• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ১২ ডিসেম্বর, ২০২৪, ২৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১১ জমাদিউস সানি ১৪৪৬
কেপটাউন কড়চা

উত্তমাশা অন্তরীপে উড়ন্ত আত্মা


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: ডিসেম্বর ২৪, ২০২২, ০১:৩১ পিএম
উত্তমাশা অন্তরীপে উড়ন্ত আত্মা

নতুন কোথাও গেলে নাকি বইয়ের দোকান আর কাঁচাবাজারে ঢুঁ মারতে হয়। এই ব্যবস্থাপত্র দিয়েছিলেন জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক। কেপটাউনের বইয়ের দোকান আর মাছের বাজার ঘোরার সময় তাঁর এই কথা আমার মনে ছিল না। কিন্তু লেখার সময় মনে পড়ল। কেপটাউনে এসে দ্বিতীয় দিন বইয়ের দোকানে গিয়েছি, রবেন আইল্যান্ডে যেদিন গেলাম, সেদিন বিকেলে বইয়ের দোকানে গিয়েছি, তার পরের দিন ক্যানাল ওয়াক শপিং মলে গিয়েছি আরও দুটি বইয়ের দোকানে। কিছু দরকারি বইপত্র কিনে, রাতে ডিনার সেরে হোটেলে ফিরে আসি সে বেলা। তার পরদিন, ১ অক্টোবর, আমরা সারা দিনের পরিকল্পনা নিয়ে বের হই। এবার মনে আর আমি শুধু নই, মনের মা-ও আছে। আমাদের সুমনা ভাবি আছেন। আর দক্ষিণ আফ্রিকার বন্ধু এমিল ও তার ছোট ভাই আমাদের হোটেল থেকে তুলে নিলেন দুটি গাড়িতে। সকাল সকাল আমরা যাচ্ছি ‘হুট বে’ সৈকতে। যাত্রাপথে আমাদের চোখে পড়ল টেবিল মাউন্টেন, আরেকটু এগোতে নজরে এলো সিংহমুণ্ডু-সদৃশ পর্বত লায়নস হেড। পাহাড় কেটে বানানো আঁকাবাঁকা পথ ধরে আমরা যাচ্ছি ওয়েস্টার্ন কেপের দিকে। গাড়িতে চিপসের প্যাকেট খোলা হয়ে গেছে। মনে থাকলে চিপসের প্যাকেট সামলে রাখা মুশকিল। চিপস চিবুতে চিবুতে চারদিকের চিত্রপট উপভোগ করছি সবাই। যেদিকে চোখ যায় গাঢ় সুনীল। হারবার রোডে চলতে চলতেই চোখ যাচ্ছিল সমুদ্রসৈকত আর বালুকাবেলার দিকে। হুট বেতে পৌঁছে গাড়ি থেকে নামতেই ঠান্ডা জলবায়ুর ঝাপটা কাঁপিয়ে দিল। তীব্র রোদ দিচ্ছে সংগত, কিন্তু উত্তাপহীন। মনে দৌড়াতে লাগল সৈকতজুড়ে। পানি বরফের মতো ঠান্ডা। লোকজন ছোট ছোট ভাগে ঘুরছে এদিক-সেদিক। কয়েকজন এসেছে কুকুর নিয়ে, ফ্রিজবি আর বল খেলা চলছে। এরই ভেতর এক কৃষ্ণ কুকুর খেলাচ্ছলেই মনেকে ধাওয়া দিল। আমি দৌড়ে মনেকে কোলে তুলে নিলাম। দুঃখ প্রকাশ করল কুকুরের মালিক।


সৈকত থেকে বাঁধানো পাড়ে উঠেই নজরে এলো বিশালবপুর নিকোলাসকে। নিকোলাস একটি সিল মাছ। তার মালিক তাকে দিয়ে নানাবিধ খেলা দেখায়। মনে তাকে দেখেই শুরু করেছে বায়না, বাবা ওকে ধরি? মনের চেয়ে চার গুণ বড় নিকোলাস বেশ আয়েশ করে রোদ পোহাচ্ছিল। সিলের মালিক উৎসাহ দিল ধরার জন্য, ওটার সঙ্গে তার নগদ নারায়ণ প্রাপ্তির যোগ আছে। মনেকে বললাম, যাও ধরো। মনের সঙ্গে মনের মা মনিও নিকোলাসের পৃষ্ঠদেশে হাত বুলিয়ে দিল। আমরা সিলের মালিককে কুড়ি র‍্যান্ড দিলে সে আরও উৎসাহী হয়ে মনেকে বলল, শুধু তোমার জন্য নিকোলাস সাগরের পানিতে ঝাঁপ দেবে। মাছের টুকরো ছুড়ে লোভ দেখিয়ে দেখিয়ে নিকোলাসকে বাঁধানো ঘাট থেকে পানিতে ফেলতে বেশ বেগ পেতে হলো মালিককে। কারণ, নিকোলাস সারা দিন খেতে খেতে বিপুল ওজন ধারণ করে ফেলেছে, কাজেই একটা আলসেমিও চলে এসেছে তার ভেতর। কিন্তু মালিক নাছোড়বান্দা। বহু কায়দা করে সে কিনারে নিল নিকোলাসকে। তারপর মাছের টুকরোর লোভ দেখিয়ে ঠিকই পানিতে ঝাঁপ দিতে বাধ্য করল নিরীহ প্রাণীটিকে। সেটা দেখে শুধু মনে নয়, আশপাশের বাচ্চারাও অনেক মজা পেল। এবার তাকে পাড়ে ওঠানোর যুদ্ধ। মালিক সেই চেষ্টায় রত হলো। আমরা আর ওটার জন্য অপেক্ষা করলাম না। হেঁটে গেলাম সামনে। মাছের বাজারের সামনে যেতেই নাকে আঁশটে গন্ধ ধাক্কা দিল। কানে গাঙচিলের চিঁচিঁ শব্দ। এমিল জানাল ভোরে সে এখান থেকেই মাছ, স্কুইড আর চিংড়ি কিনিয়ে নিয়েছে আমাদের দুপুরের খাবারের জন্য। বাড়িতে সেসবের প্রস্তুতি চলছে। আপাতত বাজারের কিছুটা সামনে গিয়ে অ্যাপেলটাইজার কিনে খেলাম আমরা। তারপর ফিরে এলাম আগের জায়গায়।

সিল মাছ নিকোলাস ও তার মালিক। ছবি: লেখক

সৈকতের অদূরে থাকা মেরিনার্স হোয়ার্ফ নামের একটি রেস্তোরাঁয় গেলাম। সি ফুড পাওয়া যায় সেখানে। কালামারি, ঝিনুক, ফিশ অ্যান্ড চিপস। আমার উদরে ঘণ্টা বাজলেও, সঙ্গীসাথিদের দেখলাম ছুটে ছুটে চলে গেল আশপাশে থাকা মুক্তো ও অলংকারের দোকানে। আমি আর একা একা কী করব, মনেকে নিয়ে ঢুকলাম এক স্যুভেনির শপে। সেখান থেকে ছোটখাটো কিছু জিনিস কিনলাম। মনের মা যোগ দিল আমাদের সঙ্গে। সবাই মুক্তোর দোকানে ভিড় করছে, কিন্তু মনি আমার কাছে! কিছু পুরোনো বইও রাখা আছে দেখলাম। সবই সমুদ্র ও সামুদ্রিক প্রাণিবিষয়ক বই। উল্টেপাল্টে দেখলাম। বুঝলাম, জাহাজের পাঠাগার থেকে সংগ্রহ করা হয়েছে এসব বই। পাশের আরেকটি দোকানে ঢুকে তো মাথা নষ্ট হওয়ার দশা। সেখানে একশ-দেড়শ বছরের পুরোনো জাহাজের নানাবিধ সামগ্রী, নাবিকের দিনলিপি, ব্যবহৃত তৈজসপত্র, কম্পাস তো রয়েছেই, আছে বিরল বইপত্র এবং সবগুলোই সমুদ্রযাত্রা-সম্পর্কিত। ওই দোকানে আবার শিশুদের ঢোকা নিষেধ। মনেকে বাইরে রেখে ঢুকতে হয়েছে। কাজেই মনে একটু পরপর ‘বাবা, বাবা’ বলে ডাকছিল, আর আমি জবাব দিতে দিতে জিনিসপত্র দেখছিলাম। মনের মা-ও তখন মনের সঙ্গে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য উত্তমাশা অন্তরীপ। কাজেই এখানে বেশি সময় নষ্ট করা যাবে না। আমি নিজের আকর্ষণকে গুটিয়ে বেরিয়ে এলাম ও রকম মনোহরা এন্টিক শপ থেকে।  

রেস্তোরাঁ ও পুরোনো জিনিসপত্রের দোকান। ছবি: লেখক

তবে আরও বেশি চিত্তাকর্ষক বিষয় ছড়িয়ে ছিল সামনের যাত্রাপথে। বিবিসির ট্রাভেল পাতায় যে পথটিকে বলা হয় ‘দুনিয়ার সবচেয়ে সুন্দর’ গাড়িচালনার রাস্তা, সেই চ্যাপম্যানস পিক ড্রাইভ ধরে আমরা এগিয়ে চললাম। একদিকে নিচে সুনীল, ফেনায়িত সমুদ্র, হুট বে; অন্যদিকে পাহাড়ের দেয়াল। ঝলমলে রোদ। নয়নাভিরাম। দক্ষিণ আফ্রিকার অতলান্তিকের কোল ঘেঁষে সর্পিল এই রাস্তা ৯ কিলোমটার দীর্ঘ। রাস্তার নামকরণ হয়েছে জন চ্যাপম্যানের নামে। চ্যাপম্যান ছিলেন একজন ব্রিটিশ, জাহাজের কাপ্তান, তিনি এই এলাকায় এসেছিলেন ১৬০৭ সালে। তবে এই চ্যাপম্যানস পিক ড্রাইভের মূল নায়ক স্যার নিকোলাস ফ্রেডেরিক দো ওয়াল, কেপ প্রদেশের প্রথম প্রশাসক। প্রকৌশলীরা যখন নেতিবাচক উত্তর দিয়ে দিয়েছিলেন, তখন এই নিকোলাসের অদম্য ইচ্ছাতেই পাহাড় কেটে রাস্তাটি বানানো হয়, ১৯১৫ থেকে ১৯২২ সালের ভেতর। কিন্তু এই রাস্তার বড় সমস্যা ছিল শিলাধস। পাথর গড়িয়ে পড়ত যখন-তখন। দুর্ঘটনায় মানুষও মারা গেছে। দশকের পর দশক নানাবিধ প্রচেষ্টার পর ‘হাফ টানেল’ বানানো হলো। ১৫৫ মিটার দীর্ঘ এই টানেল শিলাধসের হাত থেকে রক্ষা দিল যাত্রীদের। আর সেটাই এখন হয়ে উঠেছে পর্যটকদের অন্যতম আকর্ষণ। পাহাড়ি রাস্তার ওপর এ রকম একমুখ খোলা সুড়ঙ্গপথ সত্যি বিস্ময়কর, আর একদিকে আবার যখন সফেন সমুদ্র, তখন এই পথ আর শুদ্ধ বিস্ময়কর থাকে না, হয়ে ওঠে মনোমুগ্ধকর। আমি টানেলটি দূর থেকে দেখে ঝটপট ক্যামেরা বের করে ভিডিও করে নিই। এটি মানুষের সঙ্গে প্রকৃতির এক চমৎকার সমঝোতার স্মারকও বটে।

দুর্ঘটনা রোধ করে দৃষ্টিনন্দন ‘হাফ টানেল’। ছবি: লেখক

আমাদের গাড়ি ধীরে ধীরে মিলার্স পয়েন্ট পেরিয়ে গেল। দেখলাম ওখানে স্কিবোট ক্লাব আছে। আমাদের পথ অনেকটা সমুদ্রতলের কাছাকাছি চলে এসেছে। তবে কিছু দূর পরই আমরা ওপরে উঠতে শুরু করি। বিশেষ করে যখন কেপ অব গুড হোপের মূল ফটকের কাছাকাছি আসে গাড়ি। মূল প্রবেশদ্বারে স্থানীয় পূর্ণবয়স্ক মানুষের জন্য ৯০ র‍্যান্ড ও বিদেশি হলে ১৮০ র‍্যান্ড গুনতে হয়। আমাদের চেহারা কিছুটা দক্ষিণ আফ্রিকার মানুষদের মতো হলেও দ্বাররক্ষীদের চোখ বড় সজাগ। তারা ঠিকঠাক টিকিটের দামই রাখল। যাক, পাথরের তৈরি তোরণ দিয়ে ঢোকার পর দেখা যাবে বিস্তীর্ণ পাথুরে জমিন। সেখানে বিচিত্র সব উদ্ভিদ ও প্রাণীর বাস। বেবুনের দেখা পাওয়ার আশায় চোখ সজাগ রাখলেও তার আভাস পাওয়া যায়নি। শীতল হাওয়ার চোটে কোথায় গিয়ে লুকিয়েছে কে জানে! তবে স্থানীয় উদ্ভিদ ফিনবস বা ফাইন বোসের (বাংলায় ‘চমৎকার গুল্ম’) ছড়াছড়ি। এমিল জানাল রুবিবস বা রবি বোস নামের উদ্ভিদ থেকে এখানে লাল চা-পাতা তৈরি করা হয়। চুনিগুল্ম থেকে বানানো চা তো লালই হবে! তো এই চা নাকি এখানে খুব জনপ্রিয়। উপকূলবর্তী এই এলাকাটি জাতীয় উদ্যানের আওতাধীন করা হয়েছে অনেক আগেই, তাই এখান থেকে ফুল কিংবা পাতা ছেঁড়া সম্পূর্ণ নিষেধ। উদ্ভিদ ও গুল্মের সংবর্ধনা পেরিয়ে আমরা পৌঁছালাম উত্তমাশা অন্তরীপের মূল বিন্দুতে বা কেপ পয়েন্টে। 

কেপ অব গুড হোপের চমৎকার বাংলাটি করেছিলেন রাজেন্দ্রলাল মিত্র—উত্তমাশা অন্তরীপ। ইতিহাসবিদ, পুরাতত্ত্ববিশারদ ও ভাষাবিদ রাজেন্দ্রলাল মিত্রের খোঁজ দিয়েছিলেন আমার শিক্ষক সলিমুল্লাহ খান। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও এই রাজেন্দ্রলাল সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করে গেছেন। রাজেন্দ্রলাল, সুনীতিকুমার, রবীন্দ্রনাথ এরা কি সুন্দর সুন্দর বাংলা পরিভাষা তৈরি করেছেন, আর আমরা এখন উল্টো দিকে হাঁটছি, সবকিছু ইংরেজিতে না হলে আমাদের চলছেই না। বাংলার ওপর আমাদের আস্থা যেন কমে যাচ্ছে। এই উত্তমাশা অন্তরীপের ক্ষেত্রেও এমনটা ঘটেছিল, নাবিকদের আস্থা চুরমার হয়ে যেত এখানে এলে। জাহাজডুবির ঘটনা আতঙ্কিত করে রাখত তাদের। অন্তরীপটির নাম তাই রাখা হয়েছিল ঝড়ঝঞ্ঝার অন্তরীপ বা কেপ অব টরমেন্ট।

উত্তমাশা অন্তরীপ। ছবি: লেখক

ভূপ্রকৃতির কারণেই নিয়ন্ত্রণ হারাতেন নাবিকেরা। ঝোড়ো বাতাস আর সমুদ্রের নিচে লুকিয়ে থাকা ডুবো পাহাড়গুলোই ছিল বড় চ্যালেঞ্জ। সর্বাধিক ভয়ংকর ডুবো পাহাড়টির নাম আলবাট্রস রক। শোনা যায়, ২৬টি জাহাজের টুকরো এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে সমুদ্রের তলদেশে। তারপরও সমুদ্রপথে বাণিজ্য বিস্তারের কালে মরিয়া ছিলেন বণিকেরা, নাবিকেরা। নতুন বাজার চাই। চাই নতুন পণ্য। জীবনের ঝুঁকি নিতেও তাই পিছপা হতেন না তারা। একবার এক ডাচ নাবিক নাকি জেদ ধরেন, তিনি এই অন্তরীপ অতিক্রম করবেন যে করেই হোক। মরে গেলেও তিনি এই শপথ রাখবেন বলে জানিয়েছিলেন। কপাল মন্দ, অন্তরীপ প্রদক্ষিণ করতে গিয়ে তার জাহাজ ডুবে যায়, প্রাণও হারান ওই ওলন্দাজ নাবিক। তারপর থেকেই নাকি অশরীরী হয়ে এই ডাচম্যান ঘুরে বেড়ান অন্তরীপের এদিকসেদিক। এখান থেকেই জন্ম নেয় ফ্লাইং ডাচম্যান বা উড়ন্ত ওলন্দাজ নাবিকের লোককথা। 


যারা হলিউডের চলচ্চিত্র ‘পাইরেটস অব দ্য ক্যারাবিয়ান’ দেখেছেন তারাও নিশ্চয় ‘ডেডম্যানস চেস্ট’ পর্বে দেখেছেন উড়ন্ত ওলন্দাজের গল্পটি। কিন্তু সেটি স্থানীয় গল্প থেকে ভিন্ন, যদিও সিনেমাওলারা অনুপ্রেরণা নিয়েছেন এখান থেকেই। সিনেমায় ফ্লাইং ডাচম্যান এক ভয়ংকর ভূত, যার দায়িত্ব হলো সাগরে প্রাণ হারানো নাবিকদের আত্মাকে পরপারে পৌঁছে দিয়ে আসা। জলদস্যুদের স্বর্ণযুগে সাত সমুদ্দুরে এই উড়ন্ত ওলন্দাজ এক মূর্তিমান আতঙ্কের নাম। নবনীতা দেবসেনের ভ্রমণগদ্যে পড়েছিলাম এই কেপ পয়েন্টে একটি ফিউনিকুলার ট্রেন রাখা আছে, ওপরে পর্বতের চূড়ায় ওঠার জন্য, যেখানে পুরোনো বাতিঘর নির্মিত। এই ফিউনিকুলার ট্রেনের নাম নাকি ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’। আমি গাড়িতে করে যেতে যেতেই এমিলকে বলছিলাম, পর্বতের মাথায় ওঠার ফিউনিকুলার ট্রেনের নাম ‘ফ্লাইং ডাচম্যান’। কিন্তু পৌঁছে দেখা গেল ট্রেনটি যান্ত্রিক কারণে মৃত, সেই সত্যিকারের নাবিক ডাচম্যানের মতো সে-ও অক্কা পেয়েছে। সকলেই এই খবরে কিছুটা বিমর্ষ। তবে অতটা নয়, কারণ, যে জায়গায় তারা দাঁড়িয়েছিল, সেখান থেকেও বেশ চমৎকার দৃশ্য উপভোগ করা যায়। কেউ আর হাঁটু ভেঙে ওপরে উঠতে আগ্রহী নয়। নবনীতার লেখায় পড়েছিলাম, “ট্রেকাররা হেঁটেই মেরে দেয়,” চিন্তা করলাম, ট্রেন নেই তাতে কি, আমিও হেঁটেই মেরে দিই। খাড়া পাহাড়ি পথ বেয়ে ওপরে উঠতে হয়। এমিল ও তপু কিছু দূর গিয়ে হাল ছেড়ে দিল। আরাফাত দেখলাম উঠতে শুরু করেছে। মনি আর মনে টুকটুক করে উঠতে লাগল আমার সঙ্গে। আমাদের লক্ষ্য বাতিঘরে পৌঁছে সেই জলের দাগ প্রত্যক্ষ করা, যার একদিকে অতলান্তিক, আরেক দিকে ভারত মহাসাগর। তো উঁচু সিঁড়ি ভাঙতে ভাঙতে অনেকগুলো ছবি তোলার জায়গা পেলাম। সেখানে দাঁড়িয়ে আমরা ছবি তুলে নিলাম। ডিপ ফোকাসে থাকল সেই কুখ্যাত অন্তরীপ।


সবাই প্রায় হাঁপিয়ে উঠেছি। মনে কয়েকবার নেমে যেতে চেয়েছে। আমি সাহস দিয়ে বললাম, ওই যে বাবা দেখো, কত বাচ্চারা উঠে যাচ্ছে ওপরে। আসলেই দু-একটি ইউরোপীয় বাচ্চাকে দেখলাম তরতর করে উঠে যাচ্ছে। মনে ওদের দেখে উৎসাহ পেল। তবে বাতিঘরের কাছাকাছি এসে, যেখান থেকে আরও সাত-আটতলা সমান উঠতে হবে, সেখানে এসে মনি আর মনে দুজনেই আত্মসমর্পণ করল। বলল, তুমিই যাও। দেখলাম আরাফাত বাতিঘর দেখে আবার নিচে চলে যাচ্ছে। আমি জিহ্বা বের করে হাঁপাতে হাঁপাতে ওপরে উঠলাম। ঠান্ডা হাওয়ার ঝাপটা এসে ছুঁয়ে গেল ঘর্মাক্ত মুখমণ্ডলে। বাতিঘর স্পর্শ করলাম। আর দৃষ্টি ছুড়ে দিলাম সমুদ্র আর দিগন্তের উধাও বিন্দুতে। আলাদা করে বোঝা গেল না কোনটা আটলান্টিক আর কোনটা ইন্ডিয়ান ওশান। নোনা হাওয়ায় দাঁড়িয়ে চোখ প্যান করলাম এদিক থেকে ওদিক। এরপর ধীরে ধীরে বাতিঘরের কাছে গিয়ে দেখলাম ছোট একটি টিনের পাত টাঙানো রয়েছে, তাতে লেখা— ঐতিহাসিক বাতিঘর (১৮৬০-১৯১৯): সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ২৪৯ মিটার ওপরে ঢালাই লোহা জুড়ে জুড়ে এই মিনার কেপ পয়েন্ট পিকে বসানো হয়েছে। ৬৭ কিলোমিটার দূরে থাকা জাহাজ এই বাতিঘরের ২ হাজার দীপশক্তির (ক্যান্ডেল পাওয়ার) সফেদ আলোর ঝলক দেখতে পায়। তবে প্রায়ই মেঘ ও কুয়াশার আবরণের কারণে বাতিঘরটি অকার্যকর প্রমাণিত হয়। ১৯১১ সালে পর্তুগিজ লাইনার ‘লুসিতানিয়া’র ভরাডুবির পর, নিচে ডায়াস পয়েন্টে, সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে ৮৭ মিটার উঁচুতে বর্তমান বাতিঘরটি নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।” 

কেপ পয়েন্ট পিকে ইতিহাসের সাক্ষ্য দিচ্ছে বাতিঘরটি। ছবি: লেখক

বাতিঘর থাকার পরও আবহাওয়ার কারণে জাহাজডুবির ঘটনা ঘটেছে এই অন্তরীপে, আর তারও চার-পাঁচশ বছর আগের চিত্র তো ভাবাও যায় না। তবে ১৪৮৮ সালে পর্তুগিজ নাবিক বার্থলোমিউ দিয়াজ এই অন্তরীপে সাফল্যের সঙ্গে নোঙর ফেলেছিলেন। ‘ঝড়ঝঞ্ঝার অন্তরীপ’ নামটা এই দিয়াজেরই দেওয়া। ভয়াবহ এই অন্তরীপ ঘুরে ভারতবর্ষ গিয়েছিলেন আরেক পর্তুগিজ নাবিক ভাস্কো ডা গামা। এরপর থেকে অনেক পর্তুগিজ নাবিক এই পথ ব্যবহার করতে থাকেন ভারতবর্ষে পৌঁছানোর জন্য। পর্তুগিজরা সমুদ্রযাত্রায় বেশ ওস্তাদ। তারা যেন ভয়কে জয় করে, সাফল্যের সঙ্গে ভারতবর্ষের দিকে যাত্রা করতে পারে, সে জন্য এই জায়গাটির নাম পাল্টে ‘কেপ অব গুড হোপ’ বা উত্তমাশা অন্তরীপ রাখেন পর্তুগালের রাজা জর্জ।  

বাতিঘরের সামনে দাঁড়িয়ে দুই মহাসাগরের মিলন পর্যবেক্ষণ। ছবি: লেখক

বাতিঘরের ওখানটায় দাঁড়িয়ে নিজেকে সারা জাহানের রাজা মনে হতে পারে কারও কারও। প্রকৃতি সেখানে প্রকৃত অর্থেই সব সুন্দর ঢেলে দিয়েছে। ফোন এলো দ্রুত নিচে নামার জন্য। সবাই অপেক্ষা করছে। আর ক্ষুধাও লেগেছে। বেলা গড়িয়ে প্রায় তিনটা। আমরা তিনজন দ্রুত নেমে এলাম। কেপ পয়েন্টের ওখানে দেখলাম সুমনা ভাবি তখনো তপুকে দিয়ে ছবি তোলাচ্ছেন। এই সুযোগে টুক করে আমি একটি স্যুভেনির শপ থেকে মগ কিনে নিলাম। এরপর গাড়ি করে রওনা দিলাম এমিলের বাড়ির দিকে। ফিরতি পথে দেখা মিলল বেবুনের। গাড়ি থেকে দেখলাম পরিবার সমেত রাস্তা পেরোচ্ছেন তারা। এরা নাকি ভীষণ বজ্জাত আর ছিনতাইকারী স্বভাবের। ভাগ্যিস আমাদের সঙ্গে সরাসরি সাক্ষাৎ হয়নি। পেঙ্গুইনদের নিবাস পেরিয়ে এলেও তাদের দেখা মেলেনি, তবে সিল মাছ চোখে পড়েছে, তটে বসে পাটে যাওয়া সূর্যের রোদ খাচ্ছে। শেষ বিকেলের আলো মাখতে মাখতে আমরাও একসময় পৌঁছালাম এমিলের বিশাল বাড়িতে। খাবারের ম ম গন্ধে ভরে গেছে পুরো ঘর। সবার উদরেই তখন বেবুন বুকডন দিচ্ছে। দ্রাক্ষারস যোগে সামুদ্রিক খাবার ভক্ষণ চলল। তারপর কিছু সময় বিলিয়ার্ড। এমিলের পরিবারের সবাই বেশ মিশুক। অনেক গপ্পো হলো। রাতের আকাশে তারা ফুটতে শুরু করেছে। আমরা বিদায় নিলাম। হোটেলের দিকে যেতে যেতে মনে স্মরণ করতে লাগল নিকোলাসকে। 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!