রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখেছেন, ‘আবার এসেছে আষাঢ় আকাশ ছেয়ে, আসে বৃষ্টির সুবাস বাতাস বেয়ে। এই পুরাতন হৃদয় আমার আজি, পুলকে দুলিয়া উঠিছে আবার বাজি।’ আষাঢের প্রথম দিন আজ শনিবার (১৫ জুন)। পুষ্প-বৃক্ষে, পত্রপল্লবে, নতুন প্রাণের সঞ্চার করে, নতুন সুরের বার্তা নিয়ে সবুজের সমারোহে এসেছে বর্ষা।
কালীদাস থেকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, জীবনানন্দ দাশ বা নির্মলেন্দু গুণ, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে হুমায়ূন আহমেদ- কেউই বর্ষাকে এড়িয়ে যেতে পারেননি। মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের পুতুল নাচের ইতিকথা, পদ্মা নদীর মাঝি, বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পথের পাঁচালী, জহির রায়হানের হাজার বছর ধরে, হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিনে বর্ষা এক বিপুল বিস্ময় নিয়ে আবির্ভূত।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার ‘বর্ষা-মঙ্গল’ কাব্যে লাবণ্যস্নিগ্ধ রূপবতী বর্ষাকালকে নিয়ে লিখেছেন, ‘ওগো সন্ন্যাসী, কী গান ঘনাল মনে।/গুরু গুরু গুরু নাচের ডমরু/বাজিল ক্ষণে ক্ষণে।/তোমার ললাটে জটিল জটার ভার/নেমে নেমে আজি পড়িছে বারম্বার/বাদল আঁধার মাতাল তোমার হিয়া,/বাঁকা বিদ্যুৎ চোখে উঠে চমকিয়া।’
বর্ষাকাল মানেই মেঘ, বৃষ্টি, প্রেম, নতুন প্রাণ, জেগে ওঠার গান। রূপসী বাংলার কবি জীবনানন্দ দাশ তাই তো বলেছেন, ‘এই জল ভালো লাগে;- বৃষ্টির রুপালি জল কত দিন এসে/ধুয়েছে আমার দেহ- বুলায়ে দিয়েছে চুল- চোখের উপরে/তার শান্ত স্নিগ্ধ হাত রেখে কত খেলিয়াছে,- আবেগের ভরে।’ বর্ষা আমাদের মনকে স্নিগ্ধ করে তোলে। পুরানো জঞ্জাল ধুয়ে-মুছে আমরাও জেগে উঠি প্রাণচাঞ্চল্যে।
বর্ষা, বাংলা সনের তৃতীয় মাস। এটি বর্ষা মৌসুমে অন্তর্ভুক্ত দুই মাসের প্রথম মাস। আর নামটি এসেছে পূর্বাষাঢ়া নক্ষত্রে সূর্যের অবস্থান থেকে। বর্ষায় গ্রীষ্মের ধুলোমলিন জীর্নতাকে ধুয়ে ফেলে গাঢ় সবুজের সমারোহে প্রকৃতি সাজে পূর্ণতায়। নদীতে উপচেপড়া জল, আকাশে থাকে ঘন মেঘের ঘনঘটা। গ্রীষ্মের দাবদাহে মানুষ যখন পুড়ে তখন বর্ষার ঝুম ঝুম বৃষ্টির বরণডালা প্রশান্তি এনে দেয় মানুষের মনে।
বর্ষার সতেজ বাতাসে জুঁই, কামিনি, বেলি, রজনীগন্ধা, দোলনচাঁপা আরও কত ফুলের সুবাস। লেবু পাতার বনেও যেন অন্য আয়োজন। উপচে পড়া পদ্মপুকুর রঙিন হয়ে ফোটে বর্ষাকে পাওয়ার জন্য। কেয়ার বনেও কেতকীর মাতামাতি।
অনেকেই মনে করেন, বর্ষা যেমন আনন্দের, তেমনি হঠাৎ বিষাদে ভরিয়ে তোলে জনপদ। তবু বর্ষা বাঙালি জীবনে নতুনের আবাহন। সবুজের সমারোহে, মাটিতে নতুন পলীর আস্তরণে আনে জীবনেরই বারতা। সুজলা, সুফলা, শস্য শ্যামলা বাঙলা মায়ের নবজন্ম এই বর্ষাতেই। সারা বছরের খাদ্য-শস্য-বীজের উন্মেষতো ঘটবে বর্ষার ফেলে যাওয়া অফুরন্ত সম্ভাবনার পলিমাটি থেকে।