• ঢাকা
  • শনিবার, ২৩ নভেম্বর, ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬
আদিবাসী জীবনকথা ১৩

পাহাড়িয়াদের রক্ষা গোলা


সালেক খোকন
প্রকাশিত: অক্টোবর ১২, ২০২৩, ০৩:৩৭ পিএম
পাহাড়িয়াদের রক্ষা গোলা

চৈত্র মাস। তাই দিনভর গরম। কিন্তু রাতে শীত শীত ভাব। ভোরের দিকে এখনো কুয়াশা পড়ছে। রাজশাহীর আবহাওয়া এর আগে কখনো এমনটি হয়নি। সময়ের সঙ্গে বদলে যাচ্ছে ঋতুগুলো। বদলে যাচ্ছে প্রকৃতি। সঙ্গে সঙ্গে বদলাচ্ছে মানুষের জীবনপ্রবাহ।


রাজশাহী এসে আদিবাসী গ্রামের খোঁজ করছিলাম। বন্ধু কাজিমের উৎসাহে সহজেই মেলে রাজকুমার শাও-এর মুঠোফোনের নম্বরটি। এখানকার আদিবাসী উন্নয়ন সংস্থার নির্বাহী পরিচালক তিনি। কাজ করেন আদিবাসীদের ভাগ্যোন্নয়নে। মুঠোফোনে তাদের কাজ নিয়ে চলে নানা আলোচনা। কথায় কথায় তার কাছ থেকে জানলাম গোলাই গ্রামটির কথা।
ষাটটি আদিবাসী পরিবারের বাস নাকি ওই গ্রামে। আমরা আগ্রহী হই। বন্ধু কাজিম ভালোভাবে জেনে নেন ঠিকানাটি।


রাজশাহী শহর থেকে ১০ কিলোমিটার ভেতরে গ্রামটি। কাশিয়াডাঙ্গা মোড় হয়ে কাকনহাট রোডে পড়বে দামকুড়া হাট। সেটি পেরিয়ে বাঁ দিকের পথ ধরে এগোলে ধামিলা গ্রাম। ওই গ্রামের পরের গ্রামটিই গোদাগাড়ী উপজেলার দেওপাড়া ইউনিয়নের গোলাই গ্রাম।


আমরা যখন গ্রামটিতে পৌঁছি, তখন মধ্য বিকেল। মাটি আর ছনে ছাওয়া ছোট ছোট ঘর। গরমের মধ্যেও ঘরগুলোতে শীতল পরিবেশ। একটি ঘরের বারান্দাতে গা এলিয়ে বসে আছেন বেশ কয়েকজন বৃদ্ধা। পাশেই সামান্য উঁচুতে রাখা আছে বড় একটি টেলিভিশন। একদল শিশু ও নারী দলভেদে উপভোগ করছে ডিশ-বিনোদনের অনুষ্ঠানগুলো। আমরা খানিকটা অবাক হই। হিন্দি সংস্কৃতির আগ্রাসী থাবা থেকে আজও রক্ষা পায়নি আদিবাসী গ্রামগুলো।


গ্রামপ্রধানের নাম রঘুনাথ সিং। বয়স ষাটের মতো। পিতা দিয়াঋষি সিং ও মা পদ্যরানী সিংয়ের আদরের সন্তান রঘুনাথের জন্ম তানোরের কচুয়া গ্রামে। একসময় সেখানে স্থানীয় বাঙালিদের সঙ্গে জমি নিয়ে চলে নানা বিরোধ। ফলে নিজ জায়গায় টিকতে পারে না রঘুনাথের পরিবার। জীবনের তাগিদে তাই চলে আসেন গোলাই গ্রামের শ্বশুরবাড়িতে।


রঘুনাথের বাড়ির ভেতরটা বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন। গোয়ালঘরটি শোবারঘরের লাগোয়া। পাশেই রান্নাঘর। পাহাড়িয়াদের বাড়িগুলো নাকি এমনটাই হয়। বাড়ির ঠিক মাঝে কয়েকটা সন্ধ্যাতারা ফুলের গাছ। তাদের মাঝে মাথা তুলে দিয়েছে একটি তুলসী। গাছগুলোর গোড়ার দিকটায় মাটি দিয়ে উঁচু ডিবি তৈরি করা। এটিই তাদের তুলসী দেবতা। গোড়ার মাটিটা লেপে রাখা হয়েছে। প্রতি সন্ধ্যায় বাড়ির নারীরা ভক্তি দেন সেখানে। এদের ভাষায় ‘কুরিপূজা’ বলে। তখন সন্ধ্যা ছিল। প্রদীপ ও ধূপ জ্বালিয়ে, পানি ছিটিয়ে দেবতার সন্তুষ্টিতে ভক্তি দিচ্ছিল রঘুনাথের মেয়ে আমতি সিং।


পাহাড়িয়া বা পাহাড়ি আদিবাসীদের গ্রামগুলো পরিচালিত হয় একটি গ্রাম পরিষদের মাধ্যমে। একসময় এ পরিষদে ছিল বেশ কয়েকটি পদ। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সেই গ্রাম পরিষদও আজ দুর্বল হয়ে পড়েছে। বর্তমানে পাহাড়ি গ্রামগুলো পরিচালিত হচ্ছে গ্রামপ্রধান বা মোড়ল ও সাকিদার পদ নিয়ে। আদিবাসী গ্রামের সবার কাছে নানা খবরাখবর পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব থাকে সাকিদারের। গোলাই গ্রামের সাকিদার বীরেন কুমার সিংয়ের সঙ্গে আমাদের দেখা না হলেও নানা বিষয়ে কথা চলে মোড়ল রঘুনাথ সিংয়ের সঙ্গে।


পাহাড়িয়াদের এই গ্রামটিতে যাদের নিজস্ব জায়গা নেই, তাদের বসতবাড়ির জায়গা দিয়েছে অন্য আদিবাসীরা। সে অর্থে পাহাড়িয়ারা নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আশ্রয় দিচ্ছে অন্য ভূমিহীন আদিবাসী পাহাড়িয়া পরিবারগুলোকে। এভাবে আদিবাসীরাই আজ সচেতন হয়েছে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায়। ফলে একধরনের ঐক্য তৈরি হয়েছে এখানকার আদিবাসী পাড়াগুলোতে।


পাহাড়িয়াদের বিয়ে, জন্ম, মৃত্যু, পূজা, বিচারসহ নানা আনুষ্ঠানিকতায় গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পালন করতে হয় গোত্রের মোড়লকে। এদের মোড়ল নির্বাচন হয় গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে, সবার মতামতের ভিত্তিতে। মোড়লের ছেলে মোড়ল হয় কি না, প্রশ্ন করতেই রঘুনাথ উত্তরে বলেন, যোগ্যতা থাকলে হয়। তবে সেটি কোনো নিয়ম নয়। সবাই মিলে আলোচনা করে মোড়ল নির্বাচন করাই পাহাড়িয়াদের নিয়ম। রঘুনাথ সিং নিজে মোড়লের দায়িত্ব পালন করলেও তার বাবা গোত্রের কোনো পদেই ছিলেন না।


পাহাড়িয়াদের পূর্বপুরুষরা এসেছে ভারতে মুর্শিদাবাদ, নদিয়া, মালদহ থেকে। গোলাই গ্রাম ছাড়াও রাজশাহীর জামদাহ, কানাপাড়া, খৈড়া কান্দিতে রয়েছে পাহাড়িয়াদের আরও গ্রাম। গোত্রের মোড়লের ভাষায়, যত পুবে যাবেন, তত পাহাড়ি বেশি; পশ্চিমে তেমন একটা নেই।
পাহাড়িয়ারা মূলত কৃষিকাজের ওপর নির্ভরশীল। এ গ্রামের অধিকাংশেরই নিজের আবাদি জমি নেই। ফলে ফসল লাগানো ও ফসল তোলার সময় অন্যের জমিতে কাজ করে যা পায়, তা দিয়েই চলে তাদের সংসার। এদের পুরুষ ও নারী উভয়েই মাঠে কাজ করে। পাশাপাশি নারীদের রান্নাসহ ঘরের সব কাজও করতে হয়।


এখানকার আদিবাসী সমাজে বছরে তিন থেকে চার মাস থাকে অভাব। রঘুনাথের ভাষায়, ফসল লাগানোর পর থেকে ফসল কাটার আগ পর্যন্ত। এ সময়টাতে তাদের কোনো কাজ থাকে না। তাই চৈত্র-বৈশাখ আর আশ্বিন-কার্তিক এখানকার পাহাড়িয়া আদিবাসীদের অভাবের মাস।
অভাবের মাসে টিকে থাকতে আদিবাসীদের খাদ্যের জন্য ধরনা দিতে হয় মহাজনদের বাড়ি বাড়ি। আগাম শ্রম বিক্রি ছাড়াও মহাজনদের কড়া শর্ত মেনেই চাল ধার নিতে হয় তাদের। রঘুনাথের ভাষায়, এক মণ চাল খেলে দিতে হয় দেড় মণ। ফলে আদিবাসীদের ভাগ্য আটকে থাকে মহাজনদের সুদচক্রে।


গোত্রের মোড়ল দৃঢ়কণ্ঠে জানালেন, এ গ্রামের পাহাড়িয়ারা অভাবের সময়টাতে এখন আর মহাজনদের কাছে যান না। কেন? তা জানতে চাইলে তিনি আমাদের গ্রামের ভেতর দিকটায় নিয়ে যান। বড় একটি মাটির ঘর। ঘরের বাইরে সাদা রঙে নানা ধরনের আলপনা আঁকা। এটিই পাহাড়িয়াদের রীতি। ঘরটির দরজার পাশে আমাদের দৃষ্টি আটকায়। লেখা, গোলাই রক্ষা গোলা।
রক্ষা গোলা কী? ঘরের বারান্দায় বিছানো মাদুরে বসতে বসতে রঘুনাথ সিং জানালেন, এটি তাদের মুষ্টি সমিতি। আদিবাসীদের অভাব মেটাতে পাঁচ বছর আগে গ্রামের ৫০টি পরিবারকে নিয়ে গঠিত হয়েছে এই সমিতি। অভাবের সময়ে এই সমিতিই পাহাড়িয়াদের রক্ষার কাজ করে, তাই সমিতির এমন নামকরণ।


রক্ষা গোলায় প্রতিদিন পরিবারপ্রতি এক মুষ্টি চাল হিসেবে সপ্তাহে আধা কেজি চাল জমা দিতে হয়। এটিই সমিতির সঞ্চয়। অভাবের মাসে এই চালই ধার হিসেবে বিতরণ করা হয় দরিদ্র আদিবাসী পরিবারগুলোর মধ্যে। মোড়লের ভাষায়, যখন অভাব থাকে, তখন এই রক্ষা গোলার সদস্যরা এখান থেকে চাল নিয়ে পরিবার চালান। তিন-চার মাস পর তাদের আবার এই চাল ফেরত দিতে হয়। ফলে অভাবের সময়টাতে এ গ্রামের পাহাড়িয়াদের এখন আর মহাজনদের সুদের জালে আটকে থাকতে হয় না।


কথায় কথায় হাজির হন যুবক বয়সী শ্যামল কুমার সিং। তিনি বিএ পাস করেছেন রাজশাহী কলেজ থেকে। রক্ষা গোলার হিসাব রক্ষার দায়িত্বটি তার ওপরই। বললেন রক্ষা গোলা গঠনের পেছনের গদ্যটি।


গোলাই গ্রাম থেকে চার কিলোমিটার ভেতরে রয়েছে আরেকটি আদিবাসী গ্রাম। নাম নিলকুরি গ্রাম। সেখানে বাস করে শতাধিক ওঁরাও পরিবার। সে গ্রামের প্রধান নিরঞ্জন কুজু। তার উদ্যোগেই ওঁরাওরা সেখানে প্রথম গড়ে তোলে একটি রক্ষা গোলা। দিনে দিনে মুষ্টি চালে সঞ্চয় করে স্বচ্ছতা আসে সে গ্রামের আদিবাসীদের।


একবার নিলকুরি গ্রামের পাশেই কাজ করতে যায় পাহাড়িয়া গ্রামের নারীরা। কথায় কথায় ওঁরাওদের কাছ থেকে তারা মুষ্টি চালে সঞ্চয়ের কথা শুনতে পায়। সব জেনে গোলাই গ্রামের আদিবাসীরাও আগ্রহী হয়।


পরে মোড়ল রঘুনাথসহ অন্যরা যান সেখানে। রক্ষা গোলা তৈরিতে ওই গ্রামের নিরঞ্জন কুজু তাদের সব রকম সহযোগিতা করেন। সে থেকেই শুরু। এভাবেই মুষ্টি চালে বদলে যাচ্ছে আদিবাসী গ্রামের চিত্রগুলো। ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রলোভন এড়িয়ে নিজের চেষ্টায় এখানকার পাহাড়িয়ারা টিকিয়ে রাখছে পূর্বপুরুষদের রীতিনীতি ও সংস্কৃতিটাকে।


রক্ষা গোলা নিয়ে গোলাই গ্রামের পাহাড়িয়া আদিবাসীরা আজ স্বপ্ন বিভোর। মুষ্টি চালে পাল্টে যাবে আদিবাসীদের জীবন। তারা হবেন অধিকার সচেতন ও স্বনির্ভর। একসময় অভাব বলে কিছু থাকবে না। ‘মহাজন’ নামক শব্দটি মুছে যাবে আদিবাসীদের জীবন থেকে।
 

সাহিত্য-সংস্কৃতি বিভাগের আরো খবর

Link copied!