এবার মেলায় আপনার একটি বই এসেছে—মালঞ্চমালার ক্যাসেট। এটি আপনার কততম বই? বইটি সম্পর্কে বলুন।
মীর রবি : ‘মালঞ্চমালার ক্যাসেট’ আমার প্রকাশিত ষষ্ঠ বই। কবিতার বই হিসেবে পঞ্চম। এই বইয়ে স্থান পাওয়া কবিতাগুলো মূলত আমাদের লোকগল্প, লোকগাথা ও লোকজ ঐতিহ্যকে ঘিরে রচিত হয়েছে। সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য পরম্পরায় নতুন প্রজন্ম আমাদের হাজার বছরের লোকধারাকে আধুনিক কবিতার মাধ্যমে নতুন করে জানতে পারবে বলে মনে করছি। আমি বিশ্বাস করি ‘মালঞ্চমালার ক্যাসেট’ পাঠককে ঐতিহ্য অনুসন্ধানে অনুসন্ধিৎসু করবে। যা আমাদের আরও বেশি বাঙালি চেতনাবোধে ঋদ্ধ করে তুলবে। সেই সঙ্গে এই বইটি নতুন প্রজন্মকে কৃষি সভ্যতা ও কৃষক সংস্কৃতির কাছাকাছি নিয়ে যাবে।
আপনার লেখালেখির শুরু কীভাবে?
মীর রবি : ছেলেবেলায় আমি ছবি আঁকতাম। বিভিন্ন দৈনিকের শিশুপাতায় ছাপা হওয়া ছবি ও অলংকরণ আমাকে মুগ্ধ করত। এই মুগ্ধতা থেকে আমি নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। সেসময় স্কুল লাইব্রেরির নানা রকম রূপকথার বইয়ের ছবি আমাকে পাঠ আকৃষ্ট করতে সক্ষম হয়েছিল। বলা যায় লেখালেখির সূত্রপাতের সঙ্গে এসব ঘটনার পারস্পরিক সম্পর্ক রয়েছে। ছেলেবেলায় আমার এই পঠন অভিজ্ঞতাই আমাকে সৃজন ও কল্পনার জগতে পৌঁছে দিয়েছিল। চিত্রশিল্পী হওয়ার স্বপ্ন ধীরে ধীরে লেখক সত্ত্বার দিকে নিয়ে গিয়েছে আমাকে। পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় কবি জসীম উদ্দীনের কবিতা অবলম্বনে বাংলা ভাষা নিয়ে একটা কবিতা লিখেছিলাম। সেই থেকেই শুরু। প্রথমের দিকে বিভিন্ন দৈনিকের শিশুপাতায় লিখতাম। একটু বড়ো হওয়ার পর লিটম্যাগের সঙ্গে পরিচয় ঘটায় সেসবেই লিখতে শুরু করি। সেই সঙ্গে নিজেও তখন লিটলম্যাগ সম্পাদনা করতাম। এসব কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়েই মূলত লেখালেখির সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে যাওয়া। জীবনে পুরো সময়টা এর মধ্যেই কাটিয়ে দিতে চাই।
বাংলাদেশের কবিতার সাম্প্রতিক প্রবণতা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
মীর রবি : বাংলাদেশের সাম্প্রতিক কবিতা তুলনামূলকভাবে অন্য সময় থেকে অনেক দূর এগিয়ে গিয়েছে। সত্তর আশি নব্বইয়ের দশক পেরিয়ে শূন্য থেকে বর্তমান অবধি বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান বিবর্তনের ধারা রয়েছে। পূর্ববর্তী কবিতায় ঔপনিবেশিকতার সুস্পষ্ট যে ছাপ ছিল, তা এখনকার কবিতায় সেভাবে লক্ষ্য করা যায় না। বলতে হয় আমাদের তরুণ কবিরা এই জায়গা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে এবং নিজস্বতার দিকে দ্রুত অগ্রসর হচ্ছে। বিশেষত অনেক তরুণ কবিই তুমুলভাবে রাজনৈতিক সচেতন হয়ে উঠেছে। সংলাপ বা স্লোগান নির্ভর কবিতা না লিখে কাব্য নন্দনের ভেতর দিয়ে কবিতাকে নির্মাণ করছে। বর্তমান কবিতায় বিবর্তিত ধারায় সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যগত বৈচিত্র্যও উঠে আসছে। যা আমাদের জন্য সুখকর। বলতে হয় বর্তমান সময়ে বাংলাদেশের সাহিত্যে অনেক সম্ভাবনাময় কবির আবির্ভাব ঘটেছে। যা আমাদের সত্যিকার অর্থেই আশা জাগায়, বিশ্ব কবিতায় আমাদের অবস্থান এর মধ্য দিয়ে আরও দৃঢ় হবে। এজন্য প্রয়োজন আমাদের দেশের কবিতাগুলোর যথাযথ অনুবাদ ও বহির্বিশ্বে প্রকাশের ব্যবস্থা করা। সেই সঙ্গে এই প্রবণতার কথাও অস্বীকার করা যায় না যে, আমাদের কবিতা কতিপয় তরুণ কবির কবিতার মাধ্যমে সাম্প্রদায়িক দোষে দূষিত হয়ে যাচ্ছে। বাঙালি চেতনাবোধকে বিভাজিত করে এসব কবিতা আমাদের প্রজন্মকে মরুর সংস্কৃতির দিকে ধাবিত করছে। দুঃখজনক যে নানাভাবে তারাই অধিকতর পৃষ্ঠপোষকতা পাচ্ছে। এর বিপরীত প্রবণতা সংগ্রাম আমাদের আরও জোরালো করতে হবে।
বইমেলার পরিসর বেড়েছে, তার প্রভাব কি সাহিত্য চর্চায় পড়েছে?
মীর রবি : বইমেলার পরিসর বৃদ্ধি পাওয়া সাহিত্য চর্চার জন্য একটি ইতিবাচক দিক। সাম্প্রতিক সময়ে দেশের নানা প্রান্তেই এর প্রভাব খুব স্পষ্ট। আমরা বইমেলা এলেই দেখতে পাই সারা দেশ থেকে অনেক লেখক ও সাহিত্যিক বইমেলায় সমবেত হচ্ছেন, নিজেদের বই প্রকাশ করছেন। পাঠকও আসছেন, বই কিনছেন। এর মধ্য দিয়েই আমাদের বই বাজার তৈরি হচ্ছে। যা সাহিত্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
বইমেলা কেন্দ্রিক লেখকদের তৎপরতা তো কম নয়। তারা নতুন নতুন বই লিখছেন, প্রতি বছরই প্রকাশিত হচ্ছে হাজার হাজার বই। গুণগত জায়গায় তা কতটুকু মানসম্পন্ন সেই প্রশ্ন যদি আমরা না করি, তাহলে এটাকে ইতিবাচক হিসেবেই আমরা নিতে চাই। তবে মানসম্মত বইয়ের ক্ষেত্রে, মূল ধারার সাহিত্যের ক্ষেত্রে এর কিছু বিরূপ প্রভাবও লক্ষ্যণীয় হয়ে উঠেছে। এর বড়ো উদাহরণ সোশ্যাল মিডিয়ার তথাকথিত তারকাদের লেখক হয়ে ওঠার প্রবণতা। যা আমাদের সাহিত্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে, বিভ্রান্ত করছে পাঠককে।
বর্তমানে অনেকটাই অবহেলিত লিটলম্যাগ চত্বর। এর কারণ কী বলে আপনি মনে করেন?
মীর রবি : লিটলম্যাগ সাহিত্য আন্দোলন ও চর্চার গুরুত্বপূর্ণ প্লাটফর্ম। কিন্তু গত কয়েক দশকেও এর কোনো সাংগঠনিক সক্ষমতা বৃদ্ধি পায়নি। ফলে প্রতিবছর বইমেলায় লিটলম্যাগ চত্বরের দুর্দশা দেখতে হয়। খুবই লজ্জাজনক যে যেগুলো লিটলম্যাগ নয় এমনকি সাহিত্য পত্রিকাও নয়, সেসব প্রকাশনাকেও লিটলম্যাগ চত্বরে স্টল পেতে দেখা যায়। বড়ো অদ্ভুত বিষয় যে কীভাবে যেন সংগঠনগুলোও লিটলম্যাগ চত্বরে ঠাঁই পেয়ে যায়। এভাবে চলতে থাকলে লিটলম্যাগের মূল স্রোত একসময় স্থবির হয়ে যাবে। সেই সঙ্গে উঠতি লেখকরা প্রকৃতার্থে নিজেদের চর্চার জায়গাও হারিয়ে ফেলবে। আমাদের এ বিষয়ে আরও তৎপর হওয়া প্রয়োজন।