্ধ যুবক। দ্রুত তাকে ঘিরে নিচ্ছে বার্ধক্য। জয়িত্রী বুঝল তার গা গরম হয়েছে। চোখ ছলছল করছে। মাথা ভার, যন্ত্রণা শুরু হয়েছে। ঢোঁক গিলতে কষ্ট হচ্ছে। জয়িত্রী তার জানালার পর্দা সরিয়ে দিল। অকাল মেঘে ঢাকা আকাশ। বাইরে বৃষ্টি আরম্ভ হয়েছে ঝিরিঝিরি। তুষারপাত হতে পারে। জয়িত্রীর দম আটকে আসতে লাগল। ঘুমন্ত কোভিড-১৯ তার ভেতরে জেগে উঠছে ধীরে ধীরে। সেজান শহরে কোভিড-১৯ ঢুকে পড়ল নাকি আবার? কোথায় কোন বনের ভেতরে এই বসন্তে প্রজাপতির ডানাটি ছিঁড়ে দিল কে?

Link copied!