ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী। অগ্নিযুগে ব্রিটিশ শাসকদের ভিত কাঁপিয়ে দেওয়া অকুতভয় এক বিপ্লবী। সবার কাছে যিনি ‘মহারাজ’ নামে পরিচিত। বিপ্লবী কর্মকাণ্ডের কারণে অগ্নিযুগে যে কয়েকজন ভারতবর্ষে পরিচিত হয়ে উঠেছিলেন, ব্রিটিশ শাসকদের ভয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন, মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তী তাঁদের অন্যতম। বিপ্লবী আন্দোলনের সংগঠক, রাজনৈতিক নেতা, শিক্ষাবিদ, সমাজসংস্কারক ইত্যাদি পরিচয়ে পরিচিত মহারাজের আরো একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিচয় রয়েছে, আর তা হলো তিনি একজন লেখক। তাঁর রচিত ‘জেলে ত্রিশ বছর ও পাক-ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রাম’ গ্রন্থটিই মানুষের মাঝে ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর লেখক পরিচয়কে প্রতিষ্ঠিত করেছে। প্রায় ৫৩ বছর আগে প্রকাশিত বইটি আজও চিন্তাশীল, রাজনীতি সচেতন মানুষের কাছে সমানভাবে সমাদৃত। বইটি সম্পর্কে ভারতের বিখ্যাত বাংলা দৈনিক ‘আনন্দবাজার পত্রিকা’য় ১৯৬৯ সালের ১৯ মে ছাপা হওয়া এক নিবন্ধে বলা হয়, “ভারতবর্ষের স্বাধীনতা সংগ্রামের পূর্ণাঙ্গ ও নিরপেক্ষ ইতিহাস কবে রচিত হবে জানি না, তবে সে ইতিহাস যদি কোন দিন রচিত হয়, তাহলে সে ইতিহাসের সংকলনের একখানি অতি মূল্যবান গ্রন্থ নিঃসন্দেহে তাঁর গ্রন্থনায় সাহায্য করবে। সে গ্রন্থটি হল ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর ‘জেলে ত্রিশ বছর’। এই নাতিদীর্ঘ ও বহু আদৃত গ্রন্থটি নিঃসন্দেহে ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল।” সেই মহৎ মানুষটির আজ চলে যাওয়ার দিন। ১৯৭০ সালের ৯ আগস্ট রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান তিনি।
মৃত্যুর কিছুদিন আগে ১৯৭০ সালের ২৪ জুন ভারত যান মহারাজ। তাঁকে ভারতে নেওয়ার জন্যে বহুদিনের প্রচষ্টো অবশেষে সফল হয়। চিকিৎসার উদ্দেশ্যে ভারত যেতে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীকে ভিসা দিতে সম্মত হয় পাকিস্তান সরকার। ভারত সরকারের পক্ষে স্বয়ং দেশটির প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী বিষয়টি তদারক করেন। শারীরিকভাবে বেশখানিকটা অসুস্থ মহারাজ ভারত যাচ্ছেন এমন সংবাদ শুনে কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁর ভক্তবৃন্দ। দলে দলে তারা মহারাজের কিশোরগঞ্জের কুলিয়ারচরের বাড়িতে সমবেত হতে থাকে। তখন তাদের এই বলে আশ্বস্ত করেন মহারাজ— “এই যাত্রা বহুদিনের নয়, অল্প কিছুদিন পরেই ফিরে আসবো আমি।”
তখন পাকিস্তানে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি চলছে। পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের কাছে যে নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ নির্বাচনের আগে হঠাৎই কেন দেশ ছাড়ছেন মহারাজ? জনমনে নানা প্রশ্ন। তবে কী নির্বাচনে অংশগ্রহণের চেয়েও আরও গুরুত্বপূর্ণ কিছু করতে যাচ্ছেন তিনি? অনেক কিছুই শোনা যায়। কিন্তু কোনো কিছুই স্পষ্ট নয় তাদের কাছে। তবে ভক্ত-অনুসারীদের দৃঢ় বিশ্বাস মহারাজ যাই করবেন, তাতেই পূর্ববাংলার মানুষের কল্যাণ নিহিত থাকবে। এতে কারো দ্বিমত নেই। নির্বাচনে শারীরিকভাবে অংশগ্রহণ করতে না পারলেও ভারত যাওয়ার প্রাক্কালে তাঁর অনুসারী, দেশবাসীকে নির্দেশনা দিয়ে যান মহারাজ। আসন্ন নির্বাচনকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উল্লেখ করে তিনি দেশবাসীকে সৎ ও দেশপ্রেমিক লোকদের নির্বাচিত করার আহ্বান জানিয়ে বিবৃতি দেন। ঢাকা থেকে প্রকাশিত কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় সেই বক্তব্য গুরুত্ব সহকারে ছাপা হয়।
যশোরের বনগাঁও সীমান্ত দিয়ে যেদিন মহারাজ ভারতে প্রবেশ করেন, সেদিন সীমান্তে উপস্থিত ভক্তবৃন্দ অশ্রুসজল নয়নে তাঁকে বিদায় জানান। ভারতে পৌঁছে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েন তিনি। নানা অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন, পুরনো বন্ধু, সহযোদ্ধা, আত্মীয়-স্বজনদের সাক্ষাৎ দিচ্ছেন, কথা বলছেন, সংর্বধনা নিচ্ছেন, সেই সাথে যোগ দিচ্ছেন রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন অনুষ্ঠানে। ব্যক্তিগতভাবে সাক্ষাৎ হয় ভারতের রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী ও সংসদ সদস্যদের সাথে। হয়ত তিনি বুঝতে পেরেছিলেন আর সময় নেই, তাই সব কিছু দ্রুততার সাথে চালিয়ে যান। দিল্লিতে তিনি চিকিৎসাধীন ছিলেন। ডাক্তরা তাঁকে বিশ্রাম নিতে বলেছিলেন। কিন্তু তিনি তাদের বারণ মানেননি। প্রায় ৪৭ দিনে ভারত সফরে তিনি একদিনও বিশ্রাম নেননি। প্রতিটি দিন পার করেছেন অত্যন্ত ব্যস্ততার সাথে।
ভারতের পার্লামেন্টেও ভাষণ দেন মহারাজ। এটি তাঁর জন্য বিশাল এক প্রাপ্তি। মৃত্যুর তিন দিন পূর্বে ১৯৭০ সালের ৬ আগস্ট দিল্লির পার্লামেন্টে সংবর্ধনা দেওয়া হয় তাঁকে। সেখানে তিনি বাংলায় আবেগঘন ভাষণ দেন।
বিপ্লবী মহারাজকে সবাই পছন্দ করতেন। এমনকি প্রতিদ্বন্দ্বী সংগঠনের নেতা কর্মীরা পর্যন্ত তাঁকে সমীহ করতেন। অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর দলের মধ্যে প্রকাশ্য-অপ্রকাশ্য মতবিরোধ ছিল। কিন্তু ব্যক্তি পর্যায়ে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীর সাথে কারো বিরোধ ছিল না। অসাধারণ এক ব্যক্তিত্বগুণে তিনি তা অর্জন করেছেন। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশ, নেতাজী সুভাষচন্দ্র বসুর মতো বিশ্ববরেণ্য নেতারা তাঁকে স্নেহ করতেন, ভালোবাসতেন। মহারাজকে শ্রদ্ধা করতেন বাংলার আরেক স্বাধীনতাকামী নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ভারত সফরে তিনি দেশটির শীর্ষ রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের সাথে পূর্ববাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষে সমর্থন দেওয়ার বিষয়ে আলোচনা করেন। একই সাথে তিনি বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বের প্রশংসা করেন।
৯ আগস্ট দিল্লিতে শ্রী সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের বাসভবনে মহারাজের সম্মানে এক সংবর্ধনা ও ভোজসভার আয়োজন করা হয়। সেখানে উপস্থিত ছিলেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী, সিপিআই নেতা ভূপেশ গুপ্ত, শ্রী ত্রিদিব চৌধুরী, ডা. ত্রিপুরা সেন, কে কে শাহ্, শ্রী উমাশংকর দিক্ষিত ও নব কংগ্রেসের সংসদীয় দলে ডেপুটি লিডার আকবর আলী খান। মহারাজ তাঁদের সাথে ভারত-পাকিস্তান, বিশেষত পূর্ব-পাকিস্তান নিয়ে বিশদ আলোচনা করেন। স্মৃতিচারণও করেন তিনি। ভোজসভায় শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী মহারাজকে নিজ হাতে তাঁর মুখে খাবার তুলে দেন। রাত সাড়ে দশটায় ভোজসভার সমাপ্তি ঘটে। মহারাজ বাইরে গিয়ে অতিথিদের বিদায় জানান। তারপর বিছানায় ঘুমাতে যান। এদিন রাতে মহারাজ তাঁর আত্মজীবনী প্রকাশের বিষয়ে একটি প্রকাশনীর সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন। মৃত্যুর আগে এটিই ছিল তাঁর শেষ কাজ।
এরপর তিনি ঘুমাতে যান। রাত তিনটার দিকে তিনি জেগে উঠেন। এসময় তাঁর পাশে থাকা নাতিকে (ভ্রাতুস্পুত্রের সম্পর্কে আত্মীয়) আলো জ্বালাতে বলেন। তারপর তিনি বাথরুমে যান। এবং কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আবার শুয়ে পড়েন। এর একটু পর নাতি সমর চক্রবর্তী মহারাজের গলার গড়গড় আওয়াজ শুনতে পেয়ে চিৎকার করে সবাইকে ডাকতে থাকেন। বাড়ির কর্তা সুরেন্দ্রমোহন ঘোষসহ অন্যরা এসে দেখেন মহারাজ অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন। সঙ্গে সঙ্গে উইলিংডন হাসপাতালে খবর দেওয়া হলে দুইজন চিকিৎসক এসে উপস্থিত হন। কিন্তু মহারাজকে আর বাঁচানো যায়নি। ভারতের স্বাধীনতা দিবসের প্রাক্কালে ৯ আগস্ট রাতে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান মহারাজ। তাঁর প্রয়াণের সংবাদ পেয়ে সুরেন্দ্রমোহন ঘোষের বাসভবনে মহারাজকে শেষ শ্রদ্ধা জানাতে ছুটে আসেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী। এসময় অনেক সংসদ সদস্য, রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ সেখানে উপস্থিত হয়ে মহারাজের মৃতদেহে পুস্পমাল্য অর্পণ করেন।
ভারতে যাওয়ার আগে ভক্তদের কথা দিয়েছিলেন, আবার ফিরে আসবেন। মরে গিয়েও কথা রাখলেন মহারাজ। জীবিত আসতে না পারলেও ফিরে আসেন তিনি। মাতৃভূমিকে ভীষণ ভালোবাসতেন মহারাজ। প্রাণ বাজি রেখে লড়াই করে ব্রিটিশদের তাড়িয়েছেন। ক্ষমতা, উন্নত জীবন ও নানা সুযোগ-সুবিধা হাতছানি দিয়ে ডাকলেও স্থায়ীভাবে ভারতে থাকেননি। ফিরে এসেছেন পূর্ববাংলার নিজ ভূমিতে। আর সেখানেই তিনি কখনো ফিরবেন না, তা কেমন করে সম্ভব! মহারাজের লাখো ভক্তের দাবি ছিল, মৃতদেহ দেশে আনা হোক। একবার তারা দেখতে চায় প্রিয় মহারাজের মুখটি। কিন্তু সে সুযোগ আর হয়নি। তবে তাঁর চিতাভস্ম আসে মাতৃভূমিতে।
১৯৭২ সালের ১৩ এপ্রিল, ভারত থেকে মহারাজের শতাধিক অনুসারী তাঁর চিতাভস্ম নিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে আসেন। সিদ্ধান্ত হয় ঢাকার বুড়িগঙ্গা নদীতে চিতাভস্ম বিসর্জন দেওয়া হবে। কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করতে বাংলাদেশের বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. কুদরত-ই-খোদার সভাপতিত্বে মহারাজ ত্রৈলোক্যনাথ স্মৃতি কমিটির উদ্যোগে একটি প্রস্তুতি সভাও করা হয়। সভায় মহারাজের চিতাভস্ম যথাযোগ্য মর্যাদা সহকারে বিসর্জন দেওয়ার দিনটিকে বিশেষভাবে উদযাপনের জন্য বেশ কিছু কর্মসূচিও নেওয়া হয়। পরে ১৪ এপ্রিল, শুক্রবার মহারাজের চিতাভস্ম যথাযোগ্য মর্যাদা-সহকারে ঢাকার বুড়িগঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়। চিতাভস্ম বিসর্জন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেন বাংলাদেশ সরকারের তৎকালীন অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ, খাদ্যমন্ত্রী ফণিভূষণ মজুমদার, ভূমি রাজস্ব বিভাগীয় মন্ত্রী আবদুর রব সেরনিয়াবত, অধ্যাপক পুলিন দে, দীনেশ চন্দ্র চক্রবর্তী প্রমুখ। হাজার হাজার মানুষ সেদিন বুড়িগঙ্গার তীরে উপস্থিত হয়েছিলেন, তাঁদের প্রিয় মহারাজকে হৃদয়ের গভীর থেকে আন্তরিক শ্রদ্ধা জানিয়ে চিরদিনের মতো বিদায় জানাতে।