শুধু বাংলা নয়, পুরো ভারতবর্ষেরই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র কোনটি জানতে চাইলে, আমি নিশ্চিত তোমরা প্রায় সক্কলেই সত্যজিৎ রায়ের ‘পথের পাঁচালী’ ছবিটির নাম করবে। কিন্তু এই সিনেমাটি বানাতে গিয়ে সত্যজিৎকে কী পরিমাণ ঝক্কি পোহাতে হয়েছিল সেটা আমাদের অনেকেরই জানা নেই। আজ আমি তোমাদেরকে সেই গল্পটা শোনাব বলেই তো কিবোর্ড আর মাউস ধরেছি! সেইসঙ্গে এই ছবির নির্মাণের প্রক্রিয়া, মুক্তি পাওয়ার কাহিনি, মুক্তির পর দর্শক, সমালোচকদের প্রতিক্রিয়া ইত্যাদি আরও অনেক গল্পের বুড়িকেও ছুঁয়ে যাওয়া হবে নিশ্চয়ই।
প্রথমেই বলে নেওয়া যাক এই ছবিটি বানানোর একেবারে গোড়ার গল্পটি। সত্যজিৎ রায় তখন কাজ করতেন কলকাতার নামকরা একটি বিজ্ঞাপনী সংস্থা ডি. জে. কিমারে। পাশাপাশি নতুন চালু হওয়া সিগনেট প্রেসের বইয়ের প্রচ্ছদ আঁকা ও অলংকরণের কাজও করতেন। সেইসময়ই তাঁর হাতে আসে প্রখ্যাত লেখক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পথের পাঁচালী’ বইটির ছোটদের সংস্করণ ‘আম-আঁটির ভেঁপু’র প্রচ্ছদ আর ছবি আঁকার কাজ। তখন বইটি পড়ে তিনি রীতিমতো মুগ্ধ হন।তাঁর মাথায় ততদিনে সিনেমার পোকা ভালোমতোই বাসা বেঁধেছে।বন্ধু চিদানন্দ দাশগুপ্তর সঙ্গে ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি প্রতিষ্ঠার আলাপ আলোচনা চলছে।তিনি বইটি দ্বারা ভীষণভাবে প্রভাবিত হলেন এবং ভাবলেন কোনো একদিন এই গল্পটি নিয়ে একটি সিনেমা বানাবেন। ভারত স্বাধীন হবার পর ১৯৪৯ সালে প্রখ্যাত ফরাসি চলচ্চিত্র পরিচালক জঁ রনোয়া দ্য রিভার ছবিটির শুটিং করতে আসেন। তখন তাঁর সঙ্গে সত্যজিতের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হলে তাঁকেও তিনি তাঁর এই্ ইচ্ছের কথা বলেন এবং রনোয়া তাঁকে উৎসাহ দেন।
এর পরের বছর ডি. জে. কিমার তাঁকে একটা প্রশিক্ষণের জন্য বিলেত পাঠায়। সেখানে তিনি পেশাগত প্রশিক্ষণের ফাঁকে ফাঁকে চুটিয়ে দেশবিদেশের বড়বড় পরিচালকদের বানানো ছবি দেখতে থাকেন।তাঁর কথা অনুযায়ী, তিনি অল্প কদিনের মধ্যেই প্রায় শখানেক সিনেমা দেখে ফেলেন। এর মধ্যে ইতালীয় পরিচালক বিত্তোরিও দি সিকার একটি সিনেমা বাইসাইকেল থিভস দেখে খুবই আলোড়িত হন তিনি এবং মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেন যে, দেশে ফিরে গিয়েই তিনি ছবি বানানোতে হাত দেবেন এবং সেটা ঐ আম-আঁটির ভেঁপুর গল্পটা নিয়েই। আসলে এতদিন তাঁর মনে একটা ভয় ছিল নামিদামি অভিনেতাদের নিয়ে ঝকঝকে সেট বানিয়ে ছবি নির্মাণ করতে গেলে যে বিশাল টাকার দরকার সেটা তিনি যোগাড় করবেন কীভাবে। কিন্তু এই বাইসাইকেল থিভস ছবিটা ছিল ইতালীয় সিনেমার একটা নতুন ধারার ছবি, যাকে তারা বলে নিউ রিয়েলিজম বা নব্য বাস্তববাদ, সেই ঘরানার ছবি, যেখানে পেশাদার অভিনেতাদের বদলে সাধারণ মানুষদের দিয়ে অভিনয় করানো হয় এবং কৃত্রিম সেটের বদলে যেকোনো জায়গাতেই তার শুটিং চলতে পারে।এত করে যে নতুন ও বিশ্বাসযোগ্য এক বাস্তবতার জন্ম হয় তাকেই তাঁরা নাম দেন নিউ রিয়েলিজম বলে। রায়ের খুব মনে ধরে চলচ্চিত্রের এই নতুন ধারণাটি এবং তিনিও সিদ্ধান্ত নেন তাঁর প্রথম ছবিটি এই প্রক্রিয়াতেই নির্মাণ করবেন তিনি। জাহাজে করে দেশে ফেরার পথেই তিনি ছবিটির প্রাথমিক পরিকল্পনা, নকশা, প্রয়োজনীয় আঁকাআঁকির কাজটুকু সেরে ফেলেন এবং সঙ্গে থাকা নবপরিণীতা বধূ বিজয়া রায়কেও তাঁর মনের কথা খুলে বলেন।
দেশে ফিরে তাঁর প্রথম কাজ হয় ছবির একজন প্রযোজক যোগাড় করা এবং চরিত্র, কুশীলব, লোকেশন ইত্যাদি ঠিক করা। তাঁর ছবির গল্প, বিষয়ভাবনার কথা শুনে, বিশেষ করে তাতে কোনো তারকা নায়ক নায়িকা নেই জেনে কোনো প্রতিষ্ঠিত প্রযোজকই তেমন আগ্রহ দেখাননি।শুধু একজন শুরুতে অল্প কিছুদিনের জন্য কিছু অর্থের যোগান দিলেও একসময় তিনিও পিছু হটেন।তখন রায় নিজেই তাঁর যাবতীয় সঞ্চয় ভেঙে, বেশ কিছু ধারদেনা করে, তাঁর জীবনবীমার কাগজ, স্ত্রীর গয়না বন্ধক রেখে এবং এমনকি তাঁর ভীষণ প্রিয় গানের রেকর্ডগুলো বিক্রি করে পাওয়া টাকা দিয়ে শুটিং চালু রাখেন, যাতে করে সেই কাজটুকু দেখিয়ে অন্তত বড় কোনো প্রযোজককে রাজি করাতে পারেন।কিন্তু এতেও শেষ রক্ষা হলো না; ছবির শুটিং একটা সময় পুরোপুরিই বন্ধ হয়ে যায়।এবং সেটা বন্ধ থাকে প্রায় একটি বছর। এইসময় অন্য অনেক দুশ্চিন্তার পাশাপাশি সত্যজিৎ রায়ের মনে বিশেষ উদ্বেগের বিষয় ছিল তিনটি : যদি এর মধ্যে বয়োবৃদ্ধা ইন্দির ঠাকরুন মারা যান; কিশোর অপু তথা সুবীরের গলার স্বর ভেঙে যায় কিংবা দুর্গারূপী উমা মেয়েটি দুম করে বড়ই হয়ে যায়! ভাগ্য ভালো সেসবের কিছুই হয়নি, কেননা ছবির অর্থায়নের জন্য তাঁকে এক বছরের বেশি অপেক্ষা করতে হয়নি।
পথের পাঁচালী ছবির একটি দৃশ্য।
সেই গল্পটাও বেশ মজার। সত্যজিতের মায়ের এক বান্ধবীর সঙ্গে তৎকালীন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী বিধানচন্দ্র রায়ের সঙ্গে ভালো জানাশোনা ছিল। তিনি তাঁকে অনুরোধ করেন সত্যজিতের সাহায্যার্থে এগিয়ে আসতে। তাঁর অনুরোধে বিধান রায়ের দপ্তরের হর্তাকর্তারা সিনেমাটির যেটুকু অংশের শুটিং শেষ হয়েছিল সেটুকু দেখেন এবং তাঁকে ছবি শেষ করার জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ ঋণ হিসেবে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন।তবে তাঁরা ছবির গল্প, বক্তব্য ইত্যাদি ঠিকঠাক বুঝে উঠতে না পেরে, ছবির নাম ‘পথের পাঁচালী’ দেখে অনুমান করেন সেটি হয়তো রাস্তাঘাটের উন্নয়ন বিষয়ক কোনো প্রামাণ্যচিত্র হবে। তাই টাকাটা তাঁরা বরাদ্দ করেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের সড়ক উন্নয়ন বিভাগ থেকে!সে যা-ই হোক,টাকা হাতে পেয়ে নতুন উদ্যমে জোরেসোরে শুটিং শুরু করলেন সত্যজিৎ। শুটিং হয়েছিল কলকাতার কাছেই বড়াল নামে একটি গ্রামে। আর তিনি বেশ একটু ঝুঁকি নিয়েই তাঁর ছবির ক্যামেরাম্যান হিসেবে নিয়েছিলেন একেবারেই অনভিজ্ঞ একুশ বছরের তরুণ সুব্রত মিত্রকে, শিল্পনির্দেশক ও সম্পাদক হিসেবে বংশীচন্দ্র গুপ্ত ও দুলাল দত্তকে। সংগীত পরিচালনার জন্য ডেকে এনেছিলেন আরেক তরুণ রবিশঙ্করকে, যিনি পরবর্তীকালে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সময় নিউ ইয়র্কের ম্যাডিসন স্কয়ার গার্ডেনে কনসার্ট ফর বাংলাদেশ অনুষ্ঠান আয়োজনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবেন।অভিনেতা, অভিনেত্রী হিসেবেও মূলত পেশাদার কুশীলবদেরকেই বেছেছিলেন তিনি, নিউ রিয়েলিজম চলচ্চিত্রের যা অন্যতম প্রধান পূর্বশর্ত। বলাই বাহুল্য,এরা সবাই তাঁর বিশ্বাস ও আস্থার প্রতিদান দিয়েছিলেন ষোলো আনা।
১৯৫৪ সালে কী একটা কাজে কলকাতায় এসেছিলেন নিউ ইয়র্কের মিউজিয়াম অভ মডার্ন অর্ট, সংক্ষেপে মোমা`র চলচ্চিত্র বিভাগের বড়কর্তা মনরো হুইলার। তিনি কার কাছ থেকে যেন সত্যজিৎ রায়ের এই অসমাপ্ত ছবিটির কথা শুনে, রায়ের সঙ্গে সাক্ষাতের ও সেটি দেখার আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাঁর কাছে সত্যজিৎ রায়ের কাজটুকু অসাধারণ লেগেছিল এবং তিনি সেটি দ্রুত শেষ করার পরামর্শ দেন তাঁকে, যাতে করে তিনি এর পরের বছর তাঁর মিউজিয়ামের বিশেষ চলচ্চিত্র উৎসবে ছবিটি দেখাতে পারেন।কিন্তু অর্থাভাব তো রায়ের পিছু ছাড়ছিল না, ফলে ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও তিনি ছবির কাজ দ্রুত এগিয়ে নিতে পারছিলেন না। এমন সময় আমেরিকার আরেকজন বড় পরিচালক জন হিউস্টন কলকাতায় আসেন তাঁর একটা ছবির শুটিং করতে। হুইলার তাঁকে রায়ের এই ছবিটির কথা বলে দিয়েছিলেন। তিনি সেটি দেখেন এবং উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন। তাঁর এই প্রশংসায় আশ্বস্ত হয়ে মনরো হুইলার রায়ের জন্য মিউজিয়াম থেকে কিছু অর্থ বরাদ্দ করেন, যা দিয়ে তিনি ছবিটি অবশেষে শেষ করতে সক্ষম হন। মনরো তাঁর কথা রেখেছিলেন। তিনি এর পরের বছর মে মাসে, রায়ের জন্মদিনের পরেরদিনই ছবিটি তাঁর মিউজিয়ামের উৎসবে দেখান। তারপর বাকিটা ইতিহাস! সেখানে বিপুলভাবে প্রশংসিত হয় রায়ের জীবনের প্রথম ছবি ‘পথের পাঁচালী’। পরের বছর স্বদেশে মুক্তি পাওয়ার পর প্রথমে কিছুটা দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও দর্শক দ্রুতই সাড়া দেন। শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসাবে ভারতের জাতীয় পুরস্কার পায় এটি সেবছর। সেই বছরই প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর ব্যক্তিগত উদ্যোগে ছবিটিকে ফ্রান্সের বিশ্বখ্যাত কান চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হয়। সেখানে উৎসবের সমাপনী চলচ্চিত্র হিসেবে সেটি প্রদর্শিত হয় এবং সর্বস্তরের দর্শকদের ভূয়সী প্রশংসালাভের পাশাপাশি সেটি শ্রেষ্ঠ মানবিক দলিল হিসেবে উৎসব কমিটি কর্তৃক পুরস্কৃতও হয়। এর পরের বছর এটি বিলেতে মুক্তি পায়, আর তার পরের বছর খোদ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, যেখানে নিউ ইয়র্কের একটি সিনেমা হলে এটি টানা আট মাস ধরে চলে, যা কোনো বিদেশি ছবির ক্ষেত্রে অবিশ্বাস্য ও দুর্লভ একটি ঘটনা।
শেষ করার আগে বলি, তোমরা জেনে খুশি হবে সত্যজিৎ রায়ের জীবনের এই প্রথম ছবিটি সারা পৃথিবীর প্রায় কুড়িটি মর্যাদাবান আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবের পুরস্কারে ভূষিত হয়েছে। সর্বকালের সেরা চলচ্চিত্রগুলোর মধ্যেও এটির নাম প্রায়শই উচ্চারিত হয়ে থাকে। এই ২০১৫ সালেও বিবিসির একটি জরিপে এটি পৃথিবীর সেরা একশটি ছবির তালিকায় পনেরো নম্বরে ছিল। তাছাড়া,পৃথিবীর অনেক বড় বড় ফিল্ম ইনস্টিটিউটে ‘পথের পাঁচালী’ আজ চলচ্চিত্র শিক্ষার্থীদের পাঠ্য। এরকম একটি পৃথিবীবিখ্যাত সিনেমার বীজ সত্যজিতের মনে প্রথম রোপিত হয়েছিল কিশোরদের জন্য লেখা একটি বই পড়তে গিয়ে, ব্যাপারটা খুব মজার, তাই না? তা, সিনেমাটা কি তোমাদের সবার দেখা হয়েছে এর মধ্যে? নাহলে আর দেরি কোরো না কিন্তু বন্ধুরা।