• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
লেখকের চিন্তা

কে কখন পশ্চাৎপদ, আর কখন অগ্রবর্তী!


জাকির তালুকদার
প্রকাশিত: আগস্ট ৫, ২০২১, ০৮:০৩ পিএম
কে কখন পশ্চাৎপদ, আর কখন অগ্রবর্তী!

এই লেখায় বসার সময় আমি কমলকুমারে চরম আচ্ছন্ন। প্রতিদিন পড়ছি কমলকুমারের গল্প বা উপন্যাসের অংশ, বা তার কোনো চিঠি, কোনো বিষয়ে কোনো মন্তব্য, তাকে নিয়ে লেখা অন্য কারও কোনো লেখার টুকরো-টাকরা অংশ। গত কয়েক মাসের মধ্যে কোনো একদিন যদি কমলকুমার-অমৃত থেকে দূরে থাকি, সেদিন মনে হয় নিজেকে ফাঁকি দিচ্ছি সাধনা থেকে, মনের ভেতরে তৈরি হয়ে যায় খুব অচেনা এক গহ্বর, যা সারা দিন কেবল অনুতাপ আর খচখচানি উৎপাদন করে। সেদিন প্রচুর আবেগের সঙ্গে রোমন্থন করার চেষ্টা করি আগে পড়া কোনো মহানুভব বাক্য, যেমন—‘প্লট? না না, প্লট কখনো গদ্য বা গল্পের বিষয় হতে পারে না, প্লটে বাড়ি হতে পারে... গদ্য বা গল্প কদাচ নয়... আসলে গদ্য বা গল্প একধরনের হয়ে ওঠা।... একধরনের আলেখ্য যা জীবনযাপনের অভ্যন্তরে হয়ে উঠতে থাকে। এই যে হয়ে ওঠা, এই হয়ে ওঠার মধ্যে যে দ্বন্দ্ববিরোধ, এই দ্বন্দ্ববিরোধের মধ্যে যে জাগ্রত অন্তর, এই জাগ্রত অন্তরের মধ্যে যে চরাচর, এই চরাচরের মধ্যে যে জীবসম্পর্ক, এই জীবসম্পর্কের মধ্যে যে আত্মীয়তা বা একধরনের অভিব্যক্তি, যা কিনা ঠাকুরের কৃপায় উপলব্ধ হয় এবং হয়ে ওঠে...”

আবার ধাক্কা খাই, যখন দেখি, এই কমলকুমার ‘বংশমর্যাদায়’ বিশ্বাস করেন। ‘আপার ক্লাসে’ বিশ্বাস করেন, ‘আপার ক্লাসের মনটা, তার সেনসিবিলিটি আপার ক্লাসের’। চার হাজার বছর ধরে চলে আসা বর্ণপ্রথায় বিশ্বাস করেন, আবার এটাও বিশ্বাস করেন যে আগের জন্মে সুকৃতির কারণেই তিনি এই পর্বে উচ্চবর্ণের মানুষ হয়ে জন্মেছিলেন। তিনি বিশ্বাস করেন যে কতকগুলো জিনিস ছেলেমেয়েদের জানবার দরকার নাই। “আপনার বাবা-মা যখন কথা বলতেন তখন আপনাকে বলতেন চলে যা। এখন সেটা বলা হয় না তো।

—এইটুকু ফ্ল্যাট। ফ্ল্যাটটাকে দোষ দেয় না। নিজের অপদার্থতা যে আমি বড় ফ্ল্যাটে থাকতে পারছি না, না, ওদের সব জানা উচিত। উল্টে নিয়েছে, বুঝতে পেরেছেন? আমি ফ্ল্যাট বড় করতে পারছি না, জীবনযুদ্ধে হেরে গিয়ে সে না বলে—না না ওদের সব জানা উচিত।”

মাঝে মাঝেই মনের মধ্যে প্রচণ্ড প্রতিরোধ তৈরি হয়ে যাচ্ছে। কমলকুমারের সব কথার সঙ্গে মাথা দুলিয়ে একমত হওয়া যাচ্ছে না, একমত হওয়া সম্ভব হচ্ছে না, আর তখন মনে পড়ছে যে তিনি তো বারেবারেই বলে দিয়েছেন যে সাহিত্য বা শিল্প একমত হওয়ার কোনো বিষয় নয়। এই কথাটায় তো দ্বিমত পোষণ করার কোনো অবকাশ নেই।

সাহিত্য আমাদের সময়ে সমাজ এবং রাষ্ট্রের প্রায় প্রান্তবাসী একটি জিনিস। তার ভূমিকা নিয়ে সমাজ সন্দিহান। আমরা লেখক নামক প্রাণীরাও সমাজের এই দৃষ্টিভঙ্গি দেখে হতাশ। তখন কমলকুমার প্রায় প্রত্যাদেশের মতো ঘোষণা করেন, বরাভয় জোগান— সাহিত্যের ‘ভূমিকা আছে। স্নেহ কথাটাকে রেখে যাব, আমরা প্রেম কথাটাকে রেখে যাব। আমরা শ্রদ্ধা কথাটাকে বাঁচিয়ে যাব।’

এই রকম সময়ে আমাকে সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে লিখতে বসতে হচ্ছে। আমরা লেখকরা আসলে বিচ্ছিরি রকমের পরাধীন। আমরা রাষ্ট্রের আদেশকে অগ্রাহ্য করতে পারি, প্রতিষ্ঠানের আহ্বানকে উপেক্ষা করতে পারি, করপোরেটকে বুড়ো আঙুল দেখাতে পারি; কিন্তু তারপরেও আমরা স্বাধীন নই। লেখককে পরাধীন রাখার কত যে দৃশ্য-অদৃশ্য হাতিয়ার রয়েছে! যেমন ভালোবাসা, স্নেহ-শ্রদ্ধার সম্পর্ক, ভালো সম্পর্ক, লিটল ম্যাগের প্রতি কর্তব্যবোধ, কৃতজ্ঞতার প্রকাশ, ঋণশোধের অদৃশ্য তাড়া, সামাজিক দায়িত্ববোধ। এই রকম আরও কত কিছু। সেই কারণেই যখন যা নিয়ে লেখার কথা, তা নিয়ে না লিখে অন্য বিষয়ে লিখতে বসতে হয়। যখন গান শুনতে, সিনেমা দেখতে, কিংবা খেলা দেখতে, কিংবা স্রেফ আড্ডা দিয়ে বা কিছুই না করে দিন কাটিয়ে দিতে মন চায়; লিখতে বসার ইচ্ছা মোটেও জাগে না, তখনো লিখতে বসতে হয়।

সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে নিয়ে লিখতে বসা মানে তাঁকে আবার নিজের মতো করে পাঠ করা। এই লেখা বা নিজের মতো করে পড়া শুরু করতে না করতেই দেখলাম আমি ডুবে যাচ্ছি, সিরাজ আমাকে টেনে নিচ্ছেন তাঁর জগতে। অপ্রতিরোধ্য সেই টান। গদ্যের কমলকুমারীয় কারিশমা নেই, চিত্রকল্পের সেই মনোমুগ্ধকর খেলা নেই, দৃশ্য তৈরির মুহূর্তে সেই দৃশ্যকে ভেঙে ছত্রখান করে দিয়ে পাঠককে বিমূঢ় করার প্রবণতা নেই, তা সত্ত্বেও, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আমার সামনে দাঁড়িয়ে পড়েন মহীয়ান লেখকের মর্যাদা নিয়ে। সত্যিকারের লেখক, সত্যিকারের বড় লেখক। তখন আরও একবার মনে পড়ে জীবনানন্দের কথা—কবিতা আসলে অনেক রকমের হয়। এবং সত্যিকারের কবিতার মতো সত্যিকারের যে কোনো শিল্প পরস্পর থেকে যতই অন্যরকম হোক না কেন, তাদের অভিন্ন চরিত্র হচ্ছে, সেগুলোর সামনে মাথা আপনাতেই নত হয়ে আসা।  

 

“আল্লাহ বলেছেন, কিছু চিরস্থায়ী নয়। কেউ কাউকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাই আল্লাহ বলেছেন, কোনো কিছুর জন্য শোক হারাম। মৃতের জন্য শোক হারাম। নষ্ট হওয়ার জন্য শোক হারাম। কিছু হারানোর জন্য শোক হারাম। যে তোমার কাছ থেকে চলে যাচ্ছে, তার জন্য শোক হারাম।”

সৈয়দ আবুল কাশেম মুহাম্মদ ওয়াদি-উজ-জামান আল-হুসায়নি আল-খুরাসানি বা মৌলানা বদিউজ্জামান ঠাঁইনাড়া স্বভাবের লোক বলেই তাকে শুরুতেই দেখা যায় কুতুবপুর ছেড়ে চলে যাওয়ার ঘোষণা দিতে। কিন্তু যাওয়ার আগে গ্রামবাসীর কাছে এই ফরাজি আন্দোলনের কট্টর সৈনিক প্রায় ওয়াদা আদায়ের ভঙ্গিতে দাবি করেন—“নজর রাখবেন, যেন আউরত লোকেরা বেপর্দা না হন। গানবাজনা যেন না শোনা যায়। মোহররমে আর যেন তাজিয়া জুলুস গ্রামে না ঢোকে। কেউ যেন পিরের থানে মানত দিতে না যায়। কেউ নমাজ কামাই করলে জরিমানা করবেন। দোসরা বার করলে সাত হাত নাক খবদা সাজা দেবেন। তেসরা বার করলে পঁচিশ কোড়া মারবেন। আর তারপর করলে গ্রাম থেকে নিকালে দেবেন শয়তানকে।

“হুজুর নিজেও জানতেন, তিনি চলে যাওয়ার পরে এসব কেউ কেউ অক্ষরে অক্ষরে পালন করবে না। তাতে দলাদলি আর হাঙ্গামার আশঙ্কা। মেয়েরা আবার বেপরদা হয়ে মাঠে মরদ-ব্যাটাদের নাশতা দিতে যাবে। শাদি লাগলে ঢোল বাজিয়ে গীত গাইবে। নাচবে এবং সং দেবে। পাশের গাঁয়ের হানাফি মজহাবের জোয়ানরা মোহররমের মিছিল এনে খবর পাঠাবে গ্রামে ঢুকবে কিনা এবং অনুমতিও পাবে। প্রধান ফরাজিরা দেখে না দেখার বা শুনেও না শোনার ভান করে আড়ালে গিয়ে বসবে।

তবু বদু মৌলানা চলে যান। স্থান পরিবর্তন করেন এক অন্তর্গত তাগিদে।”

আমাদের সিরাজ মাস্টার, সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজও আলকাপের আসরে বসে থাকতে থাকতেই মনের ভেতর ডাক শুনতে পান কলকাতার—যেতে হবে যেতে হবে।

আগেও অবশ্য একবার চলে গিয়েছিলেন কলকাতায়। সেই ১৯৫০ সালে কলেজ থেকে নিরুদ্দেশ হয়ে। কবি হবেন বলে। তারপর সে এক অমানুষিক লাঞ্ছনার অভিজ্ঞতা। কবিতার ফাইল নিয়ে প্রকাশকদের দরজায় দরজায় ঘুরেছেন। কলকাতা হা হা করে হেসেছে এক নির্বোধ গ্রাম্য তরুণের কাণ্ড দেখে। তাঁর নিজের ভাষায়—‘পশ্চাদ্দেশে লাথি খেয়ে বাড়ি ফিরলাম।’

এবার প্রকৃতি তাঁর হাতে তুলে দিলেন বাঁশের বাঁশি। সেই বাঁশিই তাকে লোকনাট্যের দল আলকাপ-এ নিয়ে যায়। “ছ-সাত বছর সে এক আশ্চর্য জীবন। সৌন্দর্য ও পাপ, অমৃত ও বিষ নির্দ্বিধায় পান করতে থাকলাম নীলকণ্ঠ শিবের দুঃসাহসে।”

“১৯৫০ সালে শেষ দিকে একটা বাঁশের বাঁশি ফিরিয়ে নিয়ে গেল গ্রামীণ মিথের সুপরিচিত জগতে। কাটতে লাগল দিনরাত্রি গাঁয়েগঞ্জে হাটে বাজারে মেলায় মেলায়। অজস্র মানুষ দেখলাম—বিচিত্র বিস্ময়কর সব চরিত্র। মুর্শিদাবাদ, মালদা, বীরভূম, সাঁওতাল পরগণা, দুমকা ঘুরে বেড়াই আলকাপ দলে। আড়াই হাজার রাত—ষাট হাজার ঘণ্টা কেটে যায় সৌন্দর্য ও যন্ত্রণার মধ্যে। মেয়েদের হৃদয় ও মুখমণ্ডলবিশিষ্ট তরুণ পুরুষের শরীরে কিংবদন্তীর গ্রামপরিরা কীভাবে অনুপ্রবেশ করে, দেখেছি। আলকাপ দলের নাচিয়ে ‘ছোকরার’ প্রেমে পড়েছি। অচরিতার্থ কামনায় জ্বলে মরেছি। ঝাকড়ামাকড়া হুল নাড়া দিয়ে দোহারকিরা আগুনের হল্কার মতো লোকগাথার বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। হাজার গ্রামীণ অভাজন মানুষের ভিড়ে সামিয়ানার তলায় ধ্বনি উঠেছে:

জয় জয় মা বাকবাদিনী কী জয়

জয় জয় ওস্তাদ তানসেন কী জয়

জয় জয় ওস্তাদ সিরাজ কী জয়!”

 

লোকে থার্ড থিয়েটার দেখে মোহিত হয়ে ভাবে এ এক আশ্চর্য নতুন আঙ্গিকের নাটক। কিন্তু আলকাপ আবহমান বাংলায় একই আঙ্গিকটিকেই বহন করে আসছে শত শত বছর ধরে। সেই সময় আলকাপের কিংবদন্তি ছিলেন ওস্তাদ ঝাঁকসা। আসল নাম ধনঞ্জয় সরকার। তাঁর বাড়ি ছিল জঙ্গীপুর শহরের ভাগীরথী তীরের ছোট্ট চাঁইপল্লী ধনপতনগরে। বিহার থেকে আসা নিম্নবর্ণ সমাজের দিয়াড়ি হিন্দুস্তানি ওস্তাদ ঝাঁকসার মাতৃভাষা ছিল খোট্টাই চাইবেলি। কিন্তু এমনই বাংলা জানতেন যে সেই সময় পদ্মা-গঙ্গা-দ্বারকা-অজয়-ময়ূরাক্ষীর বিস্তীর্ণ অববাহিকায় আলকাপ-শিল্পী হিসাবে তাঁর ছিল একচ্ছত্র আধিপত্য। তাঁকে বলা হতো ‘আলকাপের রাজা’। ভদ্রলোকেরা নাক সিঁটকাতেন যে আলকাপের কথা শুনে, সেই আলকাপকে সম্মানের আসনে তুলে এনেছিলেন ওস্তাদ ঝাঁকসা। তাঁরই দুর্মর উদ্যম এবং লড়াইয়ের ফলেই ছেঁড়া চাটাই, হারিকেন বাতির বদলে আলকাপের আসরে জুটেছিল বিশাল সামিয়ানা, হ্যাজাক, ডেলাইট, বিজলিবাতি, শতরঞ্চি। লম্বা-চওড়া মস্ত মানুষ ছিলেন ধনঞ্জয় সরকার। একটু ঝুঁকে আসরে দাঁড়াতেন। ঘোষণা করতেন—আলকাপ হচ্ছে লোকনাট্য। লোকশিক্ষার বাহন। মায়াদর্পণ। দর্পণ মানে আয়না। আপনারা আপনাদের মুখ দেখুন মায়াদর্পণে।

সত্যিকারে শিল্পী ছিলেন ওস্তাদ ঝাঁকসা। শিল্পীর অনুভূতি, যা তার প্রধান সম্পদ, সেই সম্পদে পরিপূর্ণ ধনী ছিলেন তিনি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজকে তিনি বলেছিলেন—‘মায়া নামে একটা জিনিস আছে মাস্টারজি। তার কথা বলি শুনুন। কাল রাতে আসর দেখেছেন, চোদ্দোটি বাতি ঝুলিয়ে দিয়েছিল। গুনে দেখেছি। মানুষ জুটেছিল হাজার পাঁচের কম নয়। এ ছিল বড় আসর। এই আসরে জিনিসটা ছিল—মায়া। তারপর তো দেখলেন, আসর ভাঙল, সবাই চলে গেল। বাতি নিবল। সামিয়ানা খুলে নিল ওরা। ছোকরা নাচিয়ে সাজ খুলল। কিন্তু কী অবাক কাণ্ড দেখুন। মনের ভিতর তো আসর ভাঙল না। সামিয়ানা টাঙানো রইল। চোদ্দোটা বাতি জ্বলতে লাগল। মোহিনী নটীর নাচ থামল না।... রেলগাড়ি তো চেপেছেন মাস্টারজি। নামবার পরও গা থেকে বেগ যায় না। মনে হয় ইহজীবনে নামা হলো না আমার। তেমনি ওই এক মায়া রেলগাড়ির বেগ নিয়ে বেঁচে আছি আমরা—আলকাপেরা।’

আলকাপের ‘ছোকরা’ যে নারী সাজে, সে যে কী মোহিনী হয়ে উঠতে পারে, সে তো আগেই জানিয়েছেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ। আলকাপের ‘ছোকরা’ও এক ‘মায়া’। তারা মায়ার আবেশে আসরকে আচ্ছন্ন করে রাখে। ‘ছোকরা’দের ‘ছোকরা’ হিসাবে তৈরি করা হয় খুব মনোযোগের সাথে। ওস্তাদরা বেছে নেয় বারো-তেরো বছরের কিশোরকে। হাতে পরিয়ে দেওয়া হয় কাচের চুরি। নিয়মিত চোখে কাজল, কপালে টিপ। পোশাক মেয়েদের মতো ফ্রক, দোপাট্টা, চুড়িদার ও শাড়ি পরতে পরতে তারা নিজেদের অজান্তেই নারী হয়ে ওঠে মনে মনে। তাদের নিয়মিত তালিম দিয়ে চলনে-বলনে-হাতনাড়া-নারী চাহনির কটাক্ষ-অঙ্গভঙ্গির সুরেলা ছন্দ এনে দেন। একটা ছোকরা বারো থেকে কুড়ি বছর বয়স পর্যন্ত আলকাপে অভিনয় করতে পারে। তারপর সে যথারীতি পুরুষ হয়ে যায়। ঝাঁকসা ওস্তাদের কথায়—“এ যেন খড়-মাটি দিয়ে প্রতিমা গড়ে, রঙ মাখিয়ে চোখ এঁকে সাজ পরিয়ে পুজো। মনের ভেতরে রয়েছে এক মোহিনী নটী। তাকে পুরুষের শরীরে নারীর রূপ দিই। মাটি নরম না হলে যেমন প্রতিমা গড়া যায় না। যে বয়সে দেহ কোমল থাকে, সেই বয়সে না হলে চলে না।”

সেই আলকাপের সঙ্গে থাকলেন সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ আড়াই হাজার দিন এবং রাত্রি।

তারপরেই মনের ভেতর কথা বলে উঠল আরেক শিল্পীসত্তা—হেথা নয়, অন্য কোথাও! দূরে কোথাও! বড় কোথাও!—‘আসরে বসে থাকতে থাকতে হঠাৎ মনে হত, সময় চলে যাচ্ছে যে!  অন্যমনস্কভাবে উঠে আসতাম। নিশুতি রাতের মোহাবিষ্ট আসর। সারা মেলা স্তব্ধ। শুধু সার্কাসের তাঁবুতে চাপা ড্রাম বাজছে। হঠাৎ গর্জন করে উঠছে বাঘ। বিষণ্ণ হয়ে ভাবতাম, কবে ফিরব এই প্রাগৈতিহাসিক অরণ্য ছেড়ে সভ্যতার দালান বাড়িতে? একদিন একটা চায়ের দোকানে কতকাল পরে খবরের কাগজ দেখলাম।... আর ততদিনে কথা জমেছে। লক্ষ কোটি কথা। মানুষ জীবন ইতিহাস ও প্রকৃতি নিয়ে কথা। সময় নিয়ে কথা। জীবনের প্রায় সব স্তর তো ঘোরা হল। এবার সেই কথা ভনভন করে মগজে। অতএব পালাই।”

প্রকৃতি। সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের কাছে “প্রকৃতিই শাশ্বত এবং ঈশ্বর। প্রকৃতিই অনন্ত জ্ঞান ও চেতনা। প্রকৃতিই একাধারে কার্য এবং কারণ। সব ভূলুণ্ঠিত ইজ্জত, অধঃপতিত শরীর ও বিশাল কীর্তিসমূহ তিনিই তো অসীম করুণায় করতলে ঢাকেন। একদা আমার নগ্ন শরীর ঢাকতেও তাঁর স্নেহ ঘাস হয়ে ফুটে উঠবে। কত মহেঞ্জোদাড়োর বিষণ্ণ অবসান তিনি সবুজ বুক দিয়ে ঢেকে রাখেন।”

কত রকমের বিচারপদ্ধতি তৈরি হয়েছে সাহিত্য আর সাহিত্যিককে মাপামাপির জন্য! সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ কাঁচকলা দেখিয়েছেন সবগুলিকে। সব ধরনের বিতর্ক আর তুলাদণ্ডকে এককথায় নস্যাৎ করা যায়। “তা হল: লেখার এভোকেটিভ ক্ষমতা। এই ক্ষমতা যাঁর আছে, তিনি নগর গ্রাম হাট মাঠ নদী গাছ একাল-সেকাল আদিমতা-উগ্রতা— সবকিছু উজ্জ্বল প্রাণের আলোয় ঝলমলিয়ে দিতে পারেন। তখন উগ্র আঁতেলেকচুয়ালকেও হতভম্ব হয়ে দাড়ি চুলকোতে হয়। সব কাগুজে শিল্পতত্ত্ব মাঠে মারা পড়ে।”

সেই ক্ষমতার গুণেই সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ অসাধারণ।

Link copied!