আমাদের দেশের প্রকাশনাশিল্পের সিংহভাগই বইমেলাকেন্দ্রিক। এটা নিয়ে আপনার অভিমত কী?
রুহুল মাহফুজ জয়: আমার মনে হয় পাঠক না থাকা, সারা বছর বই বিপণনকারী প্রকাশনা সংস্থার স্বল্পতা এর প্রধান কারণ। প্রকাশনা শিল্প হিসেবে দাঁড়ায়নি। বেশির ভাগ প্রকাশক কেবল বই প্রকাশ করেন বইমেলাকে কেন্দ্র করে, সারা বছর ওনাদের তেমন কাজকর্ম থাকে না। অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত পাণ্ডুলিপি নেওয়া হয়—এমনকি জানুয়ারিতেও পাণ্ডুলিপি গ্রহণ করা হয়। এভাবে টেক্সট যাচাই-বাছাই করে ও সুসম্পাদনার মাধ্যমে বই করা সম্ভব না, এমনকি বেশির ভাগ প্রকাশনীর সম্পাদনা পর্ষদ নেই বলেই সন্দেহ করি আমি। এসবে বোঝা যায় আমাদের সৃজনশীল প্রকাশনায় পেশাদারত্বের মারাত্মক অভাব। প্রকাশকদের বিরাট অংশ শৌখিন লেখকদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে বই ছাপানোর শখ পূরণ করে দেন, ইদানীং তারা চর্চিত লেখক বাদ দিয়ে ফেসবুকে খুব জনপ্রিয় এমন লোকদের পেছনে ছুটছেন, তারা লিখতে জানুক আর না জানুক, তা ব্যাপার না! এই কারণে মেলায় হাজার হাজার বই প্রকাশ হয় আবার হারিয়েও যায়। মেলায় যা বিক্রি হয়, ওটা দিয়েই সেসব প্রকাশনা কোনোভাবে টিকে থাকে। আর মেলাকে ঘিরে একটা উৎসব চলে সারা মাস, মেলা থেকে সিরিয়াস পাঠকরাও অনেক বই কিনে ফেলেন, যা সারা বছর ধরে পড়েন। আর উৎসবের ছোঁয়া পেতে মেলায় ঘুরতে আসা মানুষেরা টেক্সট বিচার করে বই কেনে না, কারণ তারা পাঠক না। এই শ্রেণি সারা বছর বই হাতে নেন না, মেলা থেকে কেনা বইটিও হয়তো পড়েন না, আমার ধারণা সংখ্যায় ওনারাই বেশি। ভাবেন, ১৬-১৭ কোটি জনসংখ্যার একটা দেশে অন্তত ৪-৫ কোটি তথাকথিত শিক্ষিত লোক আছে, কিন্তু সাহিত্যের পাঠক সাকল্যে ১০ হাজারও হবে না। মেলায় একটা উপন্যাসের এক হাজার কপি, একটা কবিতার বইয়ের তিন শ কপি বেচা হলেই বিরাট সাফল্য হিসেবে দেখা হয়। কী রকম করুণ অবস্থা! সব মিলিয়ে সরল চিন্তায় বা দৃষ্টিতে পাঠক না থাকা, প্রকাশকদের পেশাদারত্বের অভাব আর মেলা ছাড়া দেশের লেখকদের বই খুব কম বেচা হয় বলেই আমাদের প্রকাশনাশিল্প বইমেলাকেন্দ্রিক হয়ে গেছে, যা সাহিত্যের জন্য শুভ নয়।
লেখকরা কেন বইমেলাকেন্দ্রিক বই বের করছেন—বেশি পাঠকের কাছে পৌঁছাতে, নাকি প্রকাশকরা অন্য সময় বের করতে চান না?
রুহুল মাহফুজ জয় : দুটোই মনে হয়। আসলে এটা আমাদের প্রকাশনার সংস্কৃতি হয়ে গেছে। মেলায় লেখক যান, পরিচিতরাও আসেন, এই মিথস্ক্রিয়ায় কিছু বই বিক্রি হয়। মেলার পরে বাকি ১১ মাস বেশির ভাগ লেখক-কবির বই-ই পাওয়া যায় না, ব্যতিক্রম কয়েকটা সংস্থা বাদে প্রকাশকরাও মেলার পরে নিদ্রায় চলে যান। আবার দেখবেন দেশের নামকরা বইয়ের দোকানে কলকাতার বইয়ের প্রাধান্য, দেশের অনেক গুরুত্বপূর্ণ লেখকের বই এসব দোকানে পাওয়া যায় না কিন্তু কলকাতার বই প্রচুর পাবেন। যে কারণে দেশের সিংহভাগ লেখকই বইমেলার জন্য অপেক্ষা করেন, প্রকাশকরা তো বটেই। এই দুষ্টচক্র ভাঙা দরকার।
বাংলা সাহিত্যের, বিশেষ করে বাংলাদেশের সাহিত্যচর্চার জন্য বইমেলা কি জরুরি?
রুহুল মাহফুজ জয় : সাহিত্যচর্চার জন্য বইমেলা জরুরি না। জরুরি সিরিয়াস পাঠক বাড়ানো। আমাদের দেশে গ্রামে গ্রামে যদি পাঠাগার থাকত, অভিভাবকরা ও স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যদি শিশু-কিশোরদের বই পড়ার জন্য উৎসাহ দিতেন তাহলে পাঠক তৈরি হতো, সারা বছরই বই বেচা হতো। আপনি সারা দেশের বইয়ের দোকানগুলো দেখবেন, সাহিত্যের বই বেচে না। কারণ তাতে ব্যবসা টেকে না, সাহিত্য পড়ার লোক নেই। যে কারণে শিক্ষা কারিকুলামের টেক্সট বই আর গাইড বিক্রি করে তাদের রুটি-রুজি চলে। বিশ্ববিদ্যালয় পাস করা বাবা-মায়েরা সন্তানকে কেএফসিতে নিয়ে চিকেন উইং খাইয়ে শরীরের মেদ বাড়ালেও বই কিনে দিয়ে মননশীল হওয়ার রাস্তা দেখায় না। বাজারে না আছে সাহিত্যিকের দাম, না সাহিত্যের বইয়ের। পাঠক তৈরি হলে বইয়ের দোকানগুলো আরও সাহিত্যের বই বেচত, মেলাকেন্দ্রিক বই প্রকাশ আর ব্যবসা থেকেও প্রকাশকরা বের হয়ে আসতে পারত। সাহিত্যচর্চার জন্য মেলা জরুরি না হলেও সৃজনশীল পুস্তক প্রকাশনা টিকে থাকার জন্য বইমেলা দরকারি এবং বাংলাদেশে প্রাসঙ্গিক। বিপণনেও প্রকাশকরা স্মার্ট না হওয়ায় বইমেলাই ভরসা!
এবারের মেলায় আপনার একটি বই ‘তোমার প্রেমের নামে’ বের হয়েছে। বইটি নিয়ে কিছু বলুন?
রুহুল মাহফুজ জয় : ‘তোমার প্রেমের নামে’ আমার প্রথম গদ্যের বই। মেটাফিকশন ধাঁচের, আবার মুক্তগদ্যও বলা যায়। অনেকখানি ফিকশন আবার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার বয়ানের মিশেলে এই বই। আমার গদ্যের স্টাইল কাব্যধর্মী, দীর্ঘ বাক্যের দিকে ধাবিত আবার একই সঙ্গে যোগাযোগপ্রবণ। ৯৬ পৃষ্ঠার বইয়ে ৯টি লেখা আছে। লেখাগুলোর জন্যে এপিস্টোলারি ফর্ম (চিঠি) বেছে নিয়েছি। চিঠিগুলোর ভেতরে বহু গল্প আছে, বহুমাত্রিক বিষয়ের বিস্তার লাভ করেছে সেসব লেখায়। নিজের প্রেমের সঙ্গে জীবনানন্দের প্রেম ও কবিতা, শিল্পী জুটি আমেদেও মোদিলিয়ানি ও জেন ইবুতেরনার অমর প্রেমকাহিনি, ফিকশন ও ব্যক্তিগত প্রেমের কথা মিলিয়ে আরেকটি লেখা, হুমায়ূন আহমেদকে নিয়ে আমার ব্যক্তিগত স্মৃতি ও ওনার লেখা গানগুলো নিয়ে আমার ভাবনা, একটা ফিকশনের ভেতরে আমার রেডিও জকি জীবনে শিল্পী আজম খান ও একজন বিরাট রকস্টারের সঙ্গে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, মৃত্যুচিন্তা ও রোমান্টিকতা, দিয়েগো মারাদোনাকে নিয়ে একটা দীর্ঘ ক্রিটিক্যাল লেখা (আমার ধারণা মারাদোনাকে নিয়ে আর কোনো বাঙালি লেখক এমন সবিস্তারে লেখেননি), ফুটবলের নন্দন ও জীবনে এর প্রভাব এবং সন্তানের প্রতি মাতৃপ্রেম ও মায়েদের ত্যাগ—এই হলো তোমার প্রেমের নামের লেখাগুলোর আউটলাইন। আমার ধারণা কেউ বইটা হাতে নিয়ে পড়া শুরু করলে শেষ না করে উঠবেন না। নিরীক্ষামূলক গদ্যের বই লিখেছি। বাকিটা পাঠকের হাতে। বইটার প্রকাশক বৈভব, মেলায় তাদের স্টল নম্বর ৬৪৩।
আপনি অনুবাদও করেছেন। আব্বাস কিয়ারোস্তামির কবিতা। এই কবিতাসমগ্র অনুবাদের পেছনে কী অনুপ্রেরণা ছিল?
রুহুল মাহফুজ জয় : অনুপ্রেরণা ছিল কবিতা, স্বয়ং আব্বাস কিয়ারোস্তামি ও মিনিমাল আর্টের প্রতি আমার প্রেম বা দুর্বলতা। আমি সিনেমামেকার কিয়ারোস্তামির বড় ভক্ত। কিয়ারোস্তামির কবিতা খুব খুব ছোট ছোট, কিন্তু ভাব ও দর্শনে এসব কবিতার ব্যাপ্তি অনেক বড়। কিয়ারোস্তামির কবিতার সমস্ত বই পড়তে পড়তেই মনে হয়েছে, বাংলা ভাষায় ওনার তিনটি মৌলিক কবিতার বই এক মলাটে বন্দী হওয়া প্রয়োজন। কিয়ারোস্তামির কবিতাই আমাকে কাজটি করতে উৎসাহ দিয়েছে। বইটি পাঠকরা বেশ ভালোভাবে গ্রহণ করেছেন এবং প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে বার্তা পাচ্ছি। ভারত থেকেও বইটি প্রকাশ হয়েছিল, আসামের এক পাঠক এটিকে বাংলা ভাষায় অনুবাদের সেরা কাজগুলো একটি বলে রায় দিয়েছেন। উনি আমার একেবারেই অপরিচিত। ঢাকা থেকে বইটা করেছে বৈভব এবং দেশের পাঠকদের কাছ থেকেও যথেষ্ট বাহবা পেয়েছি।
অনুবাদের ক্ষেত্রে সব সময় একটি কথা উঠে আসে, এতে মূলের সাহিত্যরস বজায় রাখা কঠিন। এই কবিতাগুলো অনুবাদের ক্ষেত্রে আপনি এ সমস্যায় পড়েছিলেন কি না? বা পড়লে এটা কীভাবে সমন্বয় করেছেন?
রুহুল মাহফুজ জয় : দুনিয়ার প্রতিটি ভাষাই ভিন্ন, কিন্তু ভাষার মূল উদ্দেশ্য তো যোগাযোগ স্থাপন করা, মানুষ যেখানে যেই ভাষাতেই কথা বলুক বা লিখুক, যোগাযোগটা কিন্তু একই রকম হয়। ভাষার এই যোগাযোগের সাঁকোটাই অনুবাদের ক্ষেত্রে কাজ করে মনে হয়। অনুবাদে মূলের সাহিত্যরস ঠিক রাখা খুব কঠিন, সবচেয়ে বেশি কঠিন কবিতায়। আমি মনে করি কবিতার অনুবাদ হয় না। তারপরেও চেষ্টা করেছি যেন অন্তত কাব্যরসটা থাকে এবং যোগাযোগ প্রতিষ্ঠিত হয়। সে কারণে চেষ্টা করেছি যেন পাঠকের মনে হয় বাংলা ভাষায় লেখা কবিতাই পড়ছেন। এ ক্ষেত্রে আমি মনে হয় কাজটা ঠিকভাবেই করতে পেরেছি।