আল মাহমুদ আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রধান কবি। কবিতার শব্দ ব্যবহারের স্বতঃবেদ্য স্বাভাবিকতা এবং বিশ্বাসের অনুকূলতা নির্মাণে তিনি নিঃসংশয়ে আধুনিক বাংলা ভাষায় একজন অগ্রগামী কবি। প্রখ্যাত সমালোচক অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায় বলেন, সমকালীন যে দুজন বাঙালি কবির দুর্দান্ত মৌলিকতা এবং বহমানতা আমাকে বারবার আকৃষ্ট করেছে তাদের মধ্যে একজন হলেন বাংলাদেশের আল মাহমুদ, অন্যজন পশ্চিমবঙ্গের শক্তি চট্টোপাধ্যায়।
কবি আল মাহমুদ গ্রামে ফিরলেন এবং গ্রামের মেঠো পথ বেয়ে চলতে গিয়ে রচনা করলেন
এখন কোথায় যাওয়া যায়?
শহীদ এখন টেলিভিশনে। শামসুর রাহমান
সম্পাদকীয় হয়ে গেলেন। হাসানের বঙ্গজননীর নীলাম্বরী বোনা
আমার দ্বারা হবে না। জাফর ভাই ঘোড়ার গায়ে হাত বোলান ।
অতএব কবির কোথাও যাওয়া হলো না, কেননা :
আমার সমস্ত গন্তব্যে একটি তালা ঝুলছে।
(আমার সমস্ত গন্তব্যে )
আল মাহমুদ লোকজ অভিমুখে যাত্রা করে লোকায়ত বাংলার চিরায়ত শব্দ সুষমাকে আধুনিক বাক্য বন্ধনে উপস্থাপন করলেন। তার নির্মিত পটভূমির কেন্দ্রবিন্দু মানবতাই আত্মবিশ্বাস। জসীম উদ্দিন এবং জীবনানন্দ উভয়ের থেকে তিনি সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রকৃতির কবি। কারো প্রতিধ্বনি নয়, নির্মীয়মাণ স্বকীয়তাই তাকে আধুনিক জগতে বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী করেছে। ক্রমশ হয়ে উঠেছেন আস্থাশীল এক কাপ্তান। আল মাহমুদই আমাদের বিপুল জনসমষ্টির জীবনধারার অভিজ্ঞতাকে কবিতায় ব্যবহার করেছেন:
আমার বিষয় তাই, যা গরীব চাষির বিষয়
চাষীর বিষয় বৃষ্টি ফলবান মাটি আর
কালচে সবুজে ভরা খানা খন্দহীন
সীমাহীন মাঠ।
চাষীর বিষয় নারী।
উঠোনে ধানের কাছে নুয়ে থাকা
পূর্ণস্তনী ঘর্মাক্ত যুবতী।
(কবির বিষয় )
স্পন্দমান আবগের ভূগোল, দেশজ চেতনা, লেককাহিনী ও ঐতিহাসিক ঘটনাবলীর সৌন্দর্যে আপ্লুত আল মাহমুদ একজন মিথলজিক্যাল রোমান্টিক কবি। যেমন তিনি তার শ্রেষ্ঠ কর্ম ‘সোনালী কাবিন’ এ মাতৃভূমির ইতিহাস খনন করে তুলে এনেছেন ঐশ্বর্যময় ও বীর্যবান অনিষঙ্গসমুহ। তিনি এখানে শক্তিমত্তার সাথে রোমান্টিসজম প্রবেশ করিয়েছেন যা ‘সোনালী কাবিন’ সনেট গুচ্ছকে করেছে মহিমান্নিত ।
সোনার দিনার নেই, দেনমোহর চেয়ো না হরিণী
যদি নাও, দিতে পারি কাবিনহীন হাত দুটি
আত্মবিক্রয়ের স্বর্ণ কোনোকালে সঞ্চয় করিনি
আহত বিক্ষত করে চারদিকে চতুর ভ্রূকুটি ;
ছলনা জানি না বলে আর কোনো ব্যবসা শিখিনি।
‘সোনালী কাবিন’ সনেটগুচ্ছ কবি উপমা-রুপকের চর্চার কুশলতার যে নিদর্শন রেখেছেন, আমাদের কবিতার ক্ষেত্রে তা নতুন এবং আন্তরিক সততায় উজ্জ্বল। গ্রামের মাটি থেকে বিচিত্র আকুল আগ্রহকে কবি উন্মোচন করেছেন, নদীর চরের প্রতি কৃষানীর পতির অধিকার প্রতিষ্ঠার রূপকল্পে প্রমাণিত হয়েছে নারীর প্রতি পুরুষের আকাঙ্ক্ষার ক্ষুধার্ত নদীর উপমায় নর-নারীর কামনার চিত্র ফুটে উঠেছে। এইতো আমাদের আল মাহমুদ এবং তার গ্রামীণ প্রান্তরের উপঢৌকন যেখানে যৌনতার আন্তরিক অভিব্যক্তি ঘটেছে—
ক্ষুধার্ত নদীর মতো তীব্র দুটি জলের আওয়াজ
তুলে মিশে যাই চলো অকর্ষিত উপত্যকায়।
বাংলাদেশের কবিতার মেজাজ ও মন বুঝতে হলে আমাদের আল মাহমুদের কবিতার দরজায় কড়া নাড়তেই হবে।
কবিতা কি ?
কবিতা তো শৈশবের স্মৃতি
কবিতা চরের পাখী, কুড়ানো হাসের ডিম, গন্ধভরা ঘাস
স্নান মুখ বউটির দড়িছেড়া হারানো বাছুর
কবিতাতো মক্তবের মেয়ে চুলখোলা আয়েশা আক্তার।
(কবিতা এমন)
কবিতাসহ সাহিত্যের কোনো শাখায় নর-নারীর মিলনকে অস্বীকার করা যায় না। হুইটম্যানের কবিতায় ভাবের এক বে আব্রু প্রকাশ দেখে আমরা তাই আতঙ্কিত হলেও ক্ষুব্ধ হই না:
It is I, you women, I make my way
I am stern acrid, undissuble, but I have you
I do not hurt you any more than is necessary for you
I pour the stuff to starts sons and daughters fit for these states
I press with slow rude muscle
I brace myself effectually. I listen to no entreaties
I dare not with draw till deposit what has so long accumulated within me.
আমরা মুগ্ধ হই এই ভেবে যে মানব মনের একটি অদৃশ্য ও আদিমতম কামনার জোয়ারকে কবি বিন্দুমাত্র বাধা না দিয়ে তার প্রবাহকে আরও স্বচ্ছন্দ দিয়েছেন। আল মাহমুদও ‘সোনালী কাবিন’ কাব্যে শব্দ প্রতীক ও উপমার মাধ্যমে আদিমতাকে অপূর্ব চিত্রায়ন পূর্বক আদি ও অন্ত পর্যন্ত চিরন্তন রোমান্টিক ধারাকে প্রজ্জ্বল করেছেন:
তারপর তুলতে চাও কামের প্রসঙ্গ যদি নারী
খেতের আড়ালে এসে নগ্ন করো যৌবন জরদ
শস্যের সপক্ষে থেকে যতটুকু অনুরাগ পারি
তারও বেশী ঢেলে দেবো আন্তরিক রতির দরদ।
সনেট ১০ )
আল মাহমুদ যে মৌলিক ও নতুন কবি তা আগেই বলা হয়েছে। একজন কবির বড়ত্ব তার কাব্যভাষা, চিত্রকল্প এবং ছন্দের নতুনত্বে। আল মাহমুদের বড়ত্ব তার নিজস্ব বাক্রীতি প্রবর্তনে এবং অদ্ভুত সুন্দর চিত্রকল্প নির্মাণে। সৌন্দর্য বিভায় উদ্ভাসিত তার কবি হূদয় সর্বদা সুন্দরের পুজারি। তিনি তার কাব্যে বহু বিচিত্র বিষয়ের চিত্রকল্প নির্মাণ করেছেন।
আল মাহমুদের নারী অত্যন্ত চিত্তাকর্ষক, কামোদ্দীপক ও সৌন্দর্যময়। এক্ষেত্রে অধ্যাপক শিবনারায়ণ রায়ের মন্তব্যটি যথার্থ: ‘তিনি বোদলেয়ারের অনুরাগী। কিন্তু মাটি তার কাছে সেই নারী যে জলসিক্ত সুখদ লজ্জায় নিজেকে উদাম করে। তিনি শুনতে পান মেঘনার জলের কামড়ে ফসলের আদিগন্ত সবুজ চিৎকার। অভাবের অজগর তার টোটেম। যে কিসিমে শিষ্ট ঢেউয়ের পাল রাতের নদীতে ভাসা পানকৌড়ি পাখির ছতরে ছলছল ভাঙে সে কিসিমেই তিনি তার বানুর গতরে চুমো ঢালেন। (একজন খাঁটি কবি, উপমা , পৃ ২৫ )
নারী দেহের স্তনের বর্ণনা দিতে বিদ্যাপতি রাধিকার স্তনকে বলেছিলেন—হেম কমলন জনি অরুণিত চঞ্চল। সৈয়দ আলী আহসান সহসা সচকিত এর ৩১ নম্বর কবিতায় উল্লেখ করেন
কভু মনে হয় পদ্ম কোরক
দেহ তরঙ্গে বিকশিত
শিশির ঊষার সূর্যের তাপে
যেন আশঙ্কা বলসিত।
আল মাহমুদ নারী স্তনের সৌন্দর্য যেভাবে কল্পনা করেন
শঙ্খমাজা স্তনদুটি মনে হবে শ্বেতপদ্ম কলি
(সিম্ফোনি : লোক লোকান্তর)
তার দুটি মাংসের গোলাপ থেকে নুনের হাল্কা গন্ধ আমার
(চক্রবর্তী রাজার অট্টহাসি : মায়াবী পর্দা দুলে ওঠে)
...চোখ যেন
রাজা মহীপালের দিঘী। আর বুক দুটি
মিথুনরত কবুতর ।
(অস্পস্ট স্টেশন: আরব্যরজনীর রাজহাঁস )
ইস্পাহানের হলুদ আপেল বাগান আমার হাতে দুলে দিয়েছে
তার সুপক্ক দুটি সোনালি ফল।
তোমার ব্লাউজের বোতাম খোলো ...
(অভিযোজনা: আমি, দূরগামী)
আল মাহমুদ এখানে স্তনের সৌন্দর্য উপমার চিত্র কল্পনা করেছেন শঙ্খমাজা শ্বেতপদ্ম কলি, মাংসের গোলাপ, মিথুনরত কবুতর, সোনালি ফল ইত্যাদির সঙ্গে।
মধ্যযুগের বেশ কিছু কবি যোনীকে পুস্পের সঙ্গে তুলনা করেছেন। আধুনিক কবি সৈয়দ আলী আহসান যোনীকে দ্বিদল ফুলের সঙ্গে তুলনা করেছেন-
প্রাচীন কাব্যে উরু সংযোগ
যেনবা অমোঘ দ্বিদল ফুল
আল মাহমুদ রমনী দেহের যোনীকেও অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিভিন্ন উপমায় শোভিত করেছেন, যেমন
*আয়নায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে দেখো বুকের গঠন
লুকানো যায় না তবু অনিবার্য যৌবনের
ফুলপ্রতীকের মত যেন জেগে থাকে তোমার জঘন।
(অহোরাত্র: লোক লোকান্তর)
*সর্প বিতানের কোনো ফলবান বৃক্ষের শিকড়ে
খুলে দিয়ে দুটি উষ্ণ উরুর সোপান
ঢেকে আছে নগ্নযোনী গহরফলক (শিল্পের ফলক : লোক লোকান্তর)
আঘাত থেকে আসবে ছেলেগুলো
নাভীর নিচে উষ্ণ কালসাপ
(মাংসের গোলাপ : কালের কলস)
তোমার নাভীমূলে দেখেছি একা আমি
নরম গুল্মের কৃষ্ণ সানুদেশ ।
(শোনিতে সৌরভ : সোনালী কাবিন )
ত্রিকোণ আকারে যেন
ফাক হয়ে রয়েছে মৃন্ময়ী।
(প্রকৃতি, সোনালী কাবিন)
জলজ তূণের মতো ফের
জন্ম নেবে ধরত্রীর মুত্রভেজা যোনীর দেয়ালে ।
(ভারতবর্ষ, বখতিয়ারের ঘোড়া)
আল মাহমুদের ইসলামি কবিতা বাদে প্রায় সব কবিতায় নারী দেহের সৌন্দর্য, উপমা ও যৌনতা প্রকাশ পেয়েছে। তিনি নারী নিসর্গ প্রেম ভালোবাসায় কৃত্রিমতার বা রাখ ঢাকের খোলস নির্মাণ করেননি। তিনি মার্ক্সিস্ট থেকে ইসলামের বিশ্বাসী হয়েছেন। তারপরও তার কবিতায় আমরা দেখছি মাংসের গোলাপ, মিথুনরত কবুতর। কারণ তিনি প্রথমত কবি, শেষত ওই কবিই।
ষাটের মান্নান সৈয়দকে আমরা দেখেছি নারী নগ্নতার মধ্য দিয়ে পরাবাস্তবাতা ও আধ্যাত্মিকতার কথা বলতে। একই দশকের কবি নির্মলেন্দু গুণের কাম বিষয়ক কবিতার সমগ্রও আমরা হাতে পেয়েছি।
নর-নারীর যুথজীবন যাত্রায় নগ্নতা, রম্যতা, জীবন ঘনিষ্ঠতা অতি বাস্তব। এই বাস্তবতাকে উপমা-চিত্রকল্পে যথার্থ করা-শব্দের এবং চিত্রের অর্থ্ময়তা ও আনন্দময়তা যে কবি যতবেশি দান করতে পারেন নব নব শিল্প চিত্রনে সে তত বড় কবি।