• ঢাকা
  • বৃহস্পতিবার, ২১ নভেম্বর, ২০২৪, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

শামসুর রাহমান : কাব্যে যার বিনিদ্র সমকাল


হাবীব ইমন
প্রকাশিত: আগস্ট ১৭, ২০২৩, ০৮:৪৩ এএম
শামসুর রাহমান : কাব্যে যার বিনিদ্র সমকাল
কবি শামসুর রাহমান (ছবি : সংগৃহীত)

১৯৯৬ সালে প্রকাশিত হয় প্রথাবিরুদ্ধ লেখক হুমায়ুন আজাদের ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’। এ গ্রন্থে তিনি লিখেছিলেন—‘শামসুর রাহমান বাহ্যজগৎ ও সমকাল ও অব্যবহিত প্রতিবেশকে শুষে নেন আপন অভ্যন্তরে, এবং তাঁর কবিতা ধ্যান বা স্তব বা গান বা শাশ্বত শ্লোকের বদলে হয়ে ওঠে সমকালীন জীবনসৃষ্টি। ওই কবিতা হঠাৎ আলোর ঝলক, শান্ত স্নিগ্ধতা, প্রশান্তির বদলে সঞ্চার করে বিশশতকের দ্বিতীয়াংশে বসবাসের তাপ-জ্বালা-দাহ।’ হুমায়ুন আজাদের ফরমান আজও প্রাসঙ্গিক, বাংলা কবিতার স্বতন্ত্র এক বিস্ময় শামসুর রাহমান—যাপিত-জীবন, শিল্পিত আয়ুরেখা এবং মহৎ কবিতার বিবেচনায় উত্তরাধুনিক প্রধানতম কবি—প্রেমে-অপ্রেমে, মিছিলে-প্রতিবাদে তাঁর কবিতা আমাদের জন্য বিশেষ প্রেরণা।

বিশ শতকের পঞ্চাশের দশকের এই কবি ছুটেছেন সময়ের সঙ্গে, ইতিহাসের চত্বরে গড়ে তুলেছেন কবিতার মঞ্চ। কেবল বুদ্ধদেব বসু, বিষ্ণু দে, জীবনানন্দ ও সুধীন দত্তের প্রভাব থেকে বেরিয়েই আসেননি, তিরিশোত্তর বাংলা কবিতাকে উত্তরণের পথে নিয়ে গেছেন। তার হাতে উত্তোলিত হয়েছে প্রতিরোধের শামিয়ানা। অথচ তাঁর আরম্ভ ছিল বিষণ্ণ ও দুঃস্বপ্নের চাদরে মোড়া। কবিতার সৌন্দর্যে ডুব দিয়ে ১৯৬০ সালে শামসুর রাহমান প্রকাশ করেছেন প্রথম গ্রন্থ ‘প্রথম গান, দ্বিতীয় মৃত্যুর আগে’। অভাবিত সব চিত্রকল্পের বিন্যাসে তিনি ছড়িয়ে দিয়েছেন আত্মমগ্ন তরুণের দিনলিপি। তাঁর কবিতায় গভীরভাবে যুক্ত হয়ে গেল স্থান-কাল ও ইতিহাসের চিহ্ন, যদিও তার প্রথম কবিতার বই ছিল প্রধানত এক নান্দনিক ভূমি। ধীরে ধীরে এই ভূমির গর্ভ ছেড়ে মূর্ত হয়ে উঠেছে পূর্ববঙ্গ ও বাংলাদেশ।

অবশ্য তার আগেই, ১৯৫২ সালে বদলে গিয়েছিল সৌন্দর্যের দৃশ্যপট। ঢাকার রাস্তায় গড়িয়ে পড়েছিল রক্ত। বাঙালি বুঝতে পেরেছিল, এক আধিপত্যের মুঠি ছেড়ে বেরোতে না বেরোতেই তারা ঢুকে পড়েছে আরেক আধিপত্যের কবজায়। ২১ ফেব্রুয়ারির তুমুল আলোড়নে তিনি লিখলেন—‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। আর পরবর্তীকালে ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে ‘গুচ্ছ গুচ্ছ রক্তকরবীর মতো’ তিনি ওড়ালেন ‘আসাদের শার্ট’। সেই আসাদ বারবার পুনর্জীবিত হয় শামসুর রাহমানের কবিতার মধ্য দিয়ে। ১৯৭০ এর দুর্ভিক্ষে ঘূর্ণিদুর্গত দক্ষিণাঞ্চলের লাখ লাখ মানুষের দুঃখ-দুর্দশায় ও মৃত্যুতে কাতর তিনিই লেখেন ‘আসুন আমরা আজ ও একজন জেলে’। মুক্তিযুদ্ধে যখন তিনি পিতৃভিটেতে বন্দিদশার মতো, ঠিক তখন রচিত হয় তার হাতে ‘স্বাধীনতা তুমি’ বা ‘তোমাকে পাওয়ার জন্য হে স্বাধীনতা’।

১৯৬৮ সালে যখন পাকিস্তানের সব ভাষার জন্য অভিন্ন রোমান হরফ চালু করার প্রস্তাব করেছিলেন আইয়ুব খান, তার প্রতিবাদে এগিয়ে এলেন শামসুর রাহমানই। সৃষ্টি হলো ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। তার কবিতা আঘাত করেছে বুলেটের মতো। কবিতা হয়ে উঠেছিল মানুষের মিছিলে উদ্দীপ্ত মশালের মতো।

তার সমকালের প্রেক্ষাপটে রচিত এমন এমন কবিতা রয়েছে, যার মধ্যে বাঙালি জাতীয় চেতনার বীজ অঙ্কুরিত এবং তা সংগ্রাম, ইতিহাস ও প্রতিরোধের আগুনের শিখা জ্বেলে দিয়ে গেছে বাঙালি জাতিসত্তায়। এসব কবিতা সমকালের চিরকালীনতা অর্জনের পাশাপাশি এক অপার শক্তি ও চেতনা নিয়েও জীবন্ত হয়ে আছে। যে কারণে যথার্থ অর্থেই ‘স্বাধীনতার কবি’ খেতাবটি পেয়ে যান শামসুর রাহমান। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সে কারণে বলেছিলেন, ‘শামসুর রাহমানের সব রচনা বিশ্ব সাহিত্যের অন্তর্গত, কিন্তু তাঁর পা সব সময় গাঁথা থেকেছে স্বদেশের মাটিতে।’

দুই।

পঞ্চাশের পরেই বাংলাদেশের কবিতায় দুটি ধারা সৃষ্টি হয়। একটা পাকিস্তানপন্থী ধারা, যেখানে ফররুখ আহমেদ, তালিম হোসেন, মোফাখ্খারুল ইসলাম ও সৈয়দ আলী আহসান ছিলেন। তারা ভাষায় নতুন ধারা তৈরি করতে চাইলেন। তারা চেষ্টা করলেন পূর্ববঙ্গের সাহিত্যকে পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে আলাদা করতে এবং এর মধ্যে পাকিস্তানি ঐতিহ্য ঢুকবে। তারা বলতেন আমেরিকার সাহিত্য যেমন ব্রিটিশ ইংরেজি সাহিত্য থেকে আলাদা, তেমনি পশ্চিমবঙ্গের সাহিত্য থেকে আমাদের সাহিত্য আলাদা হবে। অন্যপক্ষে ছিলেন আহসান হাবীব, আবুল হোসেন, সানাউল হকরা। আধুনিক বাংলা কবিতার ধারা যেটি ১৯৩০ সালে শুরু হয়েছিল, তারা সেটাকে নিয়ে এসেছেন। তারা পাকিস্তানি চিন্তায় আসক্ত ছিলেন না। তাদের ভাষায়-তাদের উপমায় বিষয়বস্তুতে সমস্ত কাজের মধ্যেই বাঙালিত্ব ফুটিয়ে তুলতে চাইলেন। 
তরুণ কবি শামসুর রাহমান তাদের সেই আধুনিক ধারার মধ্যেই নগরকেন্দ্রিক ধারা তৈরি করলেন। এবং ওই অবস্থানে তিনি অনড় থেকেছেন। সেখান থেকে পরবর্তী সময়ে তিনি নিজের একটা কাব্যভাষা সৃষ্টি করে নিলেন। আধুনিক ধারাকে ঐতিহ্য হিসেবে ধরে নিজের একটি ধারা তৈরি এটা একজন শক্তিমান কবির পক্ষেই করা সম্ভব। তার মধ্যে বুদ্ধদেব বসু ও জীবনানন্দের প্রভাব পরে দেখা গিয়েছিল, সুধীন্দ্রনাথ দত্তের কিছু প্রভাবও ছিল। কিন্তু সেসব প্রভাব কাটিয়ে খুব দ্রুতই তিনি নিজের কাব্যভাষা তৈরি করলেন।

তিন।

শামসুর রাহমান তিরিশোত্তর বাংলা কবিতাকে উত্তরণের পথে নিয়ে গেছেন। প্রাসঙ্গিকভাবেই কবি ও শিক্ষাবিদ জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, ‘বাংলাদেশের কবিতায় এক পরম্পরাগত ধারার জন্ম হয়েছে যার প্রধান ও অন্যতম উৎস শামসুর রাহমানের কবিতা।’ তেমনি ভারতের সাহিত্য সমালোচক আবু সয়ীদ আইয়ুবও মনে করেন তিরিশের পরে শামসুর রাহমানই বাংলা কবিতার প্রধান কবি। কবিতায় বিষয়, ছন্দসহ নানামুখী কাজের মধ্যদিয়েই শামসুর রাহমানকে বিদগ্ধজনের এই স্বীকৃতি অর্জন। সেসবের বিস্তারিত দিক নিয়ে আলোচনার অবকাশও আছে। 

কবিতায় তার জননন্দিত হওয়ার পেছনে অন্যতম দিক হচ্ছে তার সমকাল, দেশের সংকট এবং সংগ্রাম ও ঐতিহ্যকে উপজীব্য করে কবিতা লেখা, যার ফলে তার কবিতা পাঠে পাবলো নেরুদার ভাবাপন্ন আসে। তবে নেরুদা কমিউনিস্ট আদর্শে লালিত ছিলেন আর শামসুর রাহমান কোনো রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন না। তবে শামসুর রাহমান হয়তো মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেছিলেন একজন কবির জন্য তার সমকাল হচ্ছে সবচেয়ে জরুরি। এ সময়ের জাতীয় বিশেষ বিশেষ ঘটনাকে কবিতায় তুলে আনার মধ্যদিয়ে জন-আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন ঘটাতে হবে। যে কারণে তিনি স্বাধীনতা পূর্ব থেকে স্বাধীনতা উত্তর কালের প্রতিটি উল্লেখযোগ্য ঘটনাকেই তার কবিতায় বিষয় উপজীব্য করেছেন। যা শুধু তাকে অবিস্মরণীয়ই করেনি, তার কবিতাকেও পৌঁছে দিয়েছে কালের চূড়ায়। তার বহু কবিতায় সমকালের চিত্র উপস্থিত ও জীবন্ত। তাকে হুমায়ুন আজাদ ‘সমকালের সভাকবি’ আখ্যা দেন। তার ‘শামসুর রাহমান : নিঃসঙ্গ শেরপা’ কিতাবে হুমায়ুন আজাদ  এ অভিধায় অভিষিক্ত করেন শামসুর রাহমানকে। তিনি গ্রন্থের এক জায়গায় বলেছেন, ‘শামসুর রাহমানের কবিতার সাম্রাজ্যের নাম একান্ত ব্যক্তিতা জড়িত অব্যবহিত প্রতিবেশ পৃথিবীজীবনপূর্ণ সমকাল। তার কবিতায় নিসর্গ, মৃত্যু, প্রেম, সমকাল ইতিহাস-ঐতিহ্য-পুরাণ কি বিশ্বজনীনতা সবই রয়েছে, তবে সমকালের উপস্থিতি অতুলনীয়।’ পরে হুমায়ুন আজাদের এই মূল্যায়ন অকাট্যই মনে হয়েছে সর্বমহলে।

চার।

ঢাকা তখন গ্রাম্য শহর—মফস্বল শহর, সেই পরিবেশ মাড়িয়ে ওঠা শামসুর রাহমানের মধ্যে নগরকেন্দ্রিকতা একেবারে সূচনা থেকেই ছিল। সেই যে নগরের যে রাস্তাঘাট, ঘোড়া, রুটির দোকান, অন্ধ মানুষ, মানুষের চলাফেরা ইত্যাদির মধ্য নিয়ে এই যে নগর জীবন যেটা ঢাকার কবিতায় ওইভাবে আগে ছিল না, সেটা তিনি তৈরি করেছেন। সেই সময়ের পাকিস্তানপন্থী যে শক্তিশালী ধারা সেই ধারা থেকে একেবারেই বেরিয়ে স্বতন্ত্র ধারা তৈরি করেছেন। সাহিত্যে আধুনিক মনস্কতার বৈশিষ্ট্যগুলো ধারণ করে তিনি সেই ধারার মধ্য থেকেই একটা নিজস্বতা তৈরি করেছেন। তার অনুভূতিগুলো একেবারে স্বতঃস্ফূর্তভাবে অভিজ্ঞতালব্ধ। তার সমস্ত সাহিত্য যাত্রা, সমস্ত জীবন, স্বপ্ন, উচ্ছ্বাস, সংগ্রাম সবকিছুই পালাবদল হয়েছে ঢাকাকে ঘিরে। যে ঢাকাকে শামসুর রাহমান বলেছিলেন আমার ঢাকা, আমার নগর। সেই ঢাকাও তাকে আপন করে নিয়েছিল। সেই শহর ঢাকার বৃষ্টি, জল হাওয়া, পল্টনের ময়দান, রেসকোর্সের মাঠ, বিউটি বোর্ডিং, পুরান ঢাকার দালান, অলিগলি রাজপথ, মিছিল, দুহাতে কাঁপুনি তোলা চির সংগ্রাম যেন আঁকড়ে রেখেছিল তাকে।

পাঁচ।

সাহিত্যক্ষেত্রে তার যে আধুনিক মনস্কতা তা তিনি ঋদ্ধ করেছিলেন, বিশ্বসাহিত্য পাঠ থেকে। তিনি খুব বড় নিবিষ্টচিত্ত পাঠক ছিলেন। শামসুর রাহমানের কাব্যের যে অনুশীলন, তা গতানুগতিক কবির মতো না। বিশ্বসাহিত্য নিয়মিত পড়তেন, খোঁজ-খবর রাখতেন। যা অন্য কবিদের মধ্যে খুব একটা দেখা যায় না, তারা শুধুই কবিতা লিখেই চলেছেন, কিন্তু অন্যেরটা পড়েন না। কিন্তু তিনি বইয়ের খোঁজ রাখতেন, অনুশীলন করেছেন। নিজের মধ্যে একটা স্বতঃস্ফূর্ত কাব্যের চর্চা ছিল, কাব্যের জন্য আগ্রহ ছিল। এর জন্য তাকে অনেক আত্মত্যাগ করতে হয়েছে। তিনি সাংসারিক ব্যাপারে যে উদাসীন এটা ভেতর থেকে এসেছে কিন্তু পঠনের ব্যাপারে তার আগ্রহ ছিল অপার। এভাবেই তিনি বাংলা সাহিত্যের বিষয়বস্তুর মধ্যে বিশ্বসাহিত্যকে নিয়ে এসেছিলেন, এটা ওই সময়ে অন্য কেউ আনতে পারেনি। বিশ্বসাহিত্যের পটভূমি ধরে ওইখান থেকে উপমা নিয়ে শামসুর রাহমান একটি সমৃদ্ধ ধারা তৈরি করলেন। সব কিছু মিলিয়ে যে ব্যক্তিত্বটা, যেটি হচ্ছে অত্যন্ত লাজুক, অত্যন্ত স্পর্শকাতর, সংবেদনশীল, রুচিবান। তিনি খুবই রোমান্টিক কবি, আবার রাজনীতির ঘটনাগুলোও তার কবিতার মধ্যে এসেছে। ওগুলোও তার দেশ ও মানুষের প্রতি ভালবাসা-সংবেদনশীলতায় জন্ম নিয়েছিল। তার স্বাভাবিক প্রবণতা হচ্ছে প্রেমের কবিতা লেখা, আত্মজৈবনিক কবিতা লেখা, কিন্তু রাজনীতির যে ঘটনাগুলো ঘটছে তাও লিখছেন, সেগুলো দায়বোধ থেকে। তিনিই এই স্বাক্ষরটা রাখতে পেরেছেন, লেখকের দায়, কবির দায়।

‘শিল্পের জন্যে শিল্প’- এই তত্ত্বে বিশ্বাসী হয়ে কেউ কেউ শামসুর রাহমানের সমকালসংলগ্ন কবিতাকে খারিজ করে দিতে আগ্রহী। আঙ্গিকের অভিনবত্ব না খুঁজে ‘স্লোগানধর্মী কবিতা’ বলে এড়িয়ে যেতে চান। অথচ শিল্পের দাবি মূলত যথাযথ আঙ্গিকে ‘বিষয়’-এর উপস্থাপন। শামসুর রাহমান তাঁর কবিতায় কাজটি সফলভাবেই করতে পেরেছেন।

শামসুর রাহমান তার স্নিগ্ধ রোমান্টিক কবিতার মতো ছিলেন মিষ্টি; অত্যন্ত সদালাপী, রুচিবান; রূঢ় কথা বলতে পারতেন না। সব সময় কথা বলতেন কম, শুনতেন বেশি। তবে তার সৌজন্যের মধ্যে দৃঢ় একটি ব্যক্তিত্ব ছিল, অনমনীয়তা ছিল। অন্যরা তো সাহিত্যচর্চা করে সময়-সুযোগ মতো, শামসুর রাহমান একেবারে মনেপ্রাণে সাহিত্যিক। জীবিকার জন্য সাংবাদিকতা করেছেন, কিন্তু মূল ছিল তার সাহিত্য। জীবিকা এবং জীবন এই দুটোকে যেন আলাদা করে রেখেছিলেন। জীবন ছিল সাহিত্যে আর জীবিকা অন্যান্য কর্মকাণ্ডে নানান উপার্জনে। 

তিনি প্রেম নামক মানবিক অনুভূতি থেকে শুরু করে রাজনীতি, লালন এমনকি আরজ আলী মাতুব্বরকে নিয়ে লিখেছেন। বিশ্বের বড় দার্শনিকদের সম্বন্ধে খবর রাখতেন। একদিকে খাঁটি আধুনিক বাঙালি, কিন্তু একটা বিশ্বদৃষ্টি ছিল এবং সেই বিশ্বদৃষ্টিটা ক্রমাগত সম্প্রসারিত করেছেন পঠন-পাঠনের মধ্যদিয়ে। তার শ্যামলীর বাসায় নিচ তলায় বইয়ের বিপুল সমাহার, একজন বাঙালি কবির বাড়িতে শেলফের মধ্যে এরকম বই সাজিয়ে রেখেছেন। সাহিত্যের প্রতি এই অনুরাগ এটা খুব বিরল। সাহিত্য জীবনকেই তিনি সত্যিকারের নিজের জীবন মনে করতেন।

কবিতার জন্য একটা সোনালি তাগিদ শামসুর রাহমানের মধ্যে সবসময়ই ছিল। তার পারিবারিক ডাকনাম বাচ্চু, সেই বাচ্চু তার রচনায় নানাভাবে উঁকি দিয়েছে। নিজের দেখা বিষয়ের সঙ্গে কবি মনের উপলব্ধি মিশিয়ে একের পর এক কবিতা লিখে গেছেন সারাজীবন। এভাবেই তিনি জীবনটাকে কাব্যময় করে তুলেছিলেন। সমস্ত  মেধা খরচ করেছিলেন সাহিত্যের পেছনে। কবিতা ও গদ্য লিখেছেন। গদ্যে তার নিজস্বতা আছে। কবিতায় যতটা তিনি সরব, ততটা গদ্যে নয়, তবে তার মধ্যেও শামসুর রাহমান আছেন, তাকে খুঁজে পাওয়া যায়। তার উপন্যাসে, নাটকে তার গানে, বা ছোটদের জন্য লিখেছেন। সবগুলোর মধ্যেই একজন মানুষ আছেন যিনি সাহিত্যগত প্রাণ। শামসুর রাহমান অনমনীয় হচ্ছেন সাহিত্যের প্রতি তার অনুরাগে। সাহিত্য এবং জীবনকে তিনি একাকার করে ফেলেছেন। দ্বিতীয়ত, শামসুর রাহমানের কবিতায় ভাষার যে মান তাতে কোনো বিচ্যুতি আসেনি। সাহিত্যের ব্যাপারে বা কাব্যচর্চায় যা লিখতেন সেখানে কোনো রকম নমনীয়তা নয়, একবারে মেরুদণ্ড সোজা করে। তার এই অনমনীয়তা বহুবার আমরা দেখেছি। স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে দৈনিক বাংলার সম্পাদকের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়েছিলেন। তখন তার জীবিকা নির্বাহের আর কোনো পথ ছিল না। চাকরি ছেড়ে নামলেন এরশাদবিরোধী আন্দোলন, নিজে কবিতা লিখলেন, কবিতা লিখলেন ‘উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ’। কবিদের নিয়ে গড়ে তুললেন জাতীয় কবিতা পরিষদ। আন্দোলনটা দানাই বাঁধত না যদি না শামসুর রাহমান তাতে না থাকতেন।

নেতৃত্ব দেওয়ার মতো সাংগঠনিক মানুষ তিনি ছিলেন না। খুব শান্ত নরম, তিনি জোরে কথা বলতে পারেন না। তারপরেও গোটা কবিতা পরিষদের আন্দোলন তার নেতৃত্বেই হলো। একজন কবির যে অনমনীয়তা, সাহিত্যের প্রতি যে অনুরাগ সেটা যে জীবনেরই অংশ জীবিকার না, এটাই তিনি বুঝিয়েছেন। সাহিত্যের ভাষাকে তৈরি করতে নানা সামাজিক, রাজনৈতিক প্রতিকূল পরিবেশের মধ্যেও মেরুদণ্ডকে শক্ত করে রাখতে হয়, সেটা আমরা তার মধ্যে পেয়েছি। তিনি পথে নেমেছেন, দাঁড়িয়েছেন সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনে, লেখকের স্বাধীনতার পক্ষে, ধর্মান্ধতা আর উগ্রবাদের বিরুদ্ধে। এজন্য কম ঝক্কি আসেনি তার জীবনে। ঢাকার শ্যামলীর বাড়িতে ঢুকে তাকে হত্যাচেষ্টাও হয়েছিল। তবু শামসুর রাহমান দমেননি। তিনি তো দমার পাত্র নন।

শামসুর রাহমানের ভাষাটা ক্রমশ বদল হয়েছে, প্রথমদিকে ভাষার মধ্যে যে পেলবতা ছিল, প্রভাব ছিল পরে ক্রমশ নিজের ভাবধারা তৈরি করেছেন। তার অনুভূতিতেও ক্রমশ জটিলতা তৈরি হয়েছে। অভিজ্ঞতালব্ধ নানান জিনিস এসে মিশছে। এখানে মিশেছে নাগরিক সত্ত্বা, এক ইচ্ছে, নতুন স্বপ্নের ও জাগরণের গল্প। বাংলা কবিতায় যিনি সৃষ্টি করলেন এক ভিন্ন জাতিসত্তার অভিধা। যার সুর আমরা পাই তার কবিতায়। বাংলাদেশ জন্মের পেছনে যার কবিতার জন্ম, সমস্ত গণআন্দোলনে যার কবিতা হয়ে উঠেছিল জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরির মতো। তার কবিতার মধ্য দিয়ে যেন বাঙালি ও বাংলাদেশ তার আত্মাকে খুঁজে পায় বারবার। জীবনে তিনি টলেননি, বিচ্যুত হননি এক ইঞ্চিও নিজের আদর্শ থেকে। তার লেখা ‘সাহিত্য সাধনার পঁচিশ বছর’ পড়তে গিয়ে বোঝা যায় তিনি কতোটা আত্মসম্মানবোধ ও অটল প্রকৃতির মানুষ ছিলেন।

ছয়।

মীজানুর রহমানের ত্রৈমাসিক পত্রিকা’য়, শামসুর রাহমানের ৬০তম জন্মদিন উপলক্ষে আল মাহমুদের একটা চিঠি প্রকাশিত হয় বিশেষ সংখ্যায়। চিঠিটা ১৯৬৮ সালে লেখা। সেখানে আল মাহমুদ লিখেছেন শামসুর রাহমানকে : ‘আমার পরিষ্কার রাজনৈতিক মতামত ও আদর্শ রয়েছে। সমাজ বিশ্বাস আমার কাছে যেমন বড় কথা, সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থাকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সংগ্রাম করাকে আমি তারও চেয়ে মূল্য দিয়ে থাকি। এর জন্যে নিশান নিয়ে রাস্তায় নামতে আমার আর কোনো দ্বিধা নেই। দরকার হলে পার্টি সংগঠনের মধ্যে থেকে কাজ করব, রাস্তায় রাস্তায় পোস্টার সাঁটব। কবিতা লেখার মতোই এসব কাজ আমার জীবনের সাথে যুক্ত।’ এর সঙ্গে যুক্ত করতে হয়, ‘মানুষ মরে গেলে পচে যায়, বেঁচে থাকলে বদলায়।’ মুনীর চৌধুরীর ‘রক্তাক্ত প্রান্তর’ নাটকের সংলাপ। আল মাহমুদও বদলেছেন।

শামসুর রাহমান বলতেন, তিনি ছিলেন বুদ্ধদেব বসুর মতানুসারী, অনেকটাই কলাকৈবল্যবাদী। তার বন্ধু হাসান হাফিজুর রহমান ছিলেন রাজনীতিসচেতন এবং রাজনীতি-সক্রিয়। হাসান হাফিজুর রহমান বামপন্থী ছিলেন। শামসুর রাহমান তাঁর সঙ্গে একমত হতেন না, ভাবতেন, কবিদের রাজনীতি থেকে দূরে থাকা উচিত। পরে, ১৯৮৭ সালে জাতীয় কবিতা উৎসব করার সময় তিনি লিখলেন, তিনি এই মত থেকে দূরে সরে এসেছেন। রাজনীতি মানুষের জীবনকে অনেকটাই প্রভাবিত করে। দেশ বা মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নে শামসুর রাহমান সবসময়ই গৌণ, কিন্তু স্বদেশের সংকটে শামসুর রাহমান গুরুত্বপূর্ণ; কবিতায় দেশকাল-সমাজ ও দায়বদ্ধতা, একই সঙ্গে কবিতায় প্রাতিস্বিকতার নিরিখে শামসুর রাহমানের অপরিহার্যতা ও  প্রাসঙ্গিকতা আজও।

লেখক : সাহিত্যিক ও সাংবাদিক।

Link copied!