চোখ ঝলমলিয়ে দেওয়া আলোর শহরে মানুষ বিচ্ছিন্ন। চোখ ধাঁধিয়ে দেওয়া শহুরে কৃত্রিম আলোতে মানুষের চোখ যেন পাশের মানুষটির ভেতরে থাকা হৃদয়পুরের খবর পড়তে পারে না। এমনকি নিজের হৃদয়েরটাও নয়। এ যেন লালনের সেই গানের মতো—বাড়ির পাশে আরশি নগর, সেথায় পড়শী বসত করে, আমি একদিনও না দেখিলাম তারে।
একেকটি মানুষ আসলে আয়নার মতোই। অন্য মানুষটি যখন তাকায়, তখন সে নিজেকেই আবিষ্কার করে। নিজের শরীরে এসে পড়া হাজার ওয়াটের শহুরে আলোর প্রতিফলন যখন সমুখের মানুষ-আয়নায় গিয়ে পড়ে, তখন সে আসলে কিছুই ভালো করে দেখতে পায় না; না নিজেকে, না অপরকে। শহরের প্রেক্ষাপটে মানুষের অন্তর্দৃষ্টি যেন ঝাপসা হয়ে আসে।
অপর দিকে শহর থেকে দূরে, ব্যস্ততা ও কোলাহলবিহীন জনপদে, যেখানে আলো কম, সেখানে যেন মানুষ আরও কাছাকাছি আসে, ঘন হয়ে আসে সবার। স্পষ্ট করে একে অন্যকে পাঠ করতে পারে। নক্ষত্রের আলোর নিচে, নির্জনতায় ধ্যানমগ্ন পাঠকের মতো তারা নিজেদের আবিষ্কার করতে পারে।
এমন বক্তব্য নিয়েই, অন্তত আমার কাছে, পায়েল কাপাডিয়া নির্মাণ করেছেন ‘অল উই ইম্যাজিন অ্যাজ লাইট’ (২০২৪) ছবিটি। পুরো ছবির বক্তব্যে যান্ত্রিক ও অযান্ত্রিকের একটি দ্বান্দ্বিক জায়গা রয়েছে বলে আমার মনে হয়েছে। অভিন্ন জায়গাটি হলো মানবিক সম্পর্ক: শহরে সেটি ভঙ্গুর, গ্রামে ঘনীভূত। শহর আর গ্রামের ভেতরকার এই যে প্রকট পার্থক্য আমরা এই সিনেমাতে দেখি, সেখান থেকে আমাদের মনে পড়ে যায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘সভ্যতার প্রতি’ কবিতাটির কথা:
দাও ফিরে সে অরণ্য, লও এ নগর,
লও যত লৌহ লোষ্ট্র কাষ্ঠ ও প্রস্তর
হে নবসভ্যতা! হে নিষ্ঠুর সর্বগ্রাসী,
…
চাই স্বাধীনতা, চাই পক্ষের বিস্তার,
বক্ষে ফিরে পেতে চাই শক্তি আপনার,
পরানে স্পর্শিতে চাই ছিঁড়িয়া বন্ধন
অনন্ত এ জগতের হৃদয়স্পন্দন।
সিনেমার শুরুতেই দেখা যায় মুম্বাই নগরীকে। কি তার ব্যস্ততা, কি তার আলো ঝলমলে রূপ। তার পেছনে ধারাবর্ণনায় একজনের কণ্ঠস্বর শোনা যায় না। বিভিন্ন মানুষের ভাষা সেখানে চাবুকের মতো আছড়ে পড়তে থাকে। পায়েল কাপাডিয়া ঠিক এই ভঙ্গিটা বেছে নিয়েছেন শহরের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণেই। শহরকে তিনি দেখিয়েছেন দূর থেকে। যারা শহরকে মুখরিত করে রাখে তারা শহরের কেউ নয়। তাদের সম্পর্ক অনেক দূরের। শহর কখনো তাদের আপন হয়ে ওঠে না। জীবন ও জীবিকার চাপে মানুষগুলো শহরের দমবন্ধ করা পরিবেশে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। প্রতিদিনকার ক্লেদে তাদের পা আটকে আসতে চায়, শহর নাছোড়বান্দা। সাপের মতো মেট্রোরেলগুলো পেটের ভেতর পুরে নিয়ে, দুমড়েমুচড়ে যাওয়া মানুষগুলোকে কর্মস্থলে নিয়ে যায়, আবার বাসায় এনে ফেলে দেয়। ক্লান্তিকর এই জীবনে মানুষ সংসার ও প্রেম কোনো কিছুই শান্তিমতো করতে পারে না।
হাসপাতালের নার্স প্রভা বিয়ে করেছিল, কিন্তু জীবিকার চাপে বিয়ের পরই স্বামী জার্মানির আরেক বড় শহরে চলে যায়। এ যেন এক শহরের স্বপ্ন আরেক শহর গিলে খেয়ে নিয়েছে। প্রভা বিবাহিত হয়েও বিধবার মতো জীবন কাটায়। হাসপাতালের এক চিকিৎসক তাকে প্রেম নিবেদন করে ঠিকই, কিন্তু শহরের দমবন্ধ পরিবেশ থেকে বাঁচতে সেই চিকিৎসকও চলে যায় মুম্বাই ছেড়ে। একাকী প্রভার বিবাহিত জীবনের একমাত্র সাক্ষী যেন হয়ে থাকে জার্মানি থেকে পাঠানো লাল রঙের এক রাইস কুকার। ভাত রান্নার এই যন্ত্রটি আঁকড়ে ধরে ঝড়ের রাতে কেন কেঁদে ওঠে প্রভা? ভাত রান্নার সময় যে বাষ্প জমা হয় রাইস কুকারের ভেতর, সেই একইরকম কান্নার বাষ্প কি জমে ওঠে না প্রভার মনোজগতে? সে জন্যই কি তার বড্ড আপন মনে হয় রাইস কুকারটিকে? এখানে লাল রংটিও কিন্তু বেশ তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রভার সঙ্গে আরেকজন নবীন নার্স অনু। অনু বিবাহিত নয়, প্রেম করে। যে প্রেম আবার তার সমাজ অনুমোদন করে না। বিশেষ করে শহর। অনুর প্রেমিক শিয়াজ মুসলিম পরিবারের। তাই তার সঙ্গে লুকিয়েচুরিয়ে প্রেম করতে হয়। মিলিত হওয়ার আকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য অনুকে পরতে হয় বোরকা। কিন্তু শহরে সেদিন চরম বৃষ্টি। বেনোজলে যোগাযোগব্যবস্থা সব অকেজো। মেট্রোরেল স্থবির। শিয়াজও জানায় অনিবার্যকারণেই মিলন সম্ভব হচ্ছে না। তখন অনু আর শিয়াজ যেন পরস্পরের অচেনা হয়ে ওঠে। তারা বুঝে ওঠে না তাদের করণীয় কি! শহর কত সহজে পরিচিতকে অপরিচিত করে দেয়। যেমনটা অপরিচিত করে দিয়েছে প্রভার স্বামীকে।
শুধু কি তাই? দীর্ঘদিনের বসতবাড়িটাকেও কত সহজে অপরিচিত করে দিতে পারে ডেভেলপার নামের ভবন নির্মাতারা। পার্বতী একই হাসপাতালে কাজ করে। প্রভা আর অনুর সহকর্মী সে। জুটমিলের চাকরিচ্যুত শ্রমিক হিসেবে পার্বতীর স্বামী শহরের এক কোনে একটা ঘর পেয়েছিল। কিন্তু সেটাও কাগজের অভাবে পর হয়ে যায়। পার্বতীর পক্ষে আর সম্ভব নয় শহরে থাকা। গ্রামে এক খণ্ড জমি আছে। সেখান থেকে অন্তত কেউ তাকে তাড়িয়ে দিতে পারবে না। প্রভা আর অনুও চলল তার সঙ্গে। উপকূলবর্তী এক শান্ত, সৌম্য গ্রামে গিয়ে তারা পার্বতীর নতুন যাত্রায় শামিল হয়। সিনেমার শেষার্ধ এটি। দেখা যায় গ্রামীণ পটভূমিতে এমন অনেক কিছুই ঘটতে থাকে, যা শহরে ঘটতে পারেনি।
অনু ও শিয়াজের মিলন সম্ভব হয়, ফেনিল সাগরের অদূরে, প্রকৃতির মাঝে। ঢেউয়ে ভেসে আসা দুর্ঘটনাকবলিত অপরিচিত মানুষকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও প্রভার মনে হয়, এটাই তার জার্মানিতে চলে যাওয়া স্বামী। দৈবক্রমে ফিরে এসেছে। এক মুহুর্তের জন্য প্রভা স্বামীর অস্তিত্বকে অনুভব করতে পারে। শিয়াজ মুসলমান হওয়া সত্ত্বেও, এই গ্রামেই সম্ভব হয় অনু, প্রভা ও পার্বতীর সঙ্গে বসে গভীর রাত পর্যন্ত নক্ষত্রের আলোয় স্নান করা। গ্রামের জীবন নিরাভরণ। জটিলতা কম। সহজ, সুন্দর ও সারল্য মাখা গ্রামটিতে যখন রাত নেমে আসে, তখন উটকো আলোরা এখানে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে না। বরং নক্ষত্রের নরম আলোয় এমন এক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, যেখানে একজন মানুষ আরেকজন মানুষের আরও কাছাকাছি আসার সুযোগ পায়। কৃত্রিমতা ঘুচে যায়, তারা অকৃত্রিম প্রকৃতির সন্তানে পরিণত হয়। তারা নিজেদের দেখতে পায় স্পষ্ট করে। আলো ঠিকঠাকভাবে প্রতিফলিত না হলে চোখ বুঝতে পারে না সে কি দেখছে। আর ঠিক এই কথাটিই যেন আলোর রেখা দিয়ে আঁকার চেষ্টা করেছেন পায়েল কাপাডিয়া।
পায়েল কাপাডিয়ার ছবিটি ফ্রান্স, ভারত, নেদারল্যান্ডস, লুক্সেমবার্গ ও ইতালির আন্তর্জাতিক প্রযোজনা। ৭৭তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে সিনেমাটি প্রথম দেখানো হয়। ১৯৯৪ সালের পর এই সিনেমাটিই কানের মূল প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী ভারতের প্রথম চলচ্চিত্র এবং কাপাডিয়াই প্রথম ভারতীয় নারী চলচ্চিত্র নির্মাতা, যিনি ‘গ্রাঁ প্রি’ অর্থাৎ গ্র্যান্ড প্রাইজ অর্জন করেন কানে। মালয়লাম ভাষায় করা ছবিটিতে প্রভার চরিত্রে কানি কুসরুতি, অনুর চরিত্রে দিব্যা প্রভা, পার্বতীর চরিত্রে ছায়া কদম এবং শিয়াজের চরিত্রে হৃধু হারুন অপূর্ব অভিনয় করেছেন। বলার অপেক্ষা রাখে না, এই ছবিতে কাজ করার মধ্য দিয়ে তারা এরই মধ্যে তারকাখ্যাতি পেয়ে গেছেন এবং আলো ছড়াতে শুরু করেছেন।