• ঢাকা
  • শুক্রবার, ১১ অক্টোবর, ২০২৪, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১, ৭ রবিউস সানি ১৪৪৬

হাং কাংয়ের দুটি কবিতা


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: অক্টোবর ১০, ২০২৪, ১০:০২ পিএম
হাং কাংয়ের দুটি কবিতা
হাং কাং। ছবি : সংগৃহীত

দক্ষিণ কোরিয়ার এক লেখক-পিতার কন্যা ও লেখক ভ্রাতার বোন, তেপ্পান্ন বছর বয়সী হাং কাং (জন্ম ১৯৭০) এ বছর নোবেল পুরস্কার পেয়ে সমগ্র বিশ্বকে চমকে দিয়েছেন। যদিও পুরস্কারের স্বাদ তিনি এর আগেও একেবারে কম পাননি। ২০১৬ সালেই তিনি তার বিখ্যাত উপন্যাস দ্য ভেজিটারিয়ানের ইংরেজি অনুবাদের জন্য ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কারে ভূষিত হন। এ ছাড়া অল্প বয়সেই তিনি কোরিয়ার মর্যাদাবান দুটো পুরস্কার Yi Sang Literary Prize ও Korean Literature Novel Award লাভ করেন।

১৯৯৮ সালে হাং কাং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আইওয়া বিশ্ববিদ্যালয় আয়োজিত বহুল আলোচিত ইন্টারন্যাশনাল রাইটিং প্রোগ্রামেরও অন্যতম অংশগ্রহণকারী ছিলেন।

সাহিত্যের ছাত্রী হাং কাংয়ের লেখকজীবনের সূত্রপাত হয় ১৯৯৩ সালে পাঁচটি কবিতা প্রকাশের মধ্য দিয়ে। এর পরের বছরেই তিনি একটি ছোটগল্প প্রকাশের মধ্য দিয়ে কথাসাহিত্যের জগতে প্রবেশ করেন। এর বছর পাঁচেকের মধ্যেই তার প্রথম উপন্যাস ‘Black Deer’ প্রকাশিত হয়ে প্রভূত সুনাম কুড়ালে তিনি লেখালেখিকেই তার পূর্ণকালীন পেশা হিসেব গ্রহণ করতে মনস্থ করেন। সেটিই আরও পাকাপোক্ত হয় ২০০৯ সালে তার সুবিখ্যাত উপন্যাস ‘The Vegetarian’ সমগ্র কোরিয়াজুড়ে আলোড়ন তোলার পর। সেটিই যখন ২০১৬ সালে ‘Deborah Smith’ কর্তৃক ইংরেজিতে অনুদিত হয়ে পশ্চিমে প্রকাশিত হয়, তখন তা ইন্টারন্যাশনাল বুকার পুরস্কার লাভের মর্যাদা পায়। একই বছর দ্য নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকা তার এই বইটিকে ২০১৬ সালের সেরা দশটি বইটি একটি হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। এরপর থেকে হাং কাংকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। যার সর্বসাম্প্রতিক ও সর্বোচ্চ স্বীকৃতি আজকের এই নোবেল পুরস্কার।

আটটি উপন্যাস, পাঁচটি উপন্যাসিকার সংকলন, দুটি ছোটগল্প গ্রন্থ, দুটি প্রবন্ধগ্রন্থ ও একটি কাব্যগ্রন্থের রচয়িতা হাং কাংয়ের উল্লেখযোগ্য রচনাসমূহের মধ্যে রয়েছে : উপন্যাস Black Deer (১৯৯৮); Your Cold Hands (২০০২); Greek Time (২০১১); ছোটগল্প Thunder Little Fairy, Lightning Little Fairy (২০০৭);  প্রবন্ধ A Song to Sing Calmly (২০০৭); কাব্যগ্রন্থ  I Put Dinner in the Drawer (২০১৩)  ইত্যাদি। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ার সিউল শহরে বসবাস করেন।

নিকষ কালো আলোর বাড়ি

সেই যেদিন উই-ডংয়ে 
বরফ-বৃষ্টি হলো
সেদিন আমার শরীর, আত্মার সহচর
প্রতিটি পড়ন্ত অশ্রুবিন্দুর সঙ্গে কেঁপে কেঁপে উঠছিল।

যাও, এগিয়ে চলো।

তুমি কি দ্বিধান্বিত?
এভাবে ভাসন্ত তুমি কীসের স্বপ্ন দেখছ?

দোতলা বাড়িগুলো ফুলের মতো ফুটে আছে,
তার নিচেই আমি প্রথম যন্ত্রণাকে জানি
এবং তখন পর্যন্ত অস্পর্শিত এক আনন্দভূমির দিকে
বোকার মতো হাত বাড়িয়ে দিয়েছিলাম।

যাও এগিয়ে চলো।

কীসের স্বপ্ন দেখছ তুমি? হাঁটতে থাকো।

সড়কবাতিতে জমাট বাঁধা স্মৃতির দিকে, আমি হাঁটতে থাকি।
আমি বাতির দিকে মুখ তুলে চাই এবং তার ঢাকনার ভেতর
একটি নিকষ কালো বাড়ি দেখি।
নিকষ কালো আলোর বাড়ি।

আকাশ অন্ধকার ছিল এবং সেই অন্ধকারের ভেতর
অধিবাসী বিহঙ্গেরা তাদের দেহের ওজন 
ঝরিয়ে দিয়ে উড়ে চলে গেল।

এভাবে উড়ে যাবার জন্য কতবার আমাকে মরে যেতে হবে?
আমার হাত ধরতে পারেনি কেউই।

কোন স্বপ্নেরা এমন মধুর?
কোন স্মৃতিরা এমন উজ্জ্বল?

মায়ের আঙুলের অগ্রভাগের মতো
সেই বরফবৃষ্টির ছাঁট আমার এলোমেলো ভুরু আঁচড়ে দেয়
আমার জমে যাওয়া চিবুকে আঘাত করে
এবং পরক্ষণেই সেখানে আলতোভাবে ছোঁয়,

আর দেরি নয়, যাও, সামনে এগিয়ে চলো।

 

আয়নার ভেতর দিয়ে শীতকাল

১.
একটি শিখার চোখের মণির দিকে তাকাও।
নীলাভ
হৃদয়াকৃতি
চোখ
তাকে ঘিরে থাকা
যে উত্তপ্ত, উজ্জ্বলতম আগুন
গোলাপিরঙা অভ্যন্তর শিখা
যা সবচেয়ে বেশি গনগনে
যা আবার বেষ্টন করে থাকে
অর্ধস্বচ্ছ বাইরের শিখাটিকে
কালকের সকাল, যে সকালটিতে আমি
সবচেয়ে দূরের শহরটির উদ্দেশে যাত্রা করব
আর আজ  সকালে একটি শিখার নীলাভ চোখ
চেয়ে থাকে আমার চোখের মণি ছাড়িয়ে।

২.
আমার শহরে এখন বসন্তের সকাল, তুমি যদি পৃথিবীর ঠিক কেন্দ্র বরাবর এগোও, এবং ঠিক তার মাঝখান দিয়ে ফুঁড়ে বেরিয়ে যাও অকম্পিত পায়ে, তাহলে যে শহরটির দেখা পাবে, সেখানকার সময় আমার শহরের চেয়ে ঠিক বারো ঘণ্টা পিছিয়ে, আর তার ঋতু আমাদের চেয়ে পাক্কা ছমাস পেছানো, ফলত সেখানে এখন শরৎকালের সন্ধ্যা, যেনবা আমার শহরের পেছনের সেই শহরটিকে কেউ নীরবে অনুসরণ করছে, সেই রাত্রিকে অতিক্রম করে শীতকালে পৌঁছানোর জন্য আমিও নীরবে অপেক্ষা করি, যখন আমার শহর তাকে পেছনে ফেলে দেয়, যেভাবে একজন নীরবে অতিক্রম করে যায় তার সামনের জনকে।

৩.
অয়নার ভেতরে শীতকাল অপেক্ষমাণ
একটি শীতল স্থান
একটি নিদারুণ শীতল স্থান
ভীষণই শীতল
বস্তুরা কম্পনে অক্ষম
তোমার (একদা জমে যাওয়া) মুখ
ভেঙে যেতেও পারে না
আমি হাত বাড়াই না
তুমিও
বাড়াতে চাও না তোমার হাত
একটি শীতল স্থান
যা সারাক্ষণ শীতল থাকে
ভীষণই শীতল
চোখের মণিরা কাঁপে না
চোখের পাঁপড়িরা জানে না বন্ধ হতে (একসঙ্গে)
আয়নার ভেতরে
শীতকাল অপেক্ষা করে এবং
আয়নার ভেতরে
আমি তোমার চোখজোড়াকে এড়াতে পারি না
এবং তুমিও চাও না তোমার হাত বাড়িয়ে দিতে

৪.
তারা বলেছিল আমরা গোটা একটি দিন উড়ব।
পরিপাটি ভাঁজ করা চব্বিশ ঘণ্টা তাকে তোমার মুখের মধ্যে পুরে দিয়ে
আয়নার মধ্যে প্রবেশ করবে তারা বলেছিল।
সেই শহরের একটি ঘরে মালপত্র গোছানোর পর 
আমি যেন সময় নিয়ে আমার মুখ ধুয়ে ফেলি।
শহরের পীড়ন যদি ধীরে গ্রাস করে ফেলে আমাকে
আমিও নীরবে পিছিয়ে পড়ব এবং
তুমি যখন তার দিকে তাকাবে না, আমি মুহূর্তের জন্য
আয়নার অস্বচ্ছ পিঠে হেলান দিয়ে 
নির্বিকার গুনগুনিয়ে গান করব।
যতক্ষণ পর্যন্ত না সেই পরিপাটি ভাঁজ করা চব্বিশ ঘণ্টাকে চেটে নিয়ে
তোমার উষ্ণ জিহবার ধাক্কায় অতঃপর থুতুর মতো ফেলে দিয়ে
তুমি ফিরে আসো এবং আমার দিকে চোখ মেলে চাও

৫.
আমার চোখজোড়া দুখানি মোমবাতি, সলতেকে দহন করে গলিত মোমের ফোঁটা ঝরায়, এতে কোনো যন্ত্রণা কিংবা দহনের বেদনা নেই, তারা বলে মোমের ভেতরকার নীলাভ শিখার কম্পন, আর কিছু নয় আত্মার আগমনি বার্তা, আত্মারা আসে, আমার চোখের ভেতরে বসে এবং কাঁপতে থাকে, তারা গান গায়, প্রান্তবর্তী শিখারা দুলতে থাকে দূরে, ক্রমে আরও দূরে চলে যেতে চেয়ে, আগামীকাল তুমি সবচেয়ে দূরবর্তী শহরের উদ্দেশে যাত্রা করবে, আর এখানে আমি আগুনে পুড়ছি, তুমি এখন শূন্যতার সমাধিতে হাত রাখ এবং অপেক্ষা কর, স্মৃতিরা সাপের মতো তোমার আঙুলে দংশন করে, তুমি দগ্ধ হও না, যন্ত্রণা পাও না, তোমার অনড় মুখখানি পোড়েও না, ভাঙেও না।

অনুবাদ ও ভূমিকা :  আলম খোরশেদ

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!