• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

সোমেন চন্দ : প্রসঙ্গে ফেরা


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: মার্চ ৮, ২০২৪, ১০:০০ এএম
সোমেন চন্দ : প্রসঙ্গে ফেরা
সোমেন চন্দ। ছবি : সংগৃহীত

এক। 
কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘিরে ধরা লোকগুলোর মধ্যে একজন তার পেটে ছুরিটা গেঁথে দিল। আকস্মিক আক্রমণে রক্তাক্ত সোমেন চন্দ মাটিতে লুটিয়ে পড়লেন। এবার মাথায় পড়ল লোহার রডের বাড়ি। ভোজালি (এক রকম বড় ছোরা বা ছোট তলোয়ার) ফ্যালাফ্যালা করে দিল পেট। রক্তের স্রোতের সঙ্গে বেড়িয়ে এল নাড়িভুঁড়ি। সোমেনের সঙ্গে যে রেল শ্রমিকদের মিছিলটা ছিল, সেটি তখন বিশৃঙ্খল। এরই মধ্যে শাবল দিয়ে তার দু’চোখ খুবলে নিল, জিভটা টেনে বের করে কেটে ফেলল একদল ফ্যাসিস্ট দূর্বৃত্ত।

৮ মার্চ ১৯৪২ সেদিন। 

এর কিছুদিন আগে ঢাকায় একটা প্রদর্শনী হয়েছিল। রাশিয়ার নতুন সমাজ ও সভ্যতার অগ্রগতি বাংলার মানুষকে দেখানোর উদ্যোগ নিয়েছে ‘সোভিয়েত সুহৃদ সমিতি’র ঢাকা শাখা। উদ্বোধন করলেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্। উদ্বোধনী বক্তৃতা দিলেন গোপাল হালদার। 

আয়োজনটিকে সফল করার আহ্বান জানিয়েছিলেন বিজ্ঞানী সত্যেন্দ্রনাথ বসু, কবি জসীম উদ্দিন। হিটলারের নাৎসি বাহিনীর হাতে আক্রান্ত সোভিয়েত রাশিয়ার পাশে দাঁড়িয়েছিল এই সমিতি।

ফ্যাসিবাদবিরোধী সেই ‘সোভিয়েত মেলা’র অন্যতম উদ্যমী কর্মী ছিলেন সোমেন চন্দ। প্রদর্শনী নিয়ে তার সে কী উৎসাহ! দর্শকদের বুঝিয়ে দিচ্ছেন সব, তাদের কৌতূহল মিটিয়ে দিচ্ছেন বিনয়ী যত্নে।

দুই। 
সোমেনের বয়স তখন একুশ। এই বয়সে ঢাকার রেলওয়ে ইউনিয়নের সম্পাদক হয়েছেন। শ্রমিকদের নয়নের মণি তিনি। আবার সাম্যবাদী রাজনীতিতে সার্বক্ষণিক জড়িয়ে থাকার পরেও লিখে চলেছেন ‘ইঁদুর’, ‘দাঙ্গা’, ‘সংকেত’-এর মতো গল্প, ‘বন্যা’-র মতো উপন্যাস। ঢাকা রেডিও স্টেশন থেকে ‘কথিকা’ পাঠেরও ডাক পেয়েছেন একাধিকবার। 

সোমেনের ভাই কল্যাণ চন্দ লিখেছেন, “তখন সবে ঢাকা রেডিও স্টেশন চালু হয়েছে। দাদা রচনা পাঠের সুযোগ পেলেন।… মনে আছে, একবার আমাদের সমস্ত পরিবার, বুড়িগঙ্গার তীরে, করোনেশন পার্কে সরকারি রেডিওতে, দাদার ‘মৌমাছি’ নিয়ে কথিকা শুনতে যাই। পুলিশি রিপোর্টের জন্য দাদার রেডিওতে পাঠ বন্ধ হয়ে যায়।” 

সোমেন আকারে বেঁটেখাটো। গায়ের রং বেশ ফর্সা, মাথাটা দেহের তুলনায় সামান্য বড়। বলিষ্ঠ গড়ন, স্বপ্নবাজ চোখ। চোয়ালটা একটু উঁচু, দাড়ি-গোঁফ তখনো ভাল করে ওঠেনি। ডাক্তারি পড়তে শুরু করেছিলেন, অসুস্থতার কারণে সেই পাঠে ইতি টানতে হয়েছে তাকে। 

‘শিল্পের জন্য শিল্প’ কথাটিকে মোটেই পছন্দ করতেন না সোমেন। মৃত্যুর কয়েক মাস আগে বন্ধু অমৃতকুমার দত্তকে লেখা চিঠিতেও পাওয়া যায় তার আদর্শিক মূল্যবোধ। চিঠিতে সোমেন লিখেছেন,“গত কয়েকদিন রেল-শ্রমিকদের নিয়ে বেশ ঝামেলায় ছিলাম। লেখার জন্য একটুও সময় পাই না। তবু লিখতে হবে, মেহনতী মানুষের জন্য, সর্বহারা মানুষের জন্য আমাদের লিখতে হবে।… র‌্যালফ ফক্সের বই পড়ে আমি অন্তরে অনুপ্রেরণা পাচ্ছি। কডওয়েলের বইটিও আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে। এ না হলে কি মহৎ সাহিত্যিক হওয়া যায়? স্পেনের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের সমর্থনে তাদের আত্মবিসর্জন ইতিহাসে উজ্জ্বল হয়ে থাকবে।”

সোমেন চন্দ বলতেন, “বিপ্লবের জন্য একজন লেখক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। আমাদের সেভাবে প্রস্তুত হতে হবে। গোর্কির কথাই চিন্তা কর। শৌখিন সাহিত্য করার আর সময় নেই।”  সোমেন মার্কসবাদী রাজনীতি ও সাহিত্য আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হন। বাংলা সাহিত্যে প্রথম গণসাহিত্যের ওপর কাজ করেন তিনি।

তিন। 
ঢাকার সুত্রাপুর বাজারের কাছে সেবাশ্রমের মাঠে ‘ঢাকা জেলা ফ্যাসিস্টবিরোধী সম্মেলনে কলকাতা থেকে যোগ দিয়েছিলেন বঙ্কিম মুখোপাধ্যায়, স্নেহাংশু আচার্য, জ্যোতি বসু। সম্মেলনের দিনেই সোমেনের বড় মাসিমার বড় মেয়ে লিলির বিয়ে ছিল নারায়ণগঞ্জের কাছে ধামগড়ে। সভা ফেলে সোমেন বিয়েবাড়ি যাবেন না, বাড়ির অন্যেরা তাই চলে গেলেন। সকাল ১১টার দিকে সোমেন গেলেন একরামপুরের কলুটোলায়, প্রিয় বন্ধু অমৃত দত্তের বাড়ি। দলের সহকর্মী অমৃত বাড়িতে ছিলেন না। তিনি তখন সভার মঞ্চ-তদারকিতে ব্যস্ত। বন্ধুকে না পেয়ে সোমেন ফিরে আসবেন, অমৃতের মা ভাত খাইয়ে দিলেন। অমৃত দত্ত পরে লিখেছেন, “মা ওকে জোর করেই খাইয়ে দেন। এরপর সম্মেলনে রেলওয়ে শ্রমিকদের শোভাযাত্রা নিয়ে আসতে হবে বলে আমার জন্য অপেক্ষা না করে ও রেলওয়ে কোয়ার্টারের উদ্দেশ্যে চলে যায়।”

বেলা আড়াইটার সময় দলীয় পতাকা হাতে নিয়ে সোমেন চন্দ রেল শ্রমিকদের আর একটি মিছিল নিয়ে রেলওয়ে কলোনি থেকে রওনা দিলেন। তিনটা নাগাদ মিছিল নারিন্দাপুল পার হয়ে একরামপুর কলতাবাজারে ঢোকার মুখে ডান দিকের রাস্তা ধরল। সেখানকার মোড় পেরিয়ে হৃষিকেশ দাস রোড হয়ে লক্ষ্মীবাজারের কাছে বটগাছের কাছাকাছি এসে পৌঁছতেই ঝাঁপিয়ে পড়ল ফ্যাসিস্ট সশস্ত্র দুষ্কৃতির দল। জায়গাটা এখন ৩৪নং রেবতিমোহন দাস রোড। 

শিক্ষক পূর্ণচন্দ্র দাস তার বাড়ির জানালা দিয়ে এই হত্যার দৃশ্য নিজের চোখে দেখেছেন, “আমার বাড়ির জানালা দিয়ে কী বর্বরের মতো তাঁকে হত্যা করা হয় তা আমি নিজের চক্ষে দেখেছি।… সে দৃশ্য ভোলার নয়। এমন মর্মান্তিক হত্যা সহ্যের অতীত। এক ফোঁটা জল তার মৃত্যুর সময় দিতে কেউ এগিয়ে যায়নি।”

মিডফোর্ড হাসপাতালে (স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে) পোস্টমর্টেম হয়েছিল সোমেনের। মর্গের বারান্দায় রাখা ছিল তার মৃতদেহ। সরলানন্দ সেন লিখেছেন, “সোমেনকে শেষ দেখিয়াছিলাম শব-পরীক্ষাগারে। পুরানো কোঠাটি রক্তে ভরিয়া গিয়াছে; রক্ত আসিয়া জমিয়াছে বাইরের সিঁড়ির উপর।” 
একুশ বছর নয় মাস পনের দিনের অতি সংক্ষিপ্ত জীবনের সোমেন চন্দকে পরের দিন বানিয়ানগর কালিমন্দির সংলগ্ন রাস্তার শ্মশানে দাহ করা হয়। জ্যোতি বসুরা ছিলেন শ্মশানে। শবযাত্রীদের মধ্যে কোনো একজন ছুরির ফলা দিয়ে দেয়ালে খোদাই করে দিয়েছিলেন নিজেদের ক্ষোভকে—‘সোমেন চন্দ : আমাদের প্রিয় সংগ্রামী লেখক।’

চার। 
১৯২০ সালের ২৪ মে ঢাকার পার্শ্ববর্তী বুড়িগঙ্গার পশ্চিম পারে শুভাড্ডা ইউনিয়নের তেঘরিয়া গ্রামে সোমেন চন্দের জন্ম, মামার বাড়িতে (নরসিংদী জেলার আশুলিয়া গ্রামে)। তবে বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত সোমেন চন্দ জীবনী গ্রন্থমালা-এ হায়াৎ মামুদ লিখেছেন, “সোমেন চন্দের জন্ম কেরানীগঞ্জ থানার অধীনস্থ পারজুয়ার এলাকায় অবস্থিত ধিতপুর গ্রামে।” তার বাবার নাম নরেন্দ্রকুমার চন্দের আদিনিবাস ছিল তৎকালীন ঢাকার অন্তর্ভুক্ত নরসিংদী জেলার বালিয়া গ্রামে। ব্রিটিশশাসিত ভারতে কৃষক-শ্রমিক, মেহনতি মানুষের ওপর প্রবল আঘাত-নির্যাতন-নিপীড়নের পটভূমিতে তৈরি আবহাওয়ায় মানুষ নরেন্দ্র চন্দ আদর্শবান মানুষ ছিলেন। বাবার আদর্শ সোমেনের ভেতরে ছোটবেলা থেকেই গড়ে ওঠে।

ছোটকাল থেকে বইয়ের প্রতি আগ্রহ থেকেই সোমেন পাঠাগারমুখী হন। ঢাকার জোড়পুল লেনের প্রগতি পাঠাগার ছিল সাম্যবাদে বিশ্বাসী মানুষদের পরিচালিত। পাঠাগারে পড়তে পড়তে সোমেন বাংলা সাহিত্যে আগ্রহী হয়ে ওঠেন এবং অনুরক্ত হয়ে পড়েন কার্ল মার্কসের তত্ত্বে। ১৯৩৭ সালে সোমেন প্রত্যক্ষভাবে নিষিদ্ধ ঘোষিত কমিউনিস্ট পার্টির কমিউনিস্ট পাঠচক্রে যোগ দিয়ে মার্কসবাদী তত্ত্বে মানব মুক্তির সূত্র খুঁজে পান সোমেন। ওই সময় তিনি কমিউনিস্ট পাঠচক্রের সহযোগী প্রগতি পাঠাগারের পরিচালকের দায়িত্ব নেন। এ সময় তিনি আন্দামান-ফেরত কিংবদন্তী বিপ্লবী সতীশ পাকরাশীর মতো আজীবন বিপ্লবী শিক্ষকের রাজনীতি ও দর্শনের পাঠ নেন। অগ্নিযুগের কথা বইতে স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে তিনি লিখেছেন, “১৯৩৯ সালের মাঝামাঝি সোমেন তার দক্ষিণ মৈশুণ্ডী পাড়ায় আমাদের কমিউনিস্ট পাঠচক্রে যোগ দেয়। গোপনে ক্লাস হতো। সে সমস্ত মন-প্রাণ দিয়ে শুনত বেশি, প্রশ্ন করত না।” 

রণেশ দাশগুপ্তের সান্নিধ্যে থেকে বঙ্কিম, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র, বিভূতিভূষণ, ম্যাক্সিম গোর্কি, মোপাঁসা, রঁলা, বারবুস, জিদ, মারলোসহ আরও অনেকের লেখা পড়েন। জ্ঞান চক্রবর্তীর মতে, “কেবল কলম নিয়ে বসে থাকাকে তিনি দায়িত্ব এড়ানোই মনে করতেন।”

পাঁচ।
স্কুলে পড়াকাল থেকেই গল্প লিখতেন সোমেন। তখন তার প্রকাশিত লেখা বা লেখালেখির কথা পরিবারের কেউ জানত না। ১৯৩৭ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে সাপ্তাহিক দেশ পত্রিকায় প্রকাশিত হয় সোমেনের প্রথম গল্প ‘শিশু তপন’। এরপর আরও উল্লেখযোগ্য কিছু লেখা বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় ওই বছরেই দেখা যায়। বাংলাদেশে বন্যার যে প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও দুর্ভোগ, তা নিয়ে সম্ভবত বাংলা সাহিত্যে প্রথম উপন্যাস ‘বন্যা’ লেখেন সোমেন। তার প্রথম উপন্যাস প্রকাশিত হয় নবশক্তি পত্রিকায়।

নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারে জন্ম নেওয়া সোমেন পরিবর্তনে বিশ্বাসী ছিলেন। তিনি বিশ্বাস করতেন বিপ্লবে। রাজনীতির কলুষ বিবর্জিত দরুন শিল্পের হঠকারিতা তার মধ্যে ছিল না। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রার অনুষজ্ঞ হিশেবে রাজনীতি চলে আসে তার লেখায়। প্রাত্যহিক সাংসারিক কাজের মধ্যে তিনি সহজ-সরলভাবে দেখিয়ে দেন শাসনযন্ত্রের কূপমণ্ডুকতা, সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ছড়িয়ে থাকা ক্ষমতালিপ্সু সুক্ষ্ম জাল। চেতনাকে এক ধাক্কা দিয়ে জাগিয়ে দেয় তার সরল শব্দগুলো—ভাবতে বাধ্য করে।

আত্মপরিচয়ের অনুসন্ধান প্রয়াসে অনুপ্রাণিত করে। ইতিহাসের সবচেয়ে ঘটনাবহুল—ব্রিটিশ উপনিবেশের বিদায়কালে সোমেন আঞ্চলিক সমস্যা যে আন্তর্জাতিক রাজনীতির সমীকরণের একটি উপাত্ত, তা নির্দ্বিধায় বলা যায়। আর তাইতো ‘একটি রাত’ গল্পের সনাতনী মা ছেলের রাজনৈতিক মতাদর্শ বুঝে নিতে বই খুলে বসেন। ১৯৪১ সালের দাঙ্গাকে কেন্দ্র করে সোমেন গল্প লেখেন ‘দাঙ্গা’। এ গল্পে দুই ভাইয়ের আদর্শগত বিরোধের মধ্য দিয়ে রূপক আকারে বেরিয়ে আসে উপনিবেশবাদের শেষ ছোবল জাতিগত বিভেদের ভয়াবহ চেহারাটি। ‘ইঁদুর’ গল্পের ইঁদুরগুলো যেন দারিদ্রেরই প্রতিঘাতের রূপ, যা ক্রমাগত শ্রেণিস্বাতন্ত্র্য টিকিয়ে রাখার লড়াইরত নিম্ন মধ্যবিত্তদের একদণ্ড শান্তিতে থাকতে দেয় না। ‘ইঁদুর’ গল্পটি অনূদিত হয় বিভিন্ন ভাষায়। সোমেন চন্দের ‘ইঁদুর’ ও ‘বনস্পতি’ গল্পের কথা বারবার উল্লেখ করেন হাসান আজিজুল হক, শওকত আলী, আহমদ ছফা। 

ইঁদুর প্রসঙ্গে হুমায়ূন আহমেদ বলেন, “সোমেন চন্দের লেখা অসাধারণ ছোটগল্প ‘ইঁদুর’ পড়ার পর নিম্ন মধ্যবিত্তদের নিয়ে গল্প লেখার একটা সুতীব্র ইচ্ছা হয়। ‘নন্দিত নরকে’, ‘শঙ্খনীল কারাগার’ ও ‘মনসুবিজন’ নামে তিনটি আলাদা গল্প প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই লিখে ফেলি।”

ছয়। 

ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে লড়তে গিয়ে সোমেন চন্দকে খুন হতে হয়েছিল। অনেকের মতে এই মৃত্যুই ভারতে ফ্যাসিবাদবিরোধীর প্রথম শহীদ লেখক। সতীশ পাকড়াশি লিখেছেন, ‘‘প্রতিক্রিয়াশীল বর্বর ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে প্রগতিশীল উন্নত গণতন্ত্রবাদের সংগ্রামে তরুণ বিপ্লবী সাহিত্যিক সোমেন চন্দই এদেশে প্রথম জীবন উৎসর্গ করল।’’ 

সোমেন চন্দ নৃশংসভাবে নিহত হওয়ার পরে ‘পরিচয়’ পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৯৪ সংখ্যার সম্পাদকীয়তে লেখা হয় , “লক্ষ লক্ষ লোকের মৃত্যুর পটভূমিকায় একটি মাত্র লোকের মৃত্যু তুচ্ছ ব্যাপার মনে হওয়া স্বাভাবিক। কিন্তু বিশেষ পরিবেশে একজনের মৃত্যু বহু মৃত্যুর চাইতে বেশি অর্থবহ হতে পারে। সোমেন চন্দের মৃত্যু এই জাতীয়। সোমেনের বয়স বেশি হয় নি, কিন্তু এই অল্প বয়সেই মূল্যবান কাজ করে সে তার তরুণ জীবনকে বিশ্বসম্পদে ঐশ্বর্যবান করেছিল। এই সংখ্যার গত সংখ্যায় ‘ইঁদুর’ নামে যে গল্পটি প্রকাশিত হয়, তাতে তার জীবনের একটিমাত্র দিকের পরিচয় পাওয়া যায়। এই পরিচয় আমাদের আশ্চর্য করে দেয়, কিন্তু এই তার পুরো পরিচয় নয়। সাহিত্যের ক্ষেত্রে তার কৃতিত্ব জীবনের বিস্তৃততর ক্ষেত্রে তার অন্তরঙ্গ অভিজ্ঞতার প্রতিভাস মাত্র। তাকে প্রাণ দিতে হলো বর্বরতার যূপকাষ্ঠে।”

আমাদের বিপ্লবী চিন্তাধারায় সোমেনের দৃষ্টিভঙ্গিকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সমাজতান্ত্রিক বিপ্লবী লালঝাণ্ডায় তার আদর্শকে, তার প্রাসঙ্গিকতাকে ফেরাতে হবে। যদিও সোমেন এখন অনেক বেশি প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠছে। অনেক বেশি জাগ্রত। মানুষের দৈনন্দিন জীবনে, প্রতিবাদে, সংগ্রামে সোমেন রক্তধারার মতো মিশে আছেন। মানুষের জাগরণে অনুপ্রেরণা হয়ে, প্রণোদনা হয়ে প্রতিদিনের সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে চলছেন। যখনই শ্রমজীবী নিপীড়িত মানুষের আলোচনা সামনে আসে, উগ্র সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদ মাথা চাড়া দেয় তখনই সোমেন চন্দের আদর্শ সমুজ্জ্বল হয়ে ওঠে। এটা বিশ্বাস করতে পারি, তাকে নিয়ে লেখা একটি উপযুক্ত শোকগাথায় অবশ্যই তার হত্যার বিরুদ্ধে কেবল উচ্চকিত আমাদের শাণিত প্রতিবাদই নয়, একই সঙ্গে তার জীবনের বেদনাদায়ক উপাখ্যান প্রতিধ্বনিত হবে পরম শ্রদ্ধায়। আমি সেই অলখের শব্দের দিকে তাকিয়ে দেখব, যতক্ষণ না তা আমাদের হৃদয় ও আমাদের রক্তের শিরায় সঞ্চারিত হয়। তাকে ভালোভাবে বুঝতে হলে তার লেখার প্রতি আমাদের জানতে হবে। তাকে পাঠ করতে হবে। অধ্যয়ন করতে হবে তার জীবনসমগ্রতা। তার প্রাণবান সংগ্রামী আদর্শ গণমানুষের হৃদয় দুয়ারে পৌঁছে দেওয়া সময়ের জোরালো দাবি। সেই গণদাবির প্রেক্ষাপটেই তিনি আলোচিত হচ্ছেন।
 

Link copied!