বাইবেলে ঈশ্বর বলেন, ‘আমিই আলফা, আমিই ওমেগা’, অর্থাৎ আমিই শুরু, আমিই শেষ। আর যা কিছু এর মধ্যস্থিত, তা-ও অবধারিতভাবে আমিই। গ্রিক বর্ণমালার প্রথম আর শেষ বর্ণ এই আলফা, ওমেগা।
এভাবেই ভাষার অধিপতিরূপে নিজেকে প্রতীকায়িত করে ঈশ্বর তার অসীমতা আর সর্বশক্তির জানান দিলেন, যা প্রকারান্তরে ভাষারই অসীমতা। ভাষাই তাহলে ঈশ্বর।
ভাষার ক্ষমতা যে কত বড়, সব ধর্মগ্রন্থেই সেটার উল্লেখ পাওয়া যায়। সনাতন ধর্মমতে দেখা যায় জগতসৃষ্টির মূলে একটি শব্দ—ওম। যা ভাঙলে পাওয়া যায় অ উ ম। এই প্রত্যেক অক্ষরের আবার আলাদা মানে আছে। তিন প্রধান দেবতা ব্রহ্মা, বিষ্ণু আর শিব। দেখা যাচ্ছে ভাষার দৌড় মেলা দূর। ইসলামেও আল্লাহ্ ‘কুন’ শব্দ উচ্চারণ করেন, যার অর্থ হও, আর সব সৃষ্টি হয়ে যায়!
শুধু ধর্ম না দর্শনের যুগেও ভাষার এই অপার ক্ষমতার কথা নানা ভাবে উল্লেখ করেছেন দার্শনিক, মহাজনেরা।
সলিমুল্লাহ খান বিরচিত ‘আমি, তুমি, সে’ নামক একটি পুস্তক ঘাটতে গিয়ে দেখি সেখানেও ভাষার প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, ‘স্বর্গে ঈশ্বর নাই, ঈশ্বর আছেন ভাষায়’। ভাষার ব্যাপারে ফলে আমার ঈমান আছে, যেহেতু মানুষ ভাষাজীব।
কিন্তু ভাষা যখন এক দিকে এত ক্ষমতাবান, অন্যদিকে সে যে ক্ষমতাহীনও। ভাষা যেমন উপশম তেমন ব্যাধিও। কেননা ভাষায় সব ধরা যায় না, প্রকাশ করা যায় না, এমন অভিযোগও তো মিথ্যা নয়। ভাষা মানেই কৃত্রিম, বানানো প্রতীকচিহ্ন। বানানো পদেতো পদার্থ পুরোটা ধরে না।
এই বানানো ভাষা নিয়ই ফরাসি কবি জ্যাক প্রেভর লিখেছিলেন—
শালিক যে কী তা কি কেউ জানে
তাছাড়া শালিক তো পাখিটার নাম-ই না
মানুষই শুধু পাখিটাকে ওই নামে ডাকে
শালিক শালিক শালিক শালিক শালিক
এই নাম-টামের ব্যাপারগুলো বেশ অদ্ভূত
মার্ত্যা উগ ভিক্তর একজনের নাম
বোনাপার্ত নাপলেঅ একজনের নাম
কেন যে এরকম হয় কেন যে হয় না অন্য রকম
মরুভূমির ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে একপাল বোনাপার্ত
সম্রাটের নাম হচ্ছে উট
তাঁর পয়সা রাখার জন্য ঘোড়া আছে আর ছোটাবার জন্য দেরাজ
দূরে একটা লোক লাফাচ্ছে তার তিন টুকরো নাম
নামটা হচ্ছে টিম-টম-ট্যাম ব্যস আর পদবী কিচ্ছু নেই।
বানানো পদ পদার্থকে ধরতে পারে না বলে এই আক্ষেপ মানুষের বরাবরই ছিল। লালন বলেছিলেন, ‘অনামী অধর চিনতে, ভাষা বাক্যে না সম্ভবে’।
কিন্তু এই ভাষা থেকে তো আমাদের উদ্ধার নাই। আমরা এই গরাদে আটকা পড়েছি। আমরা আজ যা, তা এই ভাষাই; চিন্তার মূল যেহেতু ভাষা। এর হাত থেকে এক উদ্ধার হতে পারে একেবারে ভাষাহীন হয়ে প্রবৃত্তিতাড়িত প্রাণীতে পরিণত হওয়া। তা আপাত না ভেবে ভাবনা হলো এই ভাষার মধ্যে থেকেই বন্দীদশা ঘোচানো যায় কিনা তার অনুসন্ধান। ভাষাজীব হিসেবে মানুষের হাতে যেহেতু ভাষার চেয়ে আর বড় কোনো আবিষ্কার নাই তাই মানুষকে ভাষার কাছেই ফিরতে হয়।
ভাষা প্রতীক, আর প্রতীক বলেই ভাষার আছে নব নব অর্থসৃষ্টির ক্ষমতা। ফলে ভাষাকে একক অর্থের ভেতর আটকে রাখা যায় না, প্রতীক হওয়ায় পূর্ব নির্ধারিত অর্থের সীমানা ভাঙার আসক্তি এর মধ্যেই গুঁজে দেওয়া আছে। আর সেই আসক্তি চূড়ান্ত পরিণতি পায় কবিতাভাষায়, কারণ কবিতাই শব্দের অর্থকে চূড়ান্তরূপে অপরিচিতকরণে নিয়ে যায় আর নতুন নতুন অর্থ নির্মাণ করে।
কবিতা চায় সমাজে আগে থেকে নির্ধারণ করা ভাষা, তথাকথিত ব্যাবহারিক ভাষার অর্থ ভেঙে আরও আরও অর্থ তৈরি করতে। এইভাবে সে বানানো ভাষাটাকে ভাষা দিয়েই ভাঙতে চায়। কবিতারই একমাত্র ক্ষমতা আছে ভাষা দিয়ে ভাষার বিষকে ক্ষয় করার। ভাষা ঈশ্বর। কবিতা বলা চলে সেই ভাষার প্রাণ।
*
মানুষের ব্যাবহারিক ভাষা দিয়ে সামান্য একটা মাত্র নামপদ বা বিশেষ্যেরও সার্বজনীন সংজ্ঞা নির্ধারণ করা সম্ভব নয়। সে কার্ল পপারের তৃতীয় বিশ্বের বর্ণনাত্মক ভাষাতেও সম্ভবপর নয়। ঘোড়া নামক একটি শব্দ বা যে কোনো শব্দই ধরা যাক, কোনো কিছুরই সার্বজনীন সংজ্ঞা দাঁড় করানো যায় না ভাষায়। কেননা স্থান কাল পাত্রে ঘোড়া আলাদা আলাদা বিন্যাসে অবস্থান করে, ফলে ভাষা অক্ষম।
ভাষার এই অক্ষমতার ফলে জগতে অনেক লেখক শিল্পী বুদ্ধিজীবীর কথা আমরা জানি যারা অভিমান করে লেখালেখি শিল্পচর্চা এমনকি কথা বলা পর্যন্ত থামিয়ে দিয়েছিলেন। আমাদের চারপাশেও আমরা অনেককে দেখি যারা কথা বলা বন্ধ করে চুপ মেরে যান। মুনি ঋষি থেকে শুরু করে এই সমকালেও এমন মানুষ মেলে। এই চুপ মেরে যাওয়াও ভাষার প্রশ্নে একটা বড় ঘটনা।
একদিকে ভাষা ক্ষমতাবান আরেক দিকে ভাষা অক্ষম। তাহলে এই দুই বিপরীত মেরুতে দাঁড়িয়ে ভাষার চারিত্র আমরা কী রূপে নির্ণয় করতে পারি!
এ পরিস্থিতি বুঝতে প্লেটোর ‘বিশেষ’ আর ‘নির্বিশেষ’ বিষয়ক যে ব্যাখ্যা আছে সেটা খুব কাজে আসতে পারে। প্লেটোর মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি যে বস্তুজগতে বিশুদ্ধ কোনো কিছু নাই। ধরা যাক, প্রকৃত ঘোড়া, তা কোথাও নাই। সেই ঘোড়া আছে কেবল ধারণার জগতে। আমরা বস্তুজগতে যে ঘোড়া দেখি তা আসলে ধারণার জগতের ওই ঘোড়ার অপভ্রংশ। ফলে এই দুই ঘোড়ায় শেষমেশ একটা ব্যবধান থেকে যায়। কিন্তু খেয়াল করার বিষয় যে, ধারণার জগতের ঘোড়া যা নাই, অথচ সে এতোটাই আছে যে তার ভিত্তিতে বস্তুজগতে ঘোড়া আবিষ্কার করা হয়। এই প্রক্রিয়ায় ধারণার ঘোড়া জন্ম দিলো বস্তু জগতের ঘোড়াকে, ফলে এক থেকে জন্ম হলো দুইয়ের, আবার দুই ঘোড়ার সাদৃশ্যগত ব্যাবধানের ফলে যে হাহাকার তাঁর থেকে জন্ম নিলো বিশুদ্ধ ঘোড়া অন্বেষণের বাসনা। সব কালো বাদামি সাদা ঘোড়াকে ঘোড়া হিসেবে মেনে নিলেও মানুষ জানে প্রকৃত ঘোড়া এটা নয়। ফলে সে আরো আরো খুঁজতে থাকে। এইভাবে একের থেকে জন্ম নেয় তিন।
ভাষাও ঠিক এই তিন দশায় কাজ করে। ভালোবাসা নামক একটি পদ ধারণার জগতের যে প্রকৃত ভালোবাসার কথা বলতে চায় আর আমরা পদের নির্দেশে ফল হিসেবে যা অভিজ্ঞতা করি এই দুইয়ে বিস্তর ফারাক থাকে। পদ আর পদার্থের এই ফারাক লাঘব করা সম্ভব নয়। কারণ এখানে ওই প্লেটোর বিশেষ আর নির্বিশেষের মতো একটা দুরত্ব থাকে। ফলে শব্দ যা বলে আসলে তা বলে না। শব্দ যা বলে না আসলে তাই বলে। একটা সহজ প্রপঞ্চ থেকে কেমন ধাঁধার জন্ম হয় এভাবে। ভাষার অক্ষমতা এখানে নবতর সম্ভাবনার দুয়ার খুলে দেয়। সেই ধারণার ঘোড়া যে ভাবে জন্ম দেয় বিশেষ ঘোড়ার। আর এক থেকে জন্ম নেয় তিন।
দেকার্তের আমি ভাবি তাই আমি আছি। এক-কে একই রাখতে চায়। কিন্তু হেগেল বলেন এক বলে আসলে কিছু নাই, এক আসলে দুই। আমি আছি তাই তুমি আছো। আমরা যে কেউ থাকি তুলনার ভিত্তিতে। সাদা বলে কিছু নাই। সাদা মানে- যা কালো নয়। এভাবেই এক থেকে দুইয়ের জন্ম। কিন্তু সাদা আর কালোর মাঝখানে যে একটা বিশাল ফাঁকা থাকে। সেই ফাঁকা নিজেও আবার একজন। প্লেটোর বিশেষ, নির্বিশেষ, ভাষার পদ পদার্থ, হেগেলের আমি তুমি এই দশাগুলো এভাবে সমান্তরালে বইতে থাকে। আহাম্মদ আর আহাদের মাঝে মীমের পর্দার মানে এবারে বোঝা যায়। ফ্রয়েড মায় লাকাও এই তিন দশার কথা বলেন। এঁদের একের মাধ্যমে অপরকে বুঝতে সুবিধা হয়। বোঝা যায় পরম্পরা একটা বড় বিষয়।
*
আমার মনে আছে, দুই বছর আগে কবি সুব্রত অগাস্টিন গোমেজকে নিবেদন করা এক পুরস্কার প্রদান অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখার সময় কবিরই দুইটি পৃথক কবিতা থেকে ভাষার এই জায়গাটির দিকে নির্দেশ করেছিলেন সলিমুল্লাহ খান। উনি দুইটি কবিতাই পুরোটা উদ্ধৃত করেছিলেন, আমিও সেই পথ অনুসরণীয় মনে করি। পরপর আমরা সুব্রত অগাস্টিন গোমজের দুইটি কবিতায় নজর বুলাই।
পথনির্দেশ
ধরো উয়ারিতে আছো, টিপু সুলতান
রোড ধরে চলিতেছ খ্রিস্টান-কবরস্তান পানে
তারপর যেখানে শেষ টিপু সুলতান
সেখানেই ঘুরে গিয়ে ডানে
হাঁটি হাঁটি পা পা যাও নারিন্দা মোড়ের দিকে তুমি,
মোড়ে গিয়ে, বেঁচে থাকলে, ঝুনুর দুয়েক প্লেট মোরগ পোলাও মেরে দিয়ে
ডান দিকে বয়ে যাও ধোলাই খালের তেরাস্তায়,
উঁহুহু ডানে ঘুরো না, নাক বরাবর হাঁটো কুলি আর কামিন খেদিয়ে
হৃষীকেশ দাস রোড ধরে। ডানে বায়ে একে একে
পেরোও পাঁচভাই ঘাট লেন আর বানিয়ানগর,
এবং কদমতলা, সেখানে কদমগাছ তলে
পিংকি এক মন্দির রয়েছে, সেটি এত পিচ্চি যেন রান্নাঘর
প্রণাম ঠুকিতে চাও ঠুকিয়া আগায়ে যাও গজ পঞ্চাশেক,
আবার তেমাথা, যেথা লক্ষ্মীবাজারের রাস্তাখানি
(ওরফে সুভাষ বোস অ্যাভিনিউ, সবারই অজানা সেই নাম)
মিলে গেছে হৃষীকেশে, বাকরখানির
দোকান আছয়ে সেথা...তবু চলে যাও সোজাসুজি
একরামপুর আর কলুটোলা ছাড়িয়ে দু’দিকে
তখন ডানদিকে তুমি দেখিবে হেমেন্দ্র দাস রোড
উক্ত রোডে লহো পা দু’টিকে
রিকশার বেতঝোপ ফুঁড়ে কনুইয়ে জানুতে
কয়েকটা মুদি ও লোহালক্কড়ের চক্করের পরে
কলাপসিবল গেটে পাঁচতলা গারদ
গোলাপি রঙ্গের বাড়িটিতে নক করে
আমাকে পাবে না।
২
সাজ্জাদ শরিফের বাসায়
ঝটপটাপট কবিতা ফাঁদতে হবে
গোটা দুচ্চার- তা না হলে সাজ্জাদ
রাইসু, মাসুদ খানকে কি হুনাতাম?
আসর করবো মাত অরা- আমি বাদ।
ধরে লওয়া যায়, আইবেন আলতাফ
ভাই, তাঁর যত পালিশ-চিকন কপি
লয়ে- আছে হের্ ফরহাদ মজহার,
সব আড্ডার অদ্বিতীয়ম টপিক!
ইঁহারা ইশারা করবেন-‘সুব্রত
কবিতা বলেন!’ লেকিন আমি যখন
গাইব- ‘ভাই গো, কবিতা নাই তো সঙ্গে-
কত ভালো, আহা, করবেন তাঁরা মন!
খান হুনাবেন হীনম্মন্য করা
কয়েক দিস্তা, প্রায় নিস্তারহীন-
শক্তি ও জয়ও নাক গলাবেনে এসে,
শাওন খাইয়ে দিবেনে পরে পুড়িং
রাইসুর লগে বার হয়ে রাস্তায়
গাড়ি খুঁজবার ঝক্কির মাঝরাতে
মুখটা এমুন করে রাখমু রে আমি
যাতে মনে হয়, আমিও ছিলাম সাথে...
এই দুই কবিতায় আমরা দেখি শব্দের সেই যে- যা বলে তা আসলে বলে না, আর যা বলে না তা আসলে বলে সেই কেলি। এভাবেই না থেকেও থাকা যায়, আর থেকেও যায় না-থাকা। ভাষা এইভাবে কাজ করে। যে ভাষার মানে অভিধান না। যার মানে আমরা।
সেদিন সলিমুল্লাহ খানের ওই দুই পৃথক কবিতা এক করে একটা অখণ্ড ধারণার জন্ম দেওয়াটাও কেমন একটা ভালো লাগা তৈরি করেছিল। কবিতা দুইটি একক ভাবে কিংবা এক সাথেও যুগ্ম-বৈপরীত্যের মতো। এর কোনো এক অংশ সত্য নয়। হ্যাঁ এখানে না। না এখানে হ্যাঁ। কিংবা দুইটাই।
এই ভাবে ভাষাকে কে বা কারা অবলোকন করে?
আমরা দেখলাম সুব্রত অগাস্টিন গোমেজ এভাবে দেখলেন, অর্থাৎ কবি, যিনি বুদ্ধিজীবী বা তাত্ত্বিক নন। কিন্তু সলিমুল্লাহ খান কীভাবে খুঁজে পেলেন সুব্রতর ওই দেখাটিকে, যদি উনিও একইভাবে না দেখেন! সবাই তো ওনাকে বুদ্ধিজিবী বা তাত্ত্বিক বলেন, যিনি কবি নন। এই দুই বিপরীত কী করে একই বিন্দুতে এসে মিলিত হলো। তাহলে জগতে কখনও কখনও কবিও তাত্ত্বিক বটে, তাত্ত্বিকও কবি। সলিমুল্লাহ খান সেই কবিতাবোধনে স্নাত। উনি শুধু অন্যের লেখা থেকে ভাষার ওই গূঢ়লেখ উদ্ধার করতে সক্ষম জহুরি তাই নন, নিজেও তিনি তেমনই লিখতে জানেন। সলিমুল্লাহ খানের লেখা নিচের কবিতাটিতে নজর বুলালেই তার প্রমাণ পাওয়া যাবে।
অর্থ
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
লিখতে সে ভুলে
লিখেছে ইসকুলে
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে
বলুন পাঠক কহুন পাঠিকা
কি নকল করলো সে কবি নজরুল থিকা!
আমি নার মধ্যে থামি আমিনার মধ্যে থামি না
আমির অর্থও শুদ্ধ আমি না
কি এই নায়ের অর্থ যদি অন্তর্যামী না
না বলেই হাঁ বলি কোলে থাকি নামি না
তোরা দেখে যা আমিনা মায়ের কোলে আমি না
এভাবেই সলিমুল্লাহ খানের কবিতাবোধন আর তাঁর ভাষাদর্শন সমান্তরালে চলে। এবং আমাদের আর একবার আশ্বস্ত করে কবিতার শক্তি সম্পর্কে।
ভাষার ক্ষমতা, তার মাঝে বিশেষ করে কবিতার ক্ষমতার কথা অজ্ঞানের আবিষ্কারক ফ্রয়েডও স্বীকার করে গেছেন। উনি অজ্ঞানের যেখানেই একটু আলো ফেলতে পারেন, সেখানেই তাঁর আগে কোনো না কোনো কবি গেছেন বলে উনি আমাদের জানিয়ে গেছেন। ভাষার অধিপতি হওয়ার ফলে এভাবেই কবি অনেক অনাস্বাদিতের অভিজ্ঞতা লাভ করে। সেই কবি ও কবিতার প্রতি সলিমুল্লাহ খানের পক্ষপাত আমরা দেখতে পাই।
‘এক আকাশের স্বপ্ন’ নামে খান সাহেবের একটি কবিতা গ্রন্থ আমাদের অনেকেরই খুব সম্ভব পড়া। পরবর্তীকালে উনি প্রকরণের দিক দিয়ে বিবেচনা করলে কবিতা চর্চায় সেভাবে আর থাকেননি। কিন্তু কবি বা কবিতা যদি মূলত একটি দৃষ্টিভঙ্গী হয় সেই দৃষ্টিভঙ্গিটি সলিমুল্লাহ খান কখনোই বিসর্জন দেননি। আজ পর্যন্ত যে উনি তা লালন করেন তার প্রমাণ আমরা ইতোমধ্যেই পেয়েছি। প্রথম কবিতাগ্রন্থের পর সলিমুল্লাহ খান আর কোনো কবিতা পুস্তক প্রকাশ না করলেও খেয়াল করলেই দেখা যায়, ওনার প্রায় সব পুস্তক বা লেখা উনি শুরু করেন কারো না কারো কবিতা দিয়ে।
কবিতা কোনো হাওয়াই মিঠাই নয়। ভাষার প্রশ্নে, যে ভাষাকে লাকা মানুষের স্রষ্টা বলেছেন সেই ভাষার প্রশ্নেও কবিতা অনেক ভারী জিনিস। এই সত্যে সলিমুল্লাহ খানও ভোট দেন।
‘আমি, তুমি, সে’ নামক ভাষা বিষয়ক একটি গদ্যের প্রারম্ভে তাই তিনি মনসুর হাল্লাজ থেকে উচ্চারণ করেন-
আমার প্রাণের চোখ খুললো
প্রিয়ের সঙ্গে দেখা হলো
‘কে তুমি?’ পুছ করলো সে
‘কেন তুমি’ জবাব দিলাম আমি
ভাষার মর্মোদ্ধারের প্রশ্নে, ভাষা যখন আপন, অপর, পরে বিভাজিত সেই ভেদরেখা বুঝতে ও বোঝাতে এভাবেই সলিমুল্লাহ খান বারবার কবিতার স্মরণ নেন। কবি যখন একটা দৃষ্টিভঙ্গি। সলিমুল্লাহ খান তেমনই এক দৃষ্টিভঙ্গির জানালা খুলে যখন আমাদের ভাষা প্রসঙ্গে বলেন, তখন আমরা ভাষার রূপকগুণের উছিলায় কবিতা, সমাজ, রাষ্ট্র, ইতিহাসকে নব নব অর্থে আবিষ্কার করি। এই আবিষ্কারযাত্রা আর দীর্ঘকাল চলুক এই আমাদের প্রধান চাওয়া। আশা করি কালে কালে ওনার চিন্তার দ্যুতি আরও আরও বৃহত্তর পরিধির দিকে ছড়াক। যদিও তা নিয়ে ওনার না ভাবিলেও চলে। কেননা, ডরোথি জুল্লের কবিতার অনুবাদ নিয়ে প্রকাশিত কিতাব ‘আল্লাহর বাদশাহি’র ভূমিকায় একটি জায়গায় উনি জুল্লের প্রতি যে সকল পঙ্ক্তি চয়ন করেছেন ওনার বেলায়ও তাই প্রযোজ্য-
‘গোলাপের কোনো কেন নাই
উহা ফুটিয়া থাকে কারণ উহা ফুটিয়াই থাকে
উহা নজরে নজরে রাখে না নিজেকে
জানিতেই চাহে না কেহ উহাকে দেখিল কি দেখিল না…’