কখন ঘুম ভাঙল মনে নেই, জেগে দেখেছি, ও আসেনি। সোফায় বসে অপেক্ষা করতে করতে নিশ্চয়ই ঘুমিয়ে পড়েছিলাম, বিছানায় যাওয়ার কথা মনে নেই।
আলো দেখে বুঝতে পারছিলাম ভোর হতে দেরি নেই। ঠান্ডা বাতাস আসছিল দখিনের জানালা দিয়ে, চাদরটা গায়ে টেনে নিলাম। এলে এ-ঘরেই আসত সে, দুজনের জন্য গোছানো এ-ঘর। খাটের ওপর পড়ে আছে চকলেট আর বই। এসেছিল নাকি ও!
আবার ঘুমিয়ে পড়ি, স্বপ্ন দেখি ও আসেনি।
আমার মায়ের যেদিন ষাট বছর পূর্তি হলো, সেদিন সকালে তিনি হঠাৎ করেই মারা গেলেন, মৃত্যুর মতো কোনো অসুস্থতা তার ছিল না। তখন আমার বয়স চব্বিশ, বাবা হঠাৎ ঘটে যাওয়া নিদারুণ দুঃখটা মেনে নিতে পারলেন না। তার স্বভাবজাত রসিকতাবোধটাও আর ফিরে পেলেন না, বাড়ি ও সংসারের প্রতি যে স্নেহ ছিল, তা-ও হারিয়ে ফেললেন। গভীর বিষণ্নতা থেকে মদ্যপান ধরলেন আর যেন হারানো সুখের সন্ধানে বেপরোয়া ঘোরাঘুরি করে ফিরতেন। একদিন তিনি ফিরলেন না; বারো দিন পরে তার খোঁজ পাওয়া গেল। মরা তোর্ষার পাশে বাইশগুড়ি শ্মশানে অচেতন, পাশে এক বয়সী অন্ধ কুকুর ঠায় বসে! আর চেতনা ফিরে পেলেন না, সম্ভবত এ রকমই কিছু চেয়েছিলেন। ষোলো মাস পরে বাবা চেতনাহীনই মরে গেলেন। বাবার মৃত্যু-পরবর্তী নিঃসঙ্গ কিছু মাস সেই অন্ধ কুকুরকে সঙ্গী করে নিউ কোচবিহার স্টেশনে বসে সময় কাটিয়ে দিতাম। আমি জানতাম যে আমি অতীতে বাস করছি এবং আরও জানতাম যে ওই অতীত ওখানে সব সময়ই আমাকে ঘিরে থাকবে আর আমি নিজে অতীতেরই অংশ।
এপ্রিলের অলস দুপুর। সেই বিশাল স্টেশনে নীরবতা ছাড়া কিছু ছিল না। ব্যস্ততা নেই, স্টেশনের পাশে মৌনিবাবার আশ্রমে কেউ নেই, তবু দূরের ডুরিয়ারহাট থেকে মানুষের শব্দ টের পাচ্ছিলাম–কিছু বিশেষ ঘটনা মনে ছিল বলে স্মৃতিবিভ্রম হচ্ছিল, বহুদিন আগে যে মেয়েটিকে আমি পড়িয়েছিলাম, সে তো নিশ্চয়ই এই প্রত্যন্ত গ্রাম ছেড়ে চলে গেছে। ঘুরে দাঁড়িয়ে দেখি শব্দটা যে-পথে এসেছিল সে-পথেই ফিরে যেতে যেতে মুহূর্তের জন্য ইতস্তত করল, তারপর দুপাশের গাছগাছালির ভেতরের দুটো রংচটা পিলার পার হয়ে ঢুকে পড়ল।
সেই বড়, চওড়া সামনের দরজা ঠিক আগের মতোই রোদে-জ্বলা বিবর্ণ হয়ে আছে। আমি পাশের দরজাটায় গেলাম– এতে কড়া বা ঘণ্টি কিছুই নেই, দরজাটা শুধু রাতে বন্ধ থাকে। ঠেলে ঢুকেই চোখে পড়ল সিঁড়ির এক দেয়ালজুড়ে অখণ্ড ভারতের মানচিত্র তার পাশেই জোকারের ছবি; দীর্ঘ, শীতল করিডর গিয়ে শেষ হয়েছে রান্নাঘর আর বাসন ধোয়ার ঘরে। কয়েকটি গলার স্বর ভেসে আসছিল, মাঝে মাঝে কান্নার শব্দ হচ্ছিল। কে ওখানে দরিয়া বলতেই সব শব্দ থেমে গেল। ঝাঁকড়া চুলের গেরুয়া পোশাক পরা একটি যুবক পেছন ফিরে তাকাল আমার দিকে।
আমি আবার কে বলতেই যুবকটি উঠে দাঁড়াল আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মনে হলো আরে এই তো আমি।
‘এ কী আশ্চর্য’, বলে ওকে সম্ভাষণ জানালাম আমি। অন্যদের মধ্যে দুজন বয়স্ক লোক উঠে দাঁড়িয়ে মাথা ঝোঁকাতে দরিয়া হাত মেলাল ওদের সঙ্গে।
আমি আনন্দের সুরে বললাম, ‘তুমি দুপুরেই এসেছ, তাহলে’, আমার এই জিজ্ঞাসার ভঙ্গিটা দরিয়া ভোলেনি। কানায় কানায় উপচে পড়া হাসি আমার সমস্ত চেহারায় প্রাণসঞ্চার করল। আগে ওর চুল লম্বা ছিল, মাঝে মাঝে বেণি করত, এখন গুছিয়ে পেছনে টেনে আঁচড়ানো।
দাঁড়িয়ে-পড়া একজন দরিয়ার জন্য চেয়ার টেনে দিয়ে বলল, ‘সব ভালো তো?’
বয়স্ক দুজন ফেলে আসা দেশ, বাগির পুবের মিঠা খাল, গাজীর মাঠের বর্তমানে কী অবস্থা খোঁজখবর জেনে যখন স্মৃতি হাতড়াতে হাতড়াতে বিদায় নিয়ে বেরিয়ে গেল। তখনো বিস্ময় কাটছে না আমার, দরিয়ার চোখে চোখ পড়ছে, আর গুনগুন করে বলছি, ‘বাপ রে’, আমার দেখার এই ভঙ্গিটাও ভোলেনি দরিয়া।
বেশ কিছুদিন রইল দরিয়া। আমি যখন মিনতির সুরে বলেছি, ‘চলো ওই গ্রাম থেকে ঘুরে আসি’, তখন দরিয়ার মনে হয়েছে ওরা একসঙ্গে হাঁটবে এ তো স্বাভাবিক, আগের চেনা পথে ওর হাঁটতে যাওয়া উচিত আর আমি গ্রাম পেরিয়ে স্টেশনে নিয়ে যাব, তা-ও তো স্বাভাবিক। যেখানেই যাক ঘণ্টার পর ঘণ্টা যে কেটে যাবে, এ তো জানা ছিল না।
আমার মায়ের মৃত্যুর কথা শুনল দরিয়া আর তার পরপরই বাবার। আমি বলেছিলাম, একমাত্র সন্তানের ভাগ্যই এ রকম, উত্তরাধিকারের প্রাপ্ত সম্পত্তি প্রত্যাখ্যান করা যায় না, গ্রহণ করতেই হয়।
দরিয়া অপেক্ষায়, প্রায়ান্ধকার স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে ছিল, ট্রেন সেদিন খুব দেরিতে পৌঁছাল।
পথক্লান্ত দরিয়া একটা গ্রামে থামল। তারপর এক হোটেল বারে একটা ড্রিংক নিল এবং আরেকটা নেওয়ার পর আর গাড়ি চালাতে চাইল না, রাতটা হোটেলেই থাকল। স্বপ্নে দেখল, দেশভাগে এওয়াজ বদল করে এলোচিয়ার দত্তবাড়ি অসম চলে এসেছে, অসমের বাঙালি খেদাও আন্দোলনের রাত শব্দ বন্ধ করার জন্য কীলক দিয়ে আঁটা জানালা, বেগুনক্ষেতে লুকিয়ে আছে সবাই। দূর থেকে আগুনের চিৎকার ভেসে আসছে। আর আমি কেঁদেই চলেছি।
দরিয়ার হাতে লেখা খামে একটা চিঠি এলো। একা হলে পড়ব বলে চিঠিটা রেখে দিলাম বুকপকেটে।
দিনের শেষ দিনহাটা লোকাল চলে গেলে চিঠিটা পড়লাম। ‘এত যুগ পরে তোমাকে আবার দেখলাম, কী যে আশ্চর্য লাগল। তোমাকে ছেড়ে আসতে আসতে ভাবছিলাম, সময় যেখানে থমকে আছে সে থাক সেখানেই; কিন্তু এ কথা ভেবে না ফিরে এলে নিজেকে মাফ করতে পারতাম না।’
লিখেছে, ‘কত মায়া তোমার, তোমার মা-বাবার সেই আতিথেয়তাই মনে হলো। এবার বিয়ে করে সংসারী হও।’ নিজেকে নিয়ে কোনো কিছু না বললেও আমার মনে হলো দরিয়া বিবাহিত। মূল্যবান চিঠি, চিঠিটা আমি ভাঁজে ভাঁজে ভাঁজ করে রেখে দিলাম। উত্তর দিতে ইচ্ছে করল না, কেবল মনে হলো, ও তো ফিরে এসেছে।
শরতের মেঘমুক্ত আকাশ। শৈশবের সুন্দর দিনগুলোর মতো একটা দিন। নাগরিকপঞ্জিতে আমার বাবা-মা ও আমার নাম এসেছে, দেশভাগের সময় অসম চলে আসা আমার দাদু বাঙালিখেদাও সময়ে অসম ছেড়ে কোচবিহার চলে এসেছিলেন সেই আমি সবাইকে হারিয়ে আজ দেশ পেলাম। মনে হলো এই দেশপ্রাপ্তির আনন্দে দরিয়াকে লিখি, ‘এ-গ্রীষ্মটাও কত সুন্দর, কী যে ভালো লাগছে – আজ তুমি আবার এলে।’
দরিয়া ফিরে যাবার পর, আর কোনো কথা আগেপরে না হলেও আমার মনে হতো আমরা এক হবে, কারণ দুজন একসঙ্গেই বেঁচে আছি ওই বাড়ি এবং এই নিঃসঙ্গ স্টেশনে।
রোববারের শান্ত বিকেলে স্বামীর সঙ্গে কথা বলল দরিয়া। যে পুরুষকে একসময় ও ভালোবেসেছিল এবং যে এখনো ওকে ভালোবাসে তাকে বলল, ওদের বিয়েটা ভুল হয়ে গেছে। বাগানে বসে ধীরস্বরে কথাটা বলল, বাগানে বাঁধানো জায়গা কম, কাছাকাছি রাখা ছিল বাগানচেয়ার দুটো।
একটা হাত বাড়িয়ে দিয়ে দরিয়া বলল, ‘আমি জানি তুমি খুব কষ্ট পেলে।’ তেমন না বুঝেই যেন ওর বাড়ানো হাতটা ধরল বৈভব।
নিরাশ করা গ্রীষ্মের পর শরতের রোদ যেন ক্ষতি পুষিয়ে দিচ্ছে—ঝোপঝাড়ের পাতা এখনো শুকোয়নি, কেবল রোগাটে হয়েছে, কমে গেছে তার সবুজাভা। কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যার অন্ধকার নামবে, সেদিনই একটু আগে কথাটা বলেছিল বৈভব। ওর দু-হাঁটুর ওপর খোলা বই, বুকমার্কটা পড়ে গিয়েছিল, খুঁজে নিয়ে জায়গামতো রেখে দিল।
অখণ্ড ভারতের একটা মানচিত্র ফ্রেমে বাঁধিয়ে দেয়ালে ঝোলানো হলো, ধর্মের ভিত্তিতে একটা অসাম্প্রদায়িক জনগোষ্ঠীকে দুই টুকরা করে দেবার মতো জোকস নাকি হয় না তাই মানচিত্রের পাশে জায়গা পেল তিন জোকার তাকিয়ে আছে ফ্যালফ্যাল করে আর চতুর্থ জোকার ওদের দিকে তাকিয়ে বিটকেল হাসি হাসছে। আমার ওয়ার্ডরোবটা এখন আমরা দুজন ব্যবহার করছি, পাশাপাশি ঝুলছে আমাদের কাপড়।
বাতাসে কান্নার সুর শিসের ধ্বনি; দমকা বাতাসের উন্মত্ততা। নিঃসীম প্রান্তরে আমাদের কথা হারিয়ে যেতে লাগল, নতুন করে শুরু করি, আবার হারায়। বিরক্ত দরিয়া রাগ করে বলল আমাকে সে দুবার দেখছে –আমার মন, স্বভাব, আমার হাসি ও দুঃখবোধ, সব মিলিয়ে দুবারই আমাকে তার অনন্য মনে হয়েছে– দ্বিতীয়বার ও দেখছে প্রেমিকার মতো করে। আর সেটাই তার জীবনের চরম ভুল।
নির্বাক আমি আস্তে করে কেবল বলি ‘তুমিই আমাকে কল্পনা করতে শিখিয়েছিলে’ –আমার কোমল স্বর ওর মন্তব্যের তীব্রতা বা মনকে স্পর্শ করল না। বাতাসে উড়ে গেল সে-কথা। সমাধানে পৌঁছে দেখোম শান্ত হয়ে গেছে উঠোন, কর্মীরা বাড়ি ফিরে গেছে। শীতে ভরা নির্জন গৃহ, অপেক্ষমাণ অন্ধ কুকুর।
বসন্ত সেবার আসি আসি করেও এলো না, সেই এক সকালে দেখা গেল দরিয়া নেই। ভোরে ঘুম ভাঙতে গাড়ির শব্দ পেয়েছিলাম।
স্টেশনমাস্টার দেখেছিলেন। কুলিরা দরিয়াকে ঘর থেকে তার জিনিসপত্র বার করে আনতে দেখেছিল। ওদের কাছে বিদায় নিয়েছে দরিয়া, ওদের সঙ্গে হাতে হাত মিলিয়েছে। অ্যান্টনির যাওয়ার সময় ওরা হাত নেড়েছে তারপর যতক্ষণ গাড়িটা দেখা গেছে ততক্ষণই ওরা তাকিয়ে ছিল।
ওর কাপড়চোপড়, কালি-কলম, অসমাপ্ত গল্প, বইপত্র সবই ও নিয়ে গেছে। কেবল অখণ্ড ভারতের মানচিত্র পড়ে রয়েছে, আর তারপাশে দেয়ালে ঝুলছে থতমত তিন জোকারের দিকে তাকিয়ে আরেক জোকারের হাসি। তাই ও চেয়েছিল, ওর একটি অংশ এখানেই রইল।
আমি ওর যাত্রাপথ জানি, কোথায় ও বিরতি নেবে জানি, একবার রাতে ও এক জায়গায় ছিল; কিন্তু পরে কখনো থাকেনি এবং এবারও থাকবে না। ওর পৌঁছাতে প্রায় সন্ধে হবে।
রোদ এসে পড়েছে রান্নাঘরে, বসন্ত আর গ্রীষ্মের দিনগুলোতে তাই হয়। মাঝে মাঝে পর্দা টেনে দিত দরিয়া, ওর পৌঁছতে সন্ধে হবে।
অন্ধ কুকুর নিয়ে বসেই থাকি। ভাবি ও সত্যকে এড়িয়ে যাবে, প্রতারণাও করতে হবে। স্বামীর কাছে ফিরে গিয়ে তার করুণার জন্য মিথ্যার আশ্রয় তো নিতেই হবে। ভালোবাসাকে বলবে উন্মত্ত মোহ আর মোহ তো কখনো স্থায়ী হওয়ার নয় এবং তা শেষও হয়ে গেছে।
টেবিলে রোজ যেমন কথা হয় তেমনি হলো, সকাল বেলার কাজের কথা তো হলোই যার কিছু শেষ হয়েছে আর কিছু হয়নি। আজকের আর আগামীকালের আবহাওয়া নিয়েও কথা হলো। এ-আলোচনায় অভ্যাসমতো আমিও যোগ দিই। ও ক্লান্ত হয়ে পড়বে, কিন্তু তবু নিজেকে সামলে রাখতে পারবে– ওটাই ওর স্বভাব। কৃতজ্ঞ স্বামী ওকে প্রত্যাখ্যান করবে না, চূর্ণ-বিচূর্ণ টুকরোগুলো আবার জোড়া লাগবে। একটা মাঠের পাঁচিল বদলে নতুন করে তৈরি হচ্ছিল, আমাকে ওরা জানাল কাজটা শেষ হয়েছে, আগে পাঁচিলে ওঠার সিঁড়ি ছিল না, এবার করা হয়েছে আর নতুন দরজাও বসানো হয়ে গেছে। ও আর ফিরে আসবে না, একবারের জন্যও না, কখনো না।