• ঢাকা
  • শুক্রবার, ২২ নভেম্বর, ২০২৪, ৭ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
শিল্পের সিন্দুক ৫

ইতিহাসের আলোয় গৌরবের শহীদ মিনার


আলম খোরশেদ
প্রকাশিত: ফেব্রুয়ারি ২০, ২০২৩, ০৩:৫৮ পিএম
ইতিহাসের আলোয় গৌরবের শহীদ মিনার

বছর ঘুরে আবার এসেছে ফেব্রুয়ারি মাস। ছোট বন্ধুরা, তোমরা জানো, বাংলা ভাষা ও বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই মাসেরই একুশ তারিখে, বাংলা সাল অনুযায়ী যে দিনটি ছিল ৮ই ফাল্গুন,বেশ ক’জন তরুণ তাদের তাজা প্রাণ বিসর্জন দিয়েছিল, আমরা যেন আমাদের মায়ের ভাষা তথা বাংলায় কথা বলতে পারি।সেই থেকে এই দিনটি আমাদের জাতীয় ইতিহাসে মহান শহীদ দিবস হিসেবে চিহ্নিত হয়ে আছে। শুধু তা-ই নয়, দিনটি ১৯৯৯ সালে জাতিসঙ্ঘ থেকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসেরও স্বীকৃতি পেয়েছে, যা সারা পৃথিবীজুড়েই প্রতিবছর সগৌরবে পালিত হয়ে থাকে। আর এই দিনটির সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত একটি অসম্ভব সুন্দর স্মৃতিস্তম্ভ, যার নাম শহীদ মিনার। আজ  আমি তোমাদেরকে এই শহীদ মিনার নির্মাণের পেছনের যে দীর্ঘ ও রোমাঞ্চকর ইতিহাস, সেই গল্পটি শোনাব। আমার ধারণা, এটি তোমাদের অনেকেরই এমন বিশদভাবে জানা নেই। 


১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারির সকালবেলায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের সামনে পুলিশের গুলিতে রফিক, সালাম, বরকত প্রমুখ নিহত হবার পরদিনই সেই ঘটনাস্থলের কাছাকাছি একটি শহীদ মিনার নির্মাণের সিদ্ধান্ত হয়।তখন ঝটপট এর একটি প্রাথমিক নকশা করে দেন মেডিকেলেরই দুই ছাত্র বদরুল আলম ও সাঈদ হায়দার। সেই অনুযায়ী ২৩শে ফেব্রুয়ারি বিকেলেই দুজন রাজমিস্ত্রির সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থীরা দ্রুত কাজ শুরু করে দেন। আর এর কারিগরি দিকটির দেখভাল করেন বুয়েটের এক তরুণ প্রকৌশলী জিএস শরফুদ্দিন। সারারাত ধরে কাজ করে পরদিনই তৈরি হয়ে যায় ১০ ফুট উঁচু ও ৬ ফুট চওড়া সেই প্রথম শহীদ মিনারটি। কালবিলম্ব না করে পরদিন সকালেই,অর্থাৎ ২৪ ফেব্রুয়ারিতেই ছাত্ররা সেটিকে একপ্রকার  উদ্বোধন করিয়ে ফেলেন ২২শে ফেব্রুয়ারির আরেক শহীদ শফিউরের পিতা মাহবুবুর রহমানকে দিয়ে। অবশ্য এর দুদিন বাদে ২৬ ফেব্রুয়ারি সকালে শহীদ মিনারটি আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন দৈনিক আজাদ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবুল কালাম শামসুদ্দিন। কিন্তু উদ্বোধনের দিনই পুলিশ ও মিলিটারির সদস্যরা এসে মেডিকেলের ছাত্রহোস্টেল ঘিরে ফেলে এবং শহীদ মিনারটিকে একেবারে ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়।এই ঘটনাটি নিয়ে পরে কবি আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতির মিনার’ নামে দারুণ একটি কবিতাও লিখেছিলেন। অমর সেই কবিতার কয়েকটি লাইন তোমাদের জন্য উদ্ধৃত করছি এখানে।
 

"স্মৃতির মিনার ভেঙেছে তোমার? 
ভয় কি বন্ধু,আমরা এখনো
চারকোটি পরিবার
খাড়া রয়েছি তো!
********************
ইটের মিনার ভেঙেছে ভাঙুক। 
একটি মিনার গড়েছি আমরা
চারকোটি কারিগর।”

 

এর পরের বছর ১৯৫৩ থেকেই সারাদেশে প্রধানত ছাত্রদের উদ্যোগে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে শহীদ দিবস হিসেবে পালন শুরু এবং প্রথমবারের মতো প্রভাতফেরি বের করা হয়। আর এভাবেই একুশে ফেব্রুয়ারির অন্যতম আকর্ষণ প্রভাতফেরির সূত্রপাত হয় বাঙালির জীবনে। তার পরের বছর ১৯৫৪ সালে আওয়ামি লিগের অংশগ্রহণে যুক্তফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় এসে নতুন করে শহীদ মিনার তৈরি ও একুশে ফেব্রুয়ারিকে সরকারিভাবে  শহীদ দিবস হিসেবে পালনের ঘোষণা দেয়। তবে সেটি বাস্তবায়নের আগেই তারা পাকিস্তানিদের কুৎসিত ষড়যন্ত্রের শিকার হয়ে ক্ষমতাচ্যুত হয়। এর দুবছর পর ১৯৫৬ সালে আবুল হোসেন সরকারের আমলে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে একটি স্থান নির্ধারণ করা হয়। মজার ব্যাপার, সরকারের একজন মন্ত্রী সেই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করতে চাইলে জনতার তুমুল প্রতিবাদের মুখে তাঁর বদলে ভাষাশহীদ রিকশাচালক আউয়ালের বাচ্চা মেয়ে বসিরনকে দিয়েই তা করানো হয়েছিল।


 

এরপর দ্বিতীয়বারের মতো সেই শহীদ মিনারের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন পূর্ববঙ্গ সরকারের তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী আবুল হোসেন, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী এবং ভাষাশহীদ আবুল বরকতের মা হাসিনা বেগম। সেই সময়ই একুশে ফেব্রুয়ারিকে আনুষ্ঠানিকভাবে শহীদ দিবস ও সরকারি ছুটির দিন হিসেবে ঘোষণা করা হয় এবং বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষার স্বীকৃতি দেবার পরে ১৯৫৭ সালে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারের কাজ শুরু হয়। প্রস্তাবিত সেই শহীদ মিনার আঙিনার স্থাপত্য নকশার দায়িত্ব পান শিল্পী হামিদুর রহমান ও দেশের প্রথম নারী-ভাস্কর নভেরা আহমেদ। উক্ত পরিকল্পনা ও নকশা অনুযায়ী ১৯৫৭ সালের নভেম্বর মাস থেকে হাতেকলমে কাজ শুরু করেন তাঁরা। হামিদুর রহমানের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করতে থাকেন ভাস্কর নভেরা আহমদ। দ্রুততম সময়ে মিনারের ভিত,মঞ্চ ও কয়েকটি স্তম্ভ তৈরির কাজ শেষ হয়। সেই সঙ্গে রেলিং,পায়ের ছাপ, ম্যুরালের কিছু কাজ এবং নভেরা আহমদের তিনটি ভাস্কর্যও সম্পূর্ণ হয়। কিন্তু ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসে আচমকা আইয়ুব খানের সামরিক শাসন জারি হওয়ার পর শহীদ মিনার তৈরির কাজ বন্ধ হয়ে যায়। 
 

১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত আপামর জনসাধারণ এই অসম্পূর্ণ মিনারেই ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়েছে একুশের শহিদদের। ১৯৬২ সালে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর আজম খানের নির্দেশে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. মাহমুদ হোসেনের নেতৃত্বে গঠিত কমিটির পরামর্শমতো মূল নকশা পরিবর্তন করে আরেকটি নকশা করা হয়। এরপর দ্রুত মিনারের কাজ শেষ করা হয়। ১৯৬৩ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি আবারও এর উদ্বোধন করেন শহিদ বরকতের মা হাসিনা বেগম, যদিও তখনো সম্পূর্ণ কমপ্লেক্সের কাজ সম্পন্ন হয়নি। এরপর ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চের কালরাতে পরিচালিত অপারেশন সার্চলাইট অপারেশনের সময় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী শহীদ মিনারটিকে পুনরায় গুঁড়িয়ে দেয় এবং ধ্বংসাবশেষের ওপর ‘মসজিদ’ লেখা একটি সাইনবোর্ড পুঁতে দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পরে ১৯৭২ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে শহীদ মিনার পুনরায় নির্মাণের জন্য কমিটি গঠন করা হয়। তাঁরা ১৯৬৩ সালের নকশার উপর ভিত্তি করেই দ্রুত এর কাজ সম্পন্ন করতে চান। ১৯৭৬ সালে নতুন নকশা অনুমোদিত হয় শহীদ মিনারের জন্য, যদিও বাস্তবে সেটিও সম্পূর্ণরূপে প্রয়োগ করা হয়নি। নতুন নকশা অনুসারে দেড় হাজার বর্গফুটের ভিত্তির ওপর চারটি ক্ষুদ্র ও একটি বৃহৎ কলাম মা ও তার নিহত সন্তানদের প্রতীক হিসেবে নির্মিত হবে। এর পেছনে থাকবে একটি লাল সূর্য। এগুলো নির্মিত হবে উজ্বল মার্বেল পাথর দ্বারা। সিঁড়িতে ব্যবহার করা হবে সাদা রং যা একটি শুভ্র সৌম্য ভাব এনে দেবে গোটা প্রাঙ্গণজুড়ে। প্রাচীরে লেখা থাকবে বিখ্যাত কবিদের কবিতা। কিন্তু তাড়াহুড়োর কারণে এই পরিকল্পনা যথার্থরূপে বাস্তবায়িত করা সম্ভব হয়নি। 
 

এই নতুন পরিকল্পনায় হামিদুর রহমান-নভেরা আহমদ যুগলের নকশা করা দেয়ালচিত্র ও পাতালপ্রকোষ্ঠটিও বাতিল হয়ে যায়। মূল পরিকল্পনা অনুসারে শহীদ মিনার এলাকায় একটি জাদুঘর ও পাঠাগার নির্মাণের কথা ছিল। সম্মুখ চত্বরে ভাস্কর নভেরা আহমেদের দুটি ম্যুরাল স্থাপনের পরিকল্পনা ছিল। এছাড়া ছিল বেদনাঘন শহীদ দিবসের প্রতীক হিসেবে একটি ফোয়ারা স্থাপনের পরিকল্পনা। চোখে সূর্যের আলোর প্রতিফলন নির্দেশ করতে হলুদ ও গাঢ় নীলরঙা কাচ বসানোর কথা ছিল কলামগুলোতে। মেঝেটি হবার কথা ছিল মার্বেল পাথরের যেন এই কলামগুলোর ছায়ার স্থান পরিবর্তন এতে দেখা যায়। বেদীর নিচে একটি প্রাচীরচিত্রে উল্লেখ থাকার কথা ছিল ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের কথা।সৌধটির সামনে বাংলা অক্ষরযুক্ত একটি রেইলিং স্থাপনের কথাও ছিল। আশপাশের অনেকটুকু জায়গা নিয়ে চোখের আকৃতিবিশিষ্ট একটি ঝর্না নির্মাণের পরিকল্পনাও ছিল মূল নকশায়,যার প্রান্তে থাকবে ঢেউ-খেলানো উঁচু বেদী। এককথায় শিল্পীদ্বয়ের পরিকল্পনায় ছিল অনেকখানি জায়গা নিয়ে বেশ বড় আয়তনের শহীদ মিনার কমপ্লেক্স নির্মাণ করা। এছাড়া তাঁরা এমনভাবে শহীদ মিনারের নকশাটি করেছিলেন যাতে করে তা এই গ্রীষ্মমণ্ডলীয় অঞ্চলের আবহাওয়ায় দীর্ঘদিন টিকে থাকতে পারে। যা-ই হোক, নানারকম কাটছাঁট ও আপসরফা করে শেষপর্যন্ত ১৯৮৩ সালে শহীদ মিনারটি বর্তমান রূপ পায়। সবশেষ, ২০১০ সালের ২৫শে আগস্ট হাইকোর্ট শহীদ মিনারের ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণার্থে নয়টি নির্দেশনা প্রদান এবং জাদুঘর ও পাঠাগারসহ মূল নকশার বাকি উপাদানসমূহ দ্রুত নির্মাণের নির্দেশ দেন। আমরাও মনে করি, মহান শহীদদের প্রতি প্রকৃত শ্রদ্ধা ও শহীদ মিনারের মূল নকশাকারী শিল্পীদের প্রতি যথাযথ সম্মান প্রদর্শনের জন্য হলেও আর দেরি না করে শহীদ মিনারের অসম্পূর্ণ কাজগুলো শেষ করে তার আদি নকশাটিকে বাস্তবায়ন করার দাবি তোলা উচিত আমাদের সকলের।ছোট বন্ধুরা, তোমরা নিশ্চয়ই আমার সঙ্গে একমত হবে যে, এটি করা গেলে আমাদের সুন্দর শহীদ মিনারটি আরও সুন্দর, আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে এবং সেইসঙ্গে একটি বিশ্বমানের স্মৃতিসৌধের সম্মান ও সুখ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হবে।
 

আরেকটি কথা, তোমাদের অনেকেরই হয়ত জানা নেই, আমাদের এই কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারটির অন্যতম পরিকল্পক ও নকশাকার ভাস্কর নভেরা আহমেদকে কিন্তু তাঁর প্রাপ্য সম্মান ও স্বীকৃতি থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে। তোমরা লক্ষ করবে,শহীদ মিনার নির্মাণের ইতিহাস ও বর্ণনা, বিবরণে তাঁর নামটিকে প্রায়শই উপেক্ষা করা হয়; এমনকি উইকপিডিয়াতেও শহীদ মিনারের অন্যতম নকশাকার হিসেবে তাঁর নাম নেই।অথচ সেইসময়ের অনেক প্রতিবেদন ও স্মৃতিকথা থেকে আমরা জেনেছি, নভেরা আহমেদ কী অক্লান্ত পরিশ্রমই না করেছেন শহীদ মিনার নির্মাণের কাজে। তখন তিনি এমনকি দিনের পর দিন শহীদ মিনার প্রাঙ্গণেই তাঁবু খাটিয়ে থেকেছেন কাজটিকে সুষ্ঠু ও সর্বাঙ্গসুন্দর করে তোলার জন্য। এই উপেক্ষার কারণেই কি না জানি না একপর্যায়ে অভিমান করে তিনি দেশ ছেড়ে ফ্রান্সে চলে যান। অনেক সাধ্যসাধনা করেও তাঁকে আর দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। তিনি ২০১৫ সালে সেখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। এই লেখাটি শেষ করার আগে তাই, সংশ্লিষ্ট সবার কাছে আমার সনির্বন্ধ অনুরোধ ও আহ্বান, আমাদের প্রিয় শহীদ মিনারটির অন্যতম নকশাকার ভাস্কর নভেরা আহমেদকে তাঁর প্রাপ্য সম্মানটুকু জানাতে আমরা যেন কখনোই কোনো কার্পণ্য না করি। সরকারও যেন এই লক্ষ্যে অচিরেই যথাযথ উদ্যোগ গ্রহণ করে, এমনই প্রত্যাশা থাকবে আমাদের সকলের।

Link copied!