আমরা সাধারণ মানুষ যারা, তারা সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে নিজেদের বদলে নিই, হয়ে উঠি সময়োপযোগী। কিন্তু অনন্য যারা, যারা অসাধারণ, তারা চেষ্টা করেন নিজেদের সৃষ্টিশীলতা ও মেধা দিয়ে সময়কে বদলাতে। চেষ্টা করেন পৃথিবীকে পাল্টে দিতে। পৃথিবী যুদ্ধসঙ্কুল, বন্ধুর এর পথ। প্রতিকূল এই পৃথিবীকে নিজের অনুকূলে আনার চেষ্টা তাই মানুষের অতিপ্রাচীন। পৃথিবীতে মানুষের যে ইতিহাস, তা মূলত যুদ্ধবিগ্রহের ইতিহাস, প্রতিকূলতাকে জয় করে নিজের অনুকূলে পৃথিবীকে বদলে দেওয়ার প্রবণতার ইতিহাস। এখানে তাই তলোয়ারের শক্তিকে অস্বীকার করা যায় না কোনোভাবেই। কিন্তু কখনো কখনো এই তলোয়ার তথা অসির চেয়ে কলম তথা মসিই শক্তিশালী হয়ে ওঠে, হয়ে ওঠে অপ্রতিরোধ্য। তাই বাংলা সেই প্রবাদটি জনপ্রিয় হয়ে ওঠে, ‘অসির চেয়ে মসি বড়’। এই মসি বলতে আক্ষরিক অর্থেই মসি কিংবা কলম নয়। এর অর্থ মানুষের মেধা বা সৃষ্টিশীলতা, যা দিয়ে মানুষ সব প্রতিকূলতার সঙ্গে যুদ্ধ করে নিজেকে করে তোলেন অনন্য। নিজেকে করে তুলতে পারেন অসির চেয়েও শক্তিশালী। ইতিহাসে তার ভূরি ভূরি প্রমাণ মিলবে। ব্যঙ্গ কার্টুন হান্দালা মূলত তেমনই একটি উদাহরণ পৃথিবীর কাছে।
মানুষ তার অব্যক্ত কথামালা ব্যক্ত করতেই মূলত ভিন্ন ভিন্ন মাধ্যম ব্যবহার করেন। বলে যা বোঝানো যায় না, তা সে লেখে, এঁকে বা অন্যভাবে প্রকাশের চেষ্টা করে মানুষ। এসবের মধ্যে আঁকাটা যদি কার্টুননির্ভর হয়, তখন তা সহজেই মানুষের বোধগম্য ও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। সহজেই তা মানুষের হৃদয়কে আন্দোলিত করতে সক্ষম হয়। স্মরণকালের প্রায় প্রতিটি বিপ্লব ও যুদ্ধেই কার্টুনের মাধ্যমে প্রতিবাদের বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হয়। সাম্প্রতিক ইহুদিবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনের যে প্রায় শতবর্ষব্যাপী প্রতিরোধ ও যুদ্ধ, তার প্রতিটি ক্ষেত্রে এ ধরনের প্রতিবাদ চোখে পড়ে। এই মাধ্যমটি যে খুব অবহেলাযোগ্য বা গুরুত্বহীন নয়, তার প্রমাণ মেলে যখন এই মাধ্যমের ব্যবহারকারী ব্যক্তিটিকে আততায়ীর হাতে খুন হয়ে যেতে হয়। তখন এটিই প্রমাণিত হয় যে মাধ্যমটি শক্তিশালীই শুধু নয়, বরং তা মানুষের দৃষ্টিভঙ্গিকে বদলে দিতে সক্ষম।
যার কথা এতক্ষণ বলছি, তিনি নিপীড়িত ফিলিস্তিনের অন্যতম শক্তিশালী কার্টুনিস্ট নাজি সালিম হুসাইন আল-আলী। হান্দালা কার্টুনের জনক। একদম সঠিকভাবে বললে, ক্যারিকেচারিস্ট। ক্যারিকেচার আঁকতেন। তার আঁকায় উঠে এসেছিল ফিলিস্তিনের দুর্দশার দারুণ মর্মস্পর্শী সব চিত্র। ফুটে উঠেছিল তীব্র প্রতিবাদ। সেই অপরাধেই গুপ্ত ঘাতকের গুলিতে প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে।
নাজি সালিম হুসাইন আল-আলী জন্মেছিলেন ফিলিস্তিনের গালিলির আশ শাজারা গ্রামে, ১৯৩৭ সালে। তখনো ইসরায়েল রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়নি। তার বয়স যখন ১০, তখন একদল সশস্ত্র জায়ানিস্ট তাদের গ্রামে হামলা করে। আলী ও তার পরিবার এ সময় পালিয়ে চলে যান লেবানন। দেশটির দক্ষিণে সিডন নামের একটি শহরে রিফিউজি ক্যাম্প। নাম আইন আল-হিলওয়াহ। সেখানেই জোটে আশ্রয় তাদের।
এ প্রসঙ্গে আলী বলেন, “আমার বয়স তখন সবে দশ, পালিয়ে এলাম আইন আল-হিলওয়াহ রিফিউজি ক্যাম্পে। ক্ষুধা-তৃষ্ণায় কাতর, খালি পা, অনেকটা লোপ পেয়েছে স্বাভাবিক চিন্তাক্ষমতা। ক্যাম্পের জীবন ছিল অমানবিক। দারিদ্র্য ও হতাশার হাত ধরে নিত্য অপমানের শিকার হয়ে মানবেতর জীবন কাটিয়েছি।”
স্বদেশ হারানো সেই শিশুটিই মূলত কার্টুন হান্দালা। ১০ বছর বয়সী যে কার্টুন চরিত্রটি মূলত সমগ্র ফিলিস্তিনের স্বদেশ হারানো হাজারো উদ্বাস্তু ফিলিস্তিনি শিশুদের প্রতিনিধি। সেদিনের স্বদেশ হারানো সেই ১০ বছরের শিশু আলী জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত বেঁচে ছিল কার্টুনিস্ট আলীর বুকে। সেই শিশুটিই কার্টুন চরিত্র হয়ে ফুটে উঠেছিল তার কলমে, হয়ে উঠেছিল তার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টি। হান্দালাকে প্রথম দেখা যায় ১৯৬৯ সালে কুয়েতের এক সংবাদপত্রে। ১০ বছরের খালি পায়ের এক ফিলিস্তিনি শিশু, স্বাস্থ্যহীন, যার গায়ে খুশকির মতো খসখসে ময়লা। যার দুই হাত পেছনে মুঠি করে ধরা, দর্শকের দিকে পিঠ দেখিয়ে দাঁড়ানো। আলী বলেন, “আমি যে বয়সে ফিলিস্তিন ছেড়ে আসি, সে-ও সেই বয়সী। এক অর্থে আজও আমি সেই শিশুটিই রয়ে গেছি। ভেতরে টের পাই, ফিলিস্তিনি শিশু হিসেবে পেরিয়ে আসা প্রতিটি গাছ, ঝোপঝাড়, ঘরবাড়ি, প্রতিটি পাথর—সব মনে আছে আমার স্পষ্ট। ঘুরেফিরে তারা দেখা দেয় আমার স্মৃতিতে।”
হান্দালা মূলত একটি প্রতিবাদ, একটি প্রতিরোধ। ১৯৭৩ সাল থেকে হান্দালা নানা জায়গায় উঠে এসেছে, প্রতিবাদ করেছে, কিন্তু কোথাও সে তার মুখ দেখায়নি। পুরো পৃথিবী যে ফিলিস্তিনের দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, ফিলিস্তিনকে অস্বীকার করে, তার দিকে পেছন ফিরে কাজ করে যাচ্ছে নিজেদের মতো, আর ফিলিস্তিনের মুক্তিসংগ্রাম ও বন্দী দিনগুলোয় একের পর এক হান্দালারা কাটাচ্ছে অসহ্য মানবেতর জীবন—এটাই ছিল এই প্রতিবাদের মূল সুর। হান্দালার নামটিও এই প্রতিবাদেরই প্রতীক। ফিলিস্তিনের এক তেতো উদ্ভিদের আরবি নাম ‘হান্দাল’। সেখান থেকেই এই নাম। ফিলিস্তিনি শিশুদের জীবনের প্রতিরূপ।
হান্দালার এই পথচলা শুরু হয় ফিলিস্তিনের এক লেখকের হাত ধরে। তার নাম ঘাসান কানাফানি। তিনিও খুন হয়েছেন ১৯৭২ সালে। ১৯৫০-এর দশকে তিনি আইন আল-হিলওয়াহ ক্যাম্পে গিয়েছিলেন। সেখানেই তার দেখা হয় আলীর সঙ্গে। আলীর কাজ দেখে তিনি মুগ্ধ হন। সেই সূত্র ধরেই বেশ কিছু আরব সংবাদপত্রে কাজ জুটে যায় আলীর। এভাবেই একসময় আলী চলে আসেন কুয়েতে। ৬০ ও ৭০ দশকের বেশির ভাগটা তিনি সেখানে আস সিয়াসা ও আল কাবাস নামে দুটি সংবাদপত্রের জন্য কাজ করেন। তার কার্টুনের মুখ্য বিষয় ছিল ওটিই—ফিলিস্তিনিদের সংগ্রাম ও আরব নেতাদের নীরবতা, ব্যর্থতা। রাজনৈতিক সমর্থন তাই কখনোই জোটেনি। বরং ঠোঁটকাটা স্বভাবের জন্য মৃত্যুর হুমকি কড়া নেড়েছে বারবার। তবে সাধারণ আরবদের মনে ঠিকই জায়গা করে নিয়েছেন নাজি আল-আলী।
১৯৭৫ থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত নাজি আল-আলী কার্টুন সৃষ্টি করেছিলেন, যা ফিলিস্তিনি উদ্বাস্তুদের দুর্দশাকে চিত্রায়িত করেছিল। এই কার্টুনগুলো আজও প্রাসঙ্গিক এবং এসব কার্টুনের প্রতিটিতে উপস্থিত শরণার্থী শিশু হান্দালা ন্যায়বিচার ও আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য ফিলিস্তিনি জনগণের সংগ্রামের একটি শক্তিশালী প্রতীক হিসেবে রয়ে গেছে।
হান্দালা সম্পর্কে বলতে গিয়ে নাজি আল-আলী বলেছেন, “শিশু হান্দালা আমার অস্তিত্ব, আমি যেখানেই যাই সবাই আমাকে তার সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করে। আমি উপসাগরীয় অঞ্চলে এই শিশুর জন্ম দিয়েছি এবং আমি তাকে জনগণের সামনে উপস্থাপন করেছি। তার নাম হান্দালা এবং সে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছে যে সে নিজে সত্যের সঙ্গে থাকবে। আমি তাকে একটি শিশু হিসেবে আঁকলাম যে সুন্দর নয়; তার চুল একটি শজারুর কাঁটার মতো, যে তার কাঁটাগুলোকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে। হান্দালা একটি স্বাস্থ্যবান, সুখী, স্বস্তিদায়ক বা আদরণীয় শিশু নয়। সে শরণার্থী শিবিরের শিশুদের মতো খালি পায়ে থাকে, এবং সে একজন আইকন, যা আমাকে ভুল করা থেকে রক্ষা করে। রুক্ষ হলেও সে অ্যাম্বারের গন্ধ পায়। যখন আমেরিকান উপায়ে আমাদের কাছে সমাধানগুলো উপস্থাপন করা হয় তখন প্রত্যাখ্যানের চিহ্ন হিসেবে তার হাত তার পিঠের পিছনে আঁকড়ে থাকে।”
নাজি আল-আলী আরও বলেন, “হান্দালা ১০ বছর বয়সে জন্মেছিল এবং সে সর্বদা ১০ বছর বয়সীই থাকবে। সেই বয়সে আমি আমার জন্মভূমি ছেড়েছি, এবং যখন সে ফিরে আসবে হান্দালা তখনো ১০ বছরেরই থাকবে, এবং তারপর সে বড় হতে শুরু করবে। প্রকৃতির নিয়ম তার জন্য প্রযোজ্য নয়। সে অনন্য। দেশে ফিরলে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে।
আমি তাকে গরিবদের কাছে পেশ করলাম এবং তিক্ততার প্রতীক হিসেবে তার নাম হান্দালা রাখলাম। প্রথমে, সে একজন ফিলিস্তিনি শিশু ছিল, কিন্তু তার চেতনা ক্রমশ জাতীয়তার গণ্ডি পেরিয়ে বৈশ্বিক ও মানবিক দিগন্তে বিকশিত হয়েছে। সে একজন সাধারণ কিন্তু কঠিন শিশু, এবং এই কারণেই লোকেরা তাকে গ্রহণ করে নেয় এবং অনুভব করে যে সে তাদের চেতনার প্রতিনিধিত্ব করে।”
আজ নাজি আল-আলী নেই, কিন্তু হান্দালা কার্টুনটি আছে। সেটি এখনো তুমুল জনপ্রিয় হিসেবে নিপীড়িত, উদ্বাস্তু হাজারো ফিলিস্তিনি শিশুদের প্রতিনিধি হিসেবে প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে বিশ্বময় টিকে আছে।
সূত্র : হান্দালা ডটঅর্গ।
লেখক : শিক্ষক ও সাহিত্যিক