• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
টরোন্টো টকিজ ২

কিং স্ট্রিটে হঠাৎ আনন্দ


বিধান রিবেরু
প্রকাশিত: সেপ্টেম্বর ৯, ২০২৩, ০৪:৫৬ পিএম
কিং স্ট্রিটে হঠাৎ আনন্দ

নতুন বাসাটি বেশ ভালো। মেইন স্ট্রিটের কাছে হেলসির এই নয়া সাকিনে একটা লেখালেখির ঘরও মিলেছে। আর এই বাসা থেকে উৎসবস্থলে যেতে সব মিলিয়ে সময় লাগে পঞ্চাশ মিনিট মাত্র। দ্বিতীয় দিন বাসা থেকে বেরিয়ে দেখি কনকনে ঠাণ্ডা হাওয়া। আগের রাতে বৃষ্টি হওয়ার ফল। থাকার জায়গা থেকে সাত-আট মিনিট হাঁটলেই বাসস্টেশন। তেইশ নম্বর বাসে করে মেইন স্ট্রিটের সাবওয়ে স্টেশন। সেখান থেকে দুটি পাতাল রেল বদলাতে হয়। একবার নিতে হয় ওয়েস্টবাউন্ড ট্রেন। তাতে চড়ে ব্লুরইয়ং স্টেশন। ওখান থেকে চড়তে হয় সাউথবাউন্ড ট্রেনে। গন্তব্য সেন্ট এনড্রু। এই স্টেশন থেকে পাঁচ-সাত মিনিট হাঁটলেই ভেন্যু। 

 
দ্বিতীয় দিন ঠিকঠাক পৌঁছে গেলাম টিফের বেল লাইটবক্সে। সাড়ে আটটায় স্ক্রিনিং কিরন রাওয়ের ছবি ‘লস্ট লেডিস’। ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার। আমির খানের প্রযোজনা সংস্থা থেকে বানানো ছবির কেন্দ্রে রয়েছে ভারতের পিছিয়ে পড়া নারী সমাজ। যেখানে নারীদের পর্দার আড়ালে রাখা হয়, কমজোর ভাবা হয় এবং যৌতুকের মাধ্যমে অর্থকড়ি উপার্জনের ডিমপাড়া সোনার হাঁস হিসেবে গণ্য করা হয়। দীপক নামের এক তরুণ ফুল নামের এক তরুণীকে বিয়ে করে বাড়ি ফিরছিল। প্রত্যন্ত গ্রামের কাহিনি। একাধিক ট্রেন, বাস বদলে এক গ্রাম থেকে আরেক গ্রামে যেতে হয়। বিয়ের মৌসুম। একই ট্রেনে তিন জোড়া নবদম্পতি। সকল নববধূই লাল শাড়ি পরা এবং তাদের ঘোমটা টানা আধা হাত করে। রাতের বেলা তাড়াহুড়োতে দীপক আরেকজনের বউয়ের হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে যায়। তার নাম জয়া। জয়াই এই ছবির মূল চরিত্র। সে ধীরে ধীরে সকলের মন জয় করে নিতে থাকে। আর প্রশ্নবিদ্ধ করতে থাকে পুরুষতন্ত্রকে। তবে ছবিটিকে মাঝে মাঝে এনজিওর জন্য তৈরি করা প্রামাণ্যচিত্র বলে ভ্রম হয়েছে। কিরনের ‘ধোবিঘাট’ও কিন্তু টিফে প্রিমিয়ার হয়েছিল ২০১০ সালে। ‘ধোবিঘাটে’র কিরনকে ‘লস্ট লেডিসে’ ঠিক পাওয়া গেল না। 
 

অনেক ভারতীয় ছবিটি দেখতে এসেছেন। তবে শেতাঙ্গদের অনেকে ছবির মাঝখানেই চেয়ার ছেড়ে চলে গেছেন। টিপিকাল হিন্দি ছবি, মিউজিকাল রোম-কম, আবার সোশাল ম্যাসেজ দেয়ার চেষ্টা, এসব মনে হয় তাদের ভালো লাগেনি। আমি অবশ্য ছবিটি শেষ করেই উঠলাম। নিচে গিয়ে টিফের বইয়ের দোকানে কিছু সময় কাটালাম যথারীতি। জিওফ পিভেরের বই ‘টরোন্টো অন ফিল্ম’ কিনলাম। তারপরও হাতে যথেষ্ট সময় আছে। লাইটবক্স থেকে এবারে হাঁটতে হাঁটতে অ্যাডেলেইড স্ট্রিটের আর্টস্কেপ সাউন্ডবক্সে গেলাম। সেখানে প্রেস লাউঞ্জ। বসে বসে আগেরদিনের লেখার কিছু ত্রুটি মোচন করলাম। এরই ফাঁকে প্রিয়াংকার কল। কোথায় আছেন? চলুন একসাথে দুপুরের খাবার খাওয়া যাক। দেখলাম তখনো দুই ঘন্টা বাকি পরবর্তী স্ক্রিনিংয়ের। বেরিয়ে টিফের সামনে এসে দাঁড়ালাম। দেখি চমৎকার হাসি দিয়ে এগিয়ে আসছেন প্রিয়াংকা। চলুন তবে যাওয়া যাক। বাংলাদেশের চলচ্চিত্র সমাজ নিয়ে কথা বলতে বলতে এগুচ্ছি রেস্তোরাঁর দিকে। হঠাৎ দেখি চেনা চেনা লাগে এক ভদ্রলোক উল্টোদিক থেকে আসছেন। আরে এতো আনন্দ পটবর্ধন। ভারতীয় প্রামাণ্যচিত্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ আনন্দ। 

আমি এগিয়ে গিয়ে পরিচয় দিলাম। উনি বাংলাদেশের কথা শুনেই বললেন, তারেক মাসুদ উনার বেশ পরিচিত ছিলেন। বন্ধুত্ব ছিলো তাঁদের। বাংলাদেশে আনন্দ তিনবার গেছেন। শুধু তাই নয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে আনন্দ যুক্তরাষ্ট্রে লেখাপড়া করতেন, সেসময় সতীর্থদের কাছ থেকে একদিনের হাতখরচের টাকা তুলে তিনি বাংলাদেশী শরণার্থীদের দিয়েছিলেন। এই আয়োজনের ছবি তুলে রেখেছিলেন আনন্দ। যা পরে বাংলাদেশ সরকারকে দিয়েছিলেন। এসব তথ্য আমার জানা ছিলো। কিন্তু দেখা হওয়ার পর আনন্দ আবার বললেন। আর ঝোলা থেকে বের করে দিলেন একটি প্রচারপত্র, তাঁর নতুন ছবি, যেটি এবার টিফে দেখানো হবে: ‘দ্য ওয়ার্ল্ড ইজ ফ্যামিলি’। শুধু ছবি দেখানো নয়, টিফে একটি বিভাগ আছে ‘ভিশনারিজ’, সেখানেও তিনি কথা বলবেন। আমন্ত্রণ জানালে আমি বললাম, বাংলাদেশ থেকেই আমি ঠিক করে এসেছি স্ক্রিনিং ও আপনার কথোপকথন দুটি অনুষ্ঠানেই থাকব। অনেক খুশি হলেন। প্রিয়াংকা আমাদের দুজনের একটি ছবি তুলে দিলেন। এরপর বিদায় নিয়ে আমরা গেলাম এক সালাদ বারে। 
 

May be an image of 5 people and text
আনন্দ পটবর্ধনের সঙ্গে লেখক

ফিশ সালাদ খেতে খেতে বাংলাদেশের নতুন সিনেমার সম্ভাবনা, ভারতীয় স্বাধীন চলচ্চিত্রের চালচিত্রসহ নানাবিধ আলাপ করলাম। প্রিয়াংকা জানালেন টিফের চারতলায় একটি সমৃদ্ধ পাঠাগার আছে। ঠিক করলাম যাব সেখানে। ওখানে বসে বিনামূল্যে ধ্রুপদি সিনেমাও দেখা যায়। তোফা! এমন ব্যবস্থা এখনো বাংলাদেশে গড়ে ওঠেনি। একইরকম ব্যাপার আমি দেখেছিলাম ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটে। আক্ষেপ করতে করতে খাওয়া শেষ করলাম।
 

পরবর্তী লক্ষ্য ‘মানডুব’। সৌদি আরবের উনচল্লিশ বছরের পরিচালক আলি কালথামির প্রথম ছবি। প্রিয়াংকাকে বিদায় দিয়ে স্কশিয়াব্যাংক থিয়েটারের পথ ধরলাম। ধীরে ধীরে সিনেমা থ্রিতে পৌঁছে দেখি প্রচুর মানুষ। টিকিট কেটে দেখতে এসেছেন। ছবি শুরুর আগেই পরিচালক জানিয়ে দিলেন এটি ডার্ক কমেডি এবং রাতের এক অন্য রিয়াদ এতে দেখা যাবে। আমি অবশ্য বলতে চাই সৌদি-নোয়া, যেখানে ফাহাদ নামের এক ভাগ্যহত যুবক চাকরি হারিয়ে ডেলিভারিম্যানের কাজ করে। পরিবারে রয়েছে অসুস্থ বাবা, উদ্যোক্তা বোন ও আট-দশ বছরের এক ভাগ্নি। চাকরিস্থলে গণ্ডগোলের জেরে ফাহাদের নামে মামলা ঝুলছে। সেই মামলা ছুটাতে প্রচুর টাকা দরকার। কাজেই সে জড়িয়ে পড়ে ভুল চক্করে। এটি এক যুবকের ভুল সিদ্ধান্ত, দৈব অভিশাপ আর শহরের অন্ধকার, নিষ্ঠুর জগতে হারিয়ে যাওয়ার গল্প। ছবি শেষে অনেক অভিনন্দন পেলেন পরিচালক। 
 

‘মানডুব’ শব্দের অর্থ প্রতিনিধি বা প্রেরিত ব্যক্তি। ছবির ফাহাদ চরিত্রটি সৌদি আরবের দুর্দশাগ্রস্ত ও ভাগ্যবঞ্চিত যুবকদেরই প্রতিনিধিত্ব করছে। জনপ্রিয় সৌদি কমেডিয়ান মোহাম্মদ আলদোখি এই ছবির মূল চরিত্রে অভিনয় করেছেন। স্ক্রিনিং শেষে তিনিও কথা বলেন। ছবিটির একটি ফ্রেম দেখে আমার বেশ মজা লেগেছে। সেখানে এক ওষুধের দোকানে বাংলায় লেখা ছিল ‘ফার্মেসি’। ওটা পরিচালকের ইচ্ছাকৃত কিছু ছিলো না। তবে এই ফ্রেম আমাকে বাংলাদেশের সেসব অভাগা শ্রমিক যুবাদের কথাই মনে করিয়ে দিয়েছে, যারা শুধু বিদেশের মাটিতে চোখমুখ বুজে শ্রমটাই বেঁচে গেলেন।
 

ছবি শেষ করে সোজা সেন্ট এনড্রু স্টেশন। এবার ঠিক উল্টো পথ। নর্থবাউন্ড ও ইস্টবাউন্ড রেলে চেপে বাসস্টেশন, সেখান থেকে বাড়ি। সন্ধ্যায় কানাডা প্রবাসী চয়ন ভাইয়ের বাসায় দাওয়াত। বাঙালি আতিথেয়তা তো গোটা দুনিয়ায় প্রসিদ্ধ। কাজেই সেটা তুষ্ট মনে গ্রহণ করে যখন বাসায় ফিরছি, তখন ঘড়িতে রাত এগারোটা বেজে গেছে।  
 

Link copied!