অসম্ভব দুরন্ত এক কিশোর-রিদয়। দুষ্টুমির অন্ত নেই। কী সে করে না!
একদিন জাল দিয়ে ইঁদুর ধরতে গিয়েছিল রিদয়। আর অঘটনটা ঘটল তখনই। অভিশাপ দিলেন গণেশ—‘এতবড় আস্পর্ধা!—ব্রাহ্মণ আমি, আমার গায়ে চিংড়িমাছের জাল ছোঁয়ানো! যেমন ছোটলোক তুই, তেমনি ছোট বুড়ো-আংলা যক হয়ে থাক!’
আর কী অবাক! গণেশের অভিশাপে কী যে হয়ে গেল রিদয়ের? ‘একটা আরশোলা শুঁড় উঁচিয়ে তাকে তেড়ে এল। রিদয় ভাবছে তখনো সে বড়ই আছে; যেমন আরশোলাকে মারতে যাবে, অমনি সেটা উড়ে এসে এক ডানার ঝাপটায় তাকে উল্টে ফেলে বললে—ফের চালাকি করবি তো কামড়ে দেব! এখন তুই ছোট হয়ে গেছিস মনে নেই? আগের মতো আর বাহাদুরি চলবে না বলছি!’
এই টুকুন হয়ে গেল রিদয়। এখন উপায়?
উপায়টাও বাৎলে দিল দানো ইঁদুর। ‘গণেশ ঠাকুরের দয়া না হলে আর মানুষ হওয়া হচ্ছে না।’
ব্যস। অমনি নিজের অপকর্মের ফিরিস্তি আওড়ে যেতে লাগল রিদয়, ‘গণেশ গেলেন কোথা? তাঁর দেখা পেলে যে আমি পায়ে ধরে মাপ চাই। এবার যদি তিনি আমায় মানুষ করে দেন, তবে নিশ্চয় বলছি কোনো দিন সন্দেশ চুরি করে খাব না, খেয়ে আর মিছে কথা বলব না, পড়বার সময় আর মিছিমিছি মাথা ধরবে না, তেষ্টাও পাবে না; গুরুমশায়কে দেখে আর হাসব না, বাপ-মায়ের কথা শুনব; রোজ তোমার চন্নামেত্তো খাব, একশো দুর্গানাম লিখব। এবার থেকে বামুনের দোকানে পাউরুটি আর হাঁসের ডিম ছাড়া অন্য কিছু ছুঁই তো গঙ্গাস্নান করব।’
রিদয় নিজেই বেরিয়ে পড়ল গণেশের খোঁজে। গণেশের অভিশাপ থেকে মুক্ত হওয়া লাগবে যে! নইলে বুড়ো আংলা হয়েই থাকবে হবে সারাটাজীবন।
গণেশের খোঁজে রিদয়কে দিয়ে বিশাল এক অ্যাডভেঞ্চার করিয়ে ছাড়লেন লেখক। বইয়ের নাম বুড়ো আংলা। বাংলা শিশুকিশোর সাহিত্যের কালজয়ী বই-বুড়ো আংলা। এই বুড়ো আংলার নায়কই রিদয়। লেখকের নাম অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
জন্ম ১৮৭১ সালের ৭ আগস্ট জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে। সম্পর্কের দিক দিয়ে তিনি ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভ্রাতুষ্পুত্র। জন্মের পর বাড়ির রীতি অনুসারে এক দাসীর কাছেই বড় হতে লাগলেন। পদ্মদাসী। দুরন্ত অবনকে নিয়ে প্রায়ই বেকায়দায় পড়তেন পদ্মদাসী। বড় হওয়ার পর অবন গিয়ে পড়লেন রামলাল চাকরের জিম্মায়। রামলাল ছিলেন কঠোর ধরনের মানুষ। এবার আর দুষ্টুমিতে তেমন সুবিধা করতে পারলেন না অবন। তবু সুযোগ পেলে করতেও ছাড়তেন না। বাড়ির অ্যাকুরিয়মে ছিল রঙিন মাছ। কিন্তু রঙিন মাছের জন্য চাই রঙিন পানি। রঙিন করার জন্য পানিতে রঙ ছেড়ে দিলেন অবনীনন্দ্রাথ। ফলাফল, শখের রঙিন মাছগুলো মরে ভেসে উঠতে শুরু করল।
১৮৭৬ সালে নর্মাল স্কুলে শুরু হয় তাঁর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। তাঁর দুষ্টুমির খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ল স্কুলেও। ওই স্কুলে লক্ষ্মীনাথ পণ্ডিত নামে প্রচণ্ড রাগী এক ইংরেজির শিক্ষক ছিলেন। একবার ক্লাসে পড়াতে গিয়ে তিনি একটি খাবারের নাম বললেন ‘পাডিং’। কিন্তু বেঁকে বসলেন অবনীন্দ্রনাথ। বললেন, ওটা পুডিং। ধমকে ওঠলেন শিক্ষক, ‘বল পাডিং!’ ধমকেও কাজ হলো না। অবনী ওটাকে পুডিং ছাড়া অন্য কিছু বলতে নারাজ। শিক্ষকও নাছোড়বান্দা। শাস্তি হিসেবে ছুটির পরে এক ঘণ্টা আটকে রাখা হলো অবনকে। ‘পুডিং’ তবু ‘পাডিং’ হলো না। এরপর টানাপাখার দড়িতে হাত বেঁধে পিঠে চলল বেতের বাড়ি। তেজী অবনীন্দ্রনাথ তবু পুডিংকে পাডিং বললেন না।
এমন নির্মম শাস্তির কথা বাবা গুণেন্দ্রনাথ শুনেছিলেন। এরপর থেকে অবনকে স্কুলে যেতে বারণ করেছিলেন। বাড়িতেই শুরু হলো তাঁর লেখাপড়া।
আর বাড়িতে থাকতে থাকতেই শুরু হলো তাঁর ছবি আঁকার চর্চা। প্রথমে দেয়ালে টানানো দেবদেবীর ছবি, এরপর যে কোনো ছবি দেখে কপি করতে শুরু করলেন অবনীন্দ্রনাথ। নয়-দশ বছর বয়সে এক বাগানবাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলেন পরিবারের সবাই মিলে। জায়গাটা ছিল কলকাতা থেকে পনেরো মাইল দূরত্বে গঙ্গার তীরে। সারি সারি ফুল-ফলের গাছ। বাগানে ঘুরে বেড়াত হরিণ, ময়ূর, বক। ঘরগুলোও কারুকার্যখচিত আসবাবে সাজানো। এসব দেখে ছবি আঁকার ঝোঁক উঠল অবনের। কাগজ-কলম-তুলি-পেন্সিল নিয়ে বসে পড়লেন।
পরিবারের অনেকেরই আঁকার ঝোঁক ছিল। সেটা প্রবাহিত হলো কিশোর অবনের রক্তে। তবে প্রথাগত ছবি আঁকতে শুরু করলেন পঁচিশ-ছাব্বিশ বছর বয়সে। গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল গিলার্ডির বাড়িতে তাঁর জন্য ছবি আঁকা শেখার ব্যবস্থা করা হলো। বিখ্যাত ইংরেজ আর্টিস্ট সিএল পামারের কাছে শিখলেন জলরং ও তেলরঙের কাজ। সবই ইউরোপীয় ধাঁচে। মন ভরল না তাঁর। প্রপিতামহ দ্বারকানাথ ঠাকুরের ছিল গ্রন্থশালা। সেখানে খোঁজ করতেই হাতে পেলেন মুঘল যুগের প্রাচীন চিত্রের পুঁথি। ভগ্নিপতি শেষেন্দুর কাছ থেকে উপহার পেলেন এক পার্সি ছবির বই। ওদিকে ছোটদাদা নগেন্দ্রনাথের বন্ধু মিসেস মার্টিনডেল পাঠিয়েছিলেন নকশাকরা কবিতার বই। অবনীন্দ্রনাথের চোখের সামনে নতুন জগৎ খুলে গেল। শুধু কি তাই! রাজেন্দ্র-মল্লিকের বাড়িতে ফ্রেমের কাজ করত এক মিস্ত্রি। নাম তার পবন। সেই পবনের কাছ থেকে শিখে নিলেন কিছু টেকনিক। আর এভাবেই তাঁর হাতে ভারতীয় চিত্রকলা নতুন রূপ পেল। তাঁর উদ্যোগে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান সোসাইটি অব অরিয়েন্টাল আর্ট। লন্ডন, প্যারিস ও জাপানে তাঁর চিত্রকর্মের প্রদর্শনীও হয়। এর মধ্যে ১৯০৫ সালে গর্ভনমেন্ট আর্ট স্কুলের ভাইস প্রিন্সিপাল হিসেবে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯০৬ সালে হন এর অধ্যক্ষ। ১৯১৫ সালে আর্ট স্কুলের অধ্যক্ষ পদ ছেড়ে দিয়ে সোসাইটির কাজে পুরোপুরি আত্মনিয়োগ করেন। তবে অনেক আমন্ত্রণ পাওয়ার পরেও কখনো দেশের বাইরে যাননি অবনীন্দ্রনাথ।
তাঁর ছিল অসাধারণ কল্পনাশক্তি। সে কল্পনাশক্তিকে তিনি শিল্পে রূপ দিতে পারতেন। একবার আমগাছের একটি মোটা ডাল ভেঙে পড়ল মাটিতে। অবনীন্দ্রনাথ দেখলেন সেটা দেখতে বড়সড় একটা পাখির মতো। কুড়িয়ে নিয়ে অন্য ডাল দিয়ে বানালেন একটা স্ট্যান্ড। এক কোণে মোটা ডাল বসিয়ে দিলেন। পিছনে ফিরে রইল সেটি। দূর থেকে দেখে মনে হলো, একটা চিল গাছের ডালে পিছনে ফিরে বসে আছে।
তবে অবনীন্দ্রনাথ সম্পর্কে একটা প্রচলিত কথা রয়েছে—তিনি ছবি লিখতেন আর গল্প আঁকতেন। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে তিনি ডাকতেন ‘রবিকা’ বলে। তাঁর গল্পের শক্তি সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ জানতেন। তাই একদিন রবীন্দ্রনাথ বললেন, ‘অবন, তুমি লেখো-না, —যেমন করে মুখে মুখে গল্প করে শোনাও, তেমনি করেই লেখো।’
তবু সাহস পেলেন না অবনীন্দ্রনাথ। ভরসা দিলেন রবিকাই, ‘তুমি লিখে যাও, আমি তো আছিই। ভাষার কোনো দোষ হলে তার ভার আমার ওপরেই না হয় ছেড়ে দিয়ো, শুধরে দেবো।
এবার উৎসাহের নদীতে বান ডাকল। লিখে ফেললেন শকুন্তলা। পড়তে দিলেন রবিকাকে। রবীন্দ্রনাথ সবটা পড়লেন। কাটাকুটি করলেন না। অবনীন্দ্রনাথের সাহস বেড়ে গেল। তারপর একে একে লিখে ফেললেন ক্ষীরের পুতুল, রাজকাহিনী, বুড়ো আংলা, ভূতপতরীর দেশে।
লিখলেন বাংলার ব্রত, কথিকা, আপন কথার মতো প্রবন্ধ। লেখালেখির জন্য সবসময় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের প্রতি কৃতজ্ঞ ছিলেন অবনীন্দ্রনাথ। সবসময় জানিয়ে এসেছেন, ‘গল্প লেখা আমার আসতো না। রবিকা-ই আমার গল্প লেখার বাতিকটা ধরিয়েছিলেন।’
আর সবচেয়ে মজার বিষয় হচ্ছে—অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন রবীন্দ্র-প্রভাব থেকে পুরো মুক্ত এক লেখক। তাঁর ছিল নিজস্ব ভাষা। বুড়ো আংলার রিদয়কে দিয়ে যেন অবনীন্দ্রনাথ নিজের প্রতিচ্ছবিই এঁকেছেন। গণেশ ঠাকুরের খোঁজে খোঁড়া হাঁসের পিঠে চড়ে বসল রিদয়। গন্তব্য তার কৈলাস। তবে হাঁস যাবে মানস সরোবর পর্যন্ত। তারপর তিব্বত। তার পরেই কৈলাস। ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়ল রিদয়। খোঁড়া হাঁসের গলা ধরে উড়ে চলেছে রিদয়। একে একে পেরিয়ে যাচ্ছে গ্রাম, শহর, নগর, বন্দর। চলন্ত পাখিরা খবর নিচ্ছে, জেনে নিচ্ছে কোন জায়গার উপর দিয়ে যাচ্ছে তারা।
‘কোন গ্রাম?’
‘তেঁতুলিয়া, সাবেক তেঁতুলিয়া—হাল তেঁতুলিয়া।’
‘কোন শহর?’
‘নোয়াখালি—খটখটে।’
.....
‘কোন বিল?’
‘চলন বিল—জল নেই।’
....
‘কোন ঝিল?’
‘হীরা ঝিল—তীরে জেলে।’
‘কোন পরগনা?’
‘পাতলে দ—পাতলা হ।’
‘কোন ডিহি?’
‘রাজসাই—খাসা ভাই।’
‘কোন পুর?’
‘পেসাদপুর—পিপড়ে কাঁদে।’
‘কার বাড়ি?’
‘ঠাকুর বাড়ি।’
‘কোন ঠাকুর?’
‘ওবিন ঠাকুর—ছবি লেখে।’
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর কিন্তু নিজেও জানতেন, ওবিন ঠাকুর ছবি লেখে। আর সেটা তাঁর ভঙ্গিতেই কথা দিয়ে এঁকে ফেললেন ‘বুড়ো আংলা’য়। এই না হলেন অবন ঠাকুর!